কিশোর আলোর শততম আড্ডা

কিশোরদের মাসিক পত্রিকা কিশোর আলো পাঠকদের নিয়ে দারুণ এক আয়োজন করে প্রতি মাসে। গল্প, গানে ভরপুর এ সভার নাম কিআড্ডা। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কিশোর আলোর প্রথম সভা। ২০২৫ সালের ১৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হলো কিআড্ডার শততম আসর। প্রথম সভায় পাঠক হিসেবে এসেছিল স্কুলপড়ুয়া আহমাদ মুদ্দাসসের। শততম কিআড্ডার গল্প বলছে সেই আহমাদ, যে এখন কিশোর আলোরই একজন কর্মী।

কিআড্ডা এপ্রিল ২০২৫ছবি: আব্দুল ইলা

এবারের কিআড্ডায় উপস্থাপক যখন জিজ্ঞেস করলেন, এমন কেউ কি আছে, যে প্রথম কিআড্ডায় উপস্থিত ছিল? আমি হাত তুললাম। আমি ছিলাম প্রথম কিআড্ডায়। উপস্থাপকের ডাকে মাইক্রোফোন হাতে নিলাম। স্মৃতি আমাকে নিয়ে চলল ২০১৩ সালে। এক দুপুরে সাভার থেকে কারওয়ান বাজার এসেছিলাম। ফেসবুকের পোস্ট দেখে জেনেছিলাম, কিশোরদের নিয়ে একটা মিটিং হবে। কিশোরদের জন্য নতুন একটা পত্রিকা আসবে। এটুকু জেনেই ঠিক করেছিলাম, মিটিংয়ে হাজির হব। হোস্টেলে থাকতাম। কড়াকড়ি ছিল বের হওয়ার ব্যাপারে। ছুটি পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। কী বলে ছুটি নিয়েছিলাম, তা আজ আর মনে নেই।

আমি বলতে চাই
ছবি: আব্দুল ইলা

কিশোর আলোর মিটিংয়ে এলাম। কী কী হয়েছিল, তা ঠিকঠাক মনে নেই। তবে তিনটা প্রচ্ছদ দেখানো হয়েছিল। কিশোর পত্রিকার প্রচ্ছদ হিসেবে কোনটা আকর্ষণীয় লাগে, আমাদের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল। একটা আঁকা ছবির প্রচ্ছদ, একটা ছিল তোলা ছবি। আরেকটা কেমন ছিল, ভুলে গিয়েছি। আঁকা ছবিটা তখন আমার তেমন ভালো লাগেনি। তবে তোলা ছবিটা বেশ লেগেছিল। যারা আড্ডায় এসেছিল, তাদের মতো ছেলেমেয়েরাই ছিল মডেল। এই আইডিয়াটা আমার দারুণ লেগেছিল। আমরা যেমন ভাবতাম, মডেল মানেই হবে ভিন্ন রকম কেউ, সেই ভাবনার সঙ্গে এই আইডিয়ার মিল নেই। আমাদের মতোই টি–শার্ট, প্যান্ট পরা কিছু ছেলেমেয়ে। যারা আমাদের আশপাশের স্কুল–কলেজে পড়ে। এই আইডিয়া ভালো লাগায় আমি ভোট দিয়েছিলাম ফটোশুটের সেই প্রচ্ছদে। যদিও ভোটে জিতে পরে ছাপা হয়েছিল প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ হিসেবে আঁকা ছবির প্রচ্ছদটাই। সেটা অক্টোবর ২০১৩। কিআর প্রথম সংখ্যা। নভেম্বর সংখ্যাতেই আমার ভোটের প্রচ্ছদ, আমাদের মতো ছেলেমেয়েরা মডেল, এমন একটা প্রচ্ছদ হয়েছিল। সেই নভেম্বর সংখ্যাটা এখনো আমার বিশেষ পছন্দের সংখ্যা। এরপর বহুদিন পেরিয়েছে। দুই, তিন করে পঞ্চাশ পেরিয়ে মিটিংয়ের সংখ্যা এখন এক শ।

শততম কিআড্ডায় আমার অংশগ্রহণ আর পাঠক হিসেবে নেওয়া হয়নি। আড্ডার আয়োজক দলের একজন হিসেবে এখানে যোগ দিয়েছি আমি। কী থাকবে এবারের কিআড্ডায়, কী হবে, কারা আসবে, শেষে খাবারটা কী হবে, কিআ টিম যখন এই বিষয়গুলো ঠিক করছিল, তখন তাদের মধ্যে আছি আমি। কিআর যখন বয়স ১০ বছর হবে, তখন আমি কিআতে যোগ দিয়েছি সহসম্পাদক হিসেবে। আড্ডায় স্বেচ্ছাসেবক যখন জিজ্ঞেস করল, প্রথম মিটিংয়ে ছিলেন, আবার শততম মিটিংয়েও আছেন, কেমন লাগছে? তখন উত্তর দিয়েছি, আমি প্রথম মিটিংয়ে এসেছিলাম পাঠক হিসেবে। শততম মিটিংয়ে এসেছি লেখক হিসেবে। কিশোর আলো অনলাইনে প্রায় প্রতিদিনই আমার লেখা প্রকাশিত হয়। তাই ভালো না লেগে উপায় আছে?

কিআড্ডা কী

শততম কিআড্ডায় ওয়ারফেজের সঙ্গে কিশোর আলো
ছবি: আব্দুল ইলা

কিআ নিয়ে আড্ডা, সংক্ষেপে কিআড্ডা। মাসিক পত্রিকা কিশোর আলোর এই সভার একটা উদ্দেশ্য ছিল। কিশোরদের ভালো লাগা-মন্দ লাগা নিয়ে সরাসরি জানা। মাসিক এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হওয়ার আগের মাস থেকেই শুরু হয়েছিল এই আয়োজন। চলছে এখনো। ঢাকা ও আশপাশের জেলা থেকে পাঠকেরা আসে কিআড্ডায়। কিশোর আলো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা তো থাকেই, সঙ্গে থাকে গল্প, আড্ডা, গান, লেখালেখি, কর্মশালা, ছবি আঁকা, কুইজসহ নানা আয়োজন।

এখন কিশোর আলোর আড্ডার ধরন অনেকটাই বদলেছে। এখন আর আগের মতো মেঝেতে বসে আড্ডা দেওয়া হয় না। এখন আমরা গোল টেবিলের চারপাশ ঘিরে বসি। সবার সামনে মাইক্রোফোন থাকে। এবারের সভায় প্রথম এসেছে, এমন বেশ কয়েকজন ছিল। জাহিন নামে একটি ছেলে জিজ্ঞেস করল, আপনারা না আগে মেঝেতে বসে আড্ডা দিতেন? উত্তর দিল আরেক জাহিন। কিআড্ডার এখনকার উপস্থাপক (যে নিজেও একসময় পাঠক হিসেবে আসত কিআড্ডায়)। সে বলল, আগে আমাদের পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে যেত, পা ব্যথা করত, এখন আর করে না। আমরা চেয়ারে বসে আরামে গল্প করতে পারি। কিআ সম্পাদক আনিসুল হক প্রায় প্রতিটি আড্ডাতেই উপস্থিত থাকেন। এবারও ছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে কোথা থেকে এসেছ? কিশোর আলোর পাঠক জুনাইনা রুহী ইসলাম। কটিয়াদী গভর্নমেন্ট পাইলট মডেল হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী। সে দাঁড়িয়ে বলল, সে এসেছে কিশোরগঞ্জ থেকে। দেড় বছর ধরে আয়োজক দলের অংশ হিসেবে কিআড্ডায় থাকি। প্রতিটি আড্ডায় এমন ঘটনাগুলো দেখে চমকে যাই। কেউ কিশোরগঞ্জ থেকে চলে আসতে পারে! কিআ সম্পাদক মজা করতে ভুললেন না, কিশোর আলোর মিটিংয়ে তো কিশোরগঞ্জ থেকেই আসতে হবে!

১ থেকে ১০০ পর্যন্ত আড্ডার কত গল্প, কত স্মৃতি জমা হয়ে আছে কিআর ক্যামেরায়!

শততম কিআড্ডায় কী ছিল

জাভেদ হুসেন
ছবি: আব্দুল ইলা

শততম আড্ডাটা ছিল বিশেষ। সাধারণত প্রতি কিআড্ডায় অতিথি হিসেবে ব্যান্ড আসে একটি। এই আড্ডায় ব্যান্ড এসেছে দুটি! তার আগে বলি, ব্যান্ড আসার আগে কী হলো। সবার সামনে এলেন লেখক, অনুবাদক জাভেদ হুসেন। ১৩টি ভাষা নিজে নিজে শিখেছেন তিনি, যাঁর আছে অসংখ্য বই। ভাষা নিয়ে কথা শুরু করলেন তিনি। নিজের চেষ্টায় এতগুলো ভাষা শিখেছেন এই লেখক। তিনি কিআ পাঠকদের বললেন, ‘হাজার বছর আগে পাথরে খোদাই করে যে কথাটা লেখা হয়েছিল, সেটি আমরা আজও জানতে পারছি ভাষার মাধ্যমে। ভাষার লিখিত রূপ না থাকলে আবার আমাদের নতুন করে পুরোনো জ্ঞান আবিষ্কার করতে হতো।’

এরপর পাঠকের সামনে হাজির হলেন কিশোর আলোতে নিয়মিত আঁকা শিল্পী এস এম রাকিব। ছোটখাটো একটা ওয়ার্কশপ নিয়ে ফেললেন তিনি। খুব অল্প সময়ে শেখালেন কিছু বেসিক ব্লক বা শেপ। এগুলো অনুসরণ করেই নাকি আঁকা যায় যেকোনো কিছু।

কিআড্ডায় বাঁ থেকে সহকারী সম্পাদক আদনান মুকিত ও আর্টিস্ট এম এম রাকিব
ছবি: আব্দুল ইলা

এরপর এল চমক। হোয়াইট বোর্ডে মার্কার দিয়ে যখন এসব আঁকিবুঁকি চলছিল, বোর্ডের পেছনে এসে তখন একে একে বসেছেন শেখ মনিরুল আলম টিপু, পলাশ নূর ও শামস মনসুর। তাঁরা বিখ্যাত ব্যান্ড ওয়ারফেজের সদস্য। তাঁদের সাক্ষাৎকার নিল কিআর শিশু-কিশোর পাঠকেরা। ধেয়ে এল একের পর এক প্রশ্ন। কোনো প্রশ্ন মজার, কোনোটা গভীর চিন্তা করে করা, আবার কোনোটা ‘পাগলা ফ্যানের’ মনের কথা।

শততম কিআড্ডায় ওয়ারফেজ
ছবি: আব্দুল ইলা

ওয়ারফেজের আড্ডা শেষ হতে না হতেই সভায় এলেন মেঘদল ব্যান্ডের সদস্য শিবু কুমার শীল। কিআ পাঠকেরা আবার শুরু করল প্রশ্ন। শিবু কুমার শীল এক প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘এখন আমরা বিচিত্র এক সময় পার করছি। এখন কিছু একটা ভাইরাল হয়ে গেলেও যাকে নিয়ে বা যা নিয়ে ভাইরাল হচ্ছে, তার কোনো খবর থাকে না। কোন কনটেন্ট যে কখন ভাইরাল হবে, তা কেউ জানে না।’ এভাবে অনেক আলাপ, ‘হাওয়া’ গান গাওয়া, আবার আলাপ আবার গান, এভাবে সন্ধ্যা হয়ে এল। বলা যায়, সময় বয়ে গেল। শততম সভায় সেভয় আইস্ক্রিমের সৌজন্যে কাটা হলো আইসক্রিম কেক।

শততম কিআড্ডায় মেঘদল ব্যান্ডের সদস্য শিবু কুমার শীল
ছবি: আব্দুল ইলা

সবাই মিলে আইসক্রিম খেতে খেতে চলে কিআর সাবেক সহকারী সম্পাদক ও কিআড্ডার সঞ্চালক পাভেল মহিতুল আলমের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে আড্ডা। প্রতি সভার মতো এবারও ছিল কিআ কুইজ এবং বিজয়ীদের জন্য আকর্ষণীয় গিফট। পুরো মিটিং সঞ্চালনা করেন কিআর সহযোগী সম্পাদক আদনান মুকিত এবং স্বেচ্ছাসেবক জাহিন যাঈমাহ্ কবির। সবশেষে সেঞ্চুরি মিটিংয়ের ইতি টানা হলো নিউজিল্যান্ড ডেইরির পক্ষ থেকে মজার চিপসের মধ্য দিয়ে। কিআর পাঠকেরা হইচই করতে করতে বাড়ি ফিরল। আবার এক মাসের অপেক্ষা, পরের মাসের তৃতীয় শনিবারেই আবার সবাই হাজির হয়ে যাবে কিআড্ডার ১০১তম আয়োজনে। সবাইকে নিয়েই একসময় কিআড্ডা পৌঁছে যাবে ডাবল সেঞ্চুরিতে।