আমরা যারা একটু ঘোরাঘুরি করতে পছন্দ করি, তাদের প্রায় সবারই হোটেলে থাকার সুযোগ হয়েছে। হোটেলের অভিজ্ঞতা হয়তো ভালো বা খারাপ। কিন্তু যদি বলি, পৃথিবীতে এমন একটি হোটেল আছে যার প্রায় ১ হাজার ৩০০ বছর ধরে অতিথিদের আপ্যায়ন করার অভিজ্ঞতা আছে! বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হবে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে এমন একটি হোটেল আছে। চাইলে ঘুরে আসতে পারো। জাপানি এই হোটেলের নাম নিশিয়ামা ওনসেন কিওনকান। এটিই বিশ্বের প্রাচীনতম হোটেল। জাপানের মনোরম ইয়ামানাশি প্রদেশের হায়াকাওয়া শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝখানে এই হোটেল অবস্থিত।
নিশিয়ামা ওনসেন কিওনকান নামের এই হোটেল নির্মাণ করা হয় ৭০৫ সালের দিকে। এটি নির্মাণ করেন ফুজিওয়ারা মাহিতো। যিনি জাপানের ৩৮তম সম্রাট তেঞ্জির ঘনিষ্ঠ এক সহযোগীর ছেলে। এখন অনেকেই ভাববে, তখন কি হোটেল ব্যবসার প্রচলন ছিল? আদতে এটিকে হোটেল হিসেবে তৈরি করা হয়নি সেকালে। এই হোটেল আকাইশি পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত। তখন এটি আধুনিক হোটেলের মতো নয় বরং সমাজের উচ্চশ্রেণির ব্যক্তিদের জন্য একটি বিশেষ স্থান ছিল। প্রাকৃতিক গরম পানির কূপ ছিল বলে জায়গাটি রাজাদের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিল। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। জাপানের ইতিহাসে ৪০০ বছর ধরে শাসনকারী টোকুগাওয়া শোগুন পরিবারের বিখ্যাত নেতা থেকে শুরু করে বর্তমান সম্রাট নারুহিতো পর্যন্ত অনেকেই এখানে পানিতে ভিজতে ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে এসেছেন।
দীর্ঘদিন ধরে জাপানি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে এখানে হোটেলের ধারণা সুপরিচিত। তবে ২০১১ সালে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে বিশ্বের প্রাচীনতম হোটেল হিসেবে নিশিয়ামা ওনসেন কিওনকানকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে এর খ্যাতি পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এই স্বীকৃতি পাওয়ার পর থেকে অনেক আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীর তালিকার শীর্ষে এই স্থান। এখনো হোটেলটি এর ১ হাজার ৩০০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রেখে পর্যটকদের সেবা দিচ্ছে। ফুজিওয়ারা মাহিতোর মৃত্যুর পর প্রায় ৫২ প্রজন্ম ধরে এই হোটেলের কার্যভার পরিবর্তিত হয়েছে। এত দিনেও ঐতিহ্যের ধারক হোটেলটি এর মূল রূপ ধরে রেখেছে। নতুন প্রজন্মের হাতে ক্ষমতা আসার সঙ্গে সঙ্গে হোটেলে বেশ কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হওয়ায় এখন পর্যন্ত তিনবার মূল ভবন পরিবর্তন করা হয়েছে।
হোটেলটিতে ৩৭টি কক্ষ জাপানের ঐতিহ্যবাহী গৃহশৈলীতে সজ্জিত। যেখানে প্রতিটি কক্ষে জাপানের তাতামি মাদুর বিছানো। এ ছাড়া একটি জাপানিজ খাবারের জন্য কাইসেকি রেস্টুরেন্ট এবং পাহাড় থেকে চাঁদ দেখার জন্য একটি নির্দিষ্ট জায়গাও রয়েছে। এখন এখানে আরও বেশ কয়েকটি আধুনিক উষ্ণ পানির পুল তৈরি করা হয়েছে পর্যটকদের জন্য, যেখান প্রতি মিনিটে এক হাজার লিটার প্রাকৃতিক গরম পানি সরবরাহ করা হয়। ২০১৯ সাল থেকে হোটেলের সব জায়গায় বিনা মূল্যে ওয়াই-ফাই সুবিধা রয়েছে। হোটেলের কর্মচারীরা জাপানের ঐতিহ্যবাহী পোশাক নিবু-শিকি কিমোনো পরে অতিথিদের সেবা দেন। এই হোটেলে অবস্থানরত অতিথির জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো, হোটেলের পাশে অবস্থিত জাপানের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট ফুজি।
হোটেলটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট কেনজিরো কাওয়ানো বিশ্বাস করেন, হোটেলটির একান্ত নিরিবিলি পরিবেশ এত বছর ধরে ব্যবসাকে টিকিয়ে রেখেছে। হোটেলের সাফল্য সত্ত্বেও একে আর বড় করা উচিত নয়। তিনি মনে করেন, আরও হাজার বছর টিকে থাকবে তাঁদের এই ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনতম হোটেল।
সূত্র: উইকিপিডিয়া, সিএনএন, ট্রাভেল অ্যান্ড লেইজার ডটকম