বিজ্ঞানের প্রেক্ষাপটে জ্যোতির্বিদ, মহাকাশবিজ্ঞানী বা নভোচারী হওয়া বেশ চ্যালেঞ্জিং। বাংলাদেশি হিসেবে ব্যাপারটা কষ্টসাধ্য হলেও অসম্ভব নয়। আমাদের নিজস্ব কোনো মহাকাশযান বা মহাকাশ স্টেশন নেই। মার্কিন বা রুশ নাগরিক সহজেই নভোচারী হতে পারেন। যেসব দেশের নিজস্ব মহাকাশযান আছে, তারাও কিন্তু সেই পথে এগোচ্ছে। অনেকে ব্যক্তিগত অর্থে মহাকাশে পাড়ি জমাচ্ছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের হয়ে মহাকাশে পা রাখাটা তেমন একটা অসম্ভব কিছু নয়।
এখন পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বসেই যে কেউ হয়ে উঠতে পারে জ্যোতির্বিদ। বাংলাদেশ থেকে কেউ যদি উচ্চমাধ্যমিকের পর পদার্থবিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং, রসায়ন কিংবা গণিতে স্নাতক করে, তারপর স্নাতকোত্তর পর্যায়ে মূল বিষয় হিসেবে জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে, সে কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানী হওয়ার প্রথম পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। এই পর্যায়ে তাকে জ্যোতির্বিজ্ঞান বা পদার্থবিজ্ঞানের যেকোনো ক্ষেত্রে পিএইচডির জন্য আবেদন করতে হবে। গোটা পিএইচডি শেষ করতে চার থেকে ছয় বছর লাগে। পিএইচডির শেষে পোস্ট ডক্টরাল হিসেবে তুমি দেশে-বিদেশে জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করতে পারবে। তবে নাসায় কাজ করার সুযোগ পাওয়া একটু কঠিন। সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের যেকোনো শাখায় পড়াশোনা করেই আবেদন করা যেতে পারে। তবে বিষয়টিতে অবশ্যই বেশ দক্ষ, অভিজ্ঞ হতে হবে। অনেকেই ১৫-২০ বার আবেদনের পর নাসার বিভিন্ন গবেষণাগারে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে। এ ছাড়া কেউ চাইলে পোস্ট ডক্টরালের পাশাপাশি নিজের জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণা দল গঠন করতে পারে। খুব ভালো কিছু গবেষণা দেখাতে পারলে একপর্যায়ে বিভিন্ন জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠানই তাদের কাজ করতে ডাকবে।
জ্যোতির্বিদ হওয়ার বিষয়টি অনেকটা মন দিয়ে পড়াশোনা করার মতোই। যদি পদার্থবিজ্ঞানী, রসায়নবিদ অথবা জীববিজ্ঞানী হতে চাও, অবশ্যই সে বিষয়ে খুব ভালো দখল থাকতে হবে তোমার। পাঠ্যপুস্তকের নিয়মিত পড়াশোনাও বেশ গুরুত্বের সঙ্গে করতে হবে। কারণ, আমাদের সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে কাজে লাগে। আমাদের অনেক শিক্ষার্থীই স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যায় শেষে বিদেশের বিভিন্ন জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্রে কাজ করছে। আর বিজ্ঞানের পাশাপাশি অবশ্যই ইংরেজি ভাষাচর্চাকেও প্রাধান্য দিতে হবে। অনেক সময় গবেষকদের গবেষণাপত্র দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে একমাত্র ইংরেজি ভাষায় ভালো দখল না থাকার কারণে। এ ছাড়া তোমরা নিজেদের পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজেক্ট করতে পারো। হতে পারে খুব সাধারণ। হয়তো জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঙ্গে সরাসরি যোগসূত্র নেই সেই প্রজেক্টের। তবু তেমন কিছু করতে হবে। ধরো, তুমি হয়তো সারা বছর ধরে কয়েকবার বিভিন্ন সময়ে তোমার এলাকার একেক অঞ্চলের বায়ুদূষণের মাত্রা মেপে দেখতে পারো। সেটার একটা তথ্যবহুল তালিকাও তুমি একাই বানিয়ে ফেলতে পারো। এটা হয়তো খুব বেশি ফলপ্রসূ কিছু হবে না। তবে এই সামান্য প্রজেক্টের কাজ তোমাকে হাতে-কলমে বিজ্ঞানচর্চা শেখাবে, যা পরবর্তী সময়ে তুমি যেকোনো গবেষণাগারে কাজ করতে চাওয়ার জন্য আবেদন করলে তোমার পরীক্ষার ফলাফলের চেয়েও বেশি সুবিধা দেবে তোমাকে। তাই বলে কিন্তু পড়াশোনায় কোনো রকম ফাঁকি দেওয়া চলবে না।
আমাদের দেশে এখনো জ্যোতির্বিজ্ঞানে পিএইচডি দেওয়ার বিষয়টি চালু হয়নি। আশা করি অচিরেই এটি করা হবে। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা বাইরে পিএইচডি ও পোস্ট ডক্টরালে খুব ভালো করছে। আর একটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। তুমি যে দেশেই থাকো না কেন, যদি নিজের কাজটা ভালোভাবে করো, তাহলে যেকোনো বড় ধরনের গবেষণাতেই অংশ নিতে পারবে।
ঢাকা কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে রাশিয়ায় চলে যাই আমি। মস্কো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি পদার্থবিজ্ঞানে। তবে আমার মূল বিষয় ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান। সেখানেই স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সক্রিয় গ্যালাক্সিগুলোর নানা রকম বিষয় নিয়ে গবেষণার সুযোগ পাই আমি। এরপর চলে যাই আমেরিকায়। গামা-রে জ্যোতির্বিদ্যায় সম্পন্ন করি আমার পিএইচডি। পিএইচডি শেষে পোস্ট ডক্টরাল হিসেবে নাসায় গামা-রের বিক্ষেপণ নিয়ে দুই বছর গবেষণার সুযোগ পাই। মূলত পৃথিবীর কক্ষপথে বসানো কৃত্রিম উপগ্রহগুলোতে যেসব গামা-রে ধরা পড়ে, সেগুলোকে বিশ্লেষণ করা, তাদের উত্স খুঁজে বের করার চেষ্টাই ছিল আমার কাজ। এরপর কর্মসূত্রে আমি যাই ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে গামা-রে শনাক্ত করতে পারে এমন যন্ত্র নিয়ে গবেষণা করেছিলাম। পুরো শনাক্তকারী যন্ত্রটির নকশা বানানো, সফটওয়্যার বানানোসহ সামগ্রিক বিষয় নিয়েই আমাকে কাজ করতে হয়েছিল।
সাধারণত গবেষণা পর্যায়ে জ্যোতির্বিদ হিসেবে তিন ধরনের কাজ রয়েছে। প্রথমটি হলো এক্সপেরিমেন্টালিস্ট বা পরীক্ষক। যে মূলত গোটা পরীক্ষাটা পরিচালনা করবে। সে ক্ষেত্রে কোনো নক্ষত্রকে অনুসরণ করা, নিয়মিত পরীক্ষার জন্য টেলিস্কোপ নির্বাচন করা, নক্ষত্রের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা তার কাজ। এর পরের ধাপে কাজ করে ডেটা অ্যানালাইসিস্ট বা তথ্য বিশ্লেষক। পরীক্ষক পরীক্ষা শেষে যেসব তথ্য পাবে, সেগুলোকে একসঙ্গে করে নানা রকম ফলাফল সাজানো, সেগুলোর হ্রাস-বৃদ্ধি, সামগ্রিক ফলাফল বানানোর কাজটি করেন তিনি। আর শেষ ধাপে কাজ করেন তাত্ত্বিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনি মূল তত্ত্বের সঙ্গে পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফলের মিল-অমিল বিশ্লেষণ করে গোটা গবেষণার ফলাফল নির্ধারণ করেন। কিংবা সঠিকভাবে আবার পরীক্ষাটি পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন।
আর জ্যোতির্বিদ হয়ে ওঠার জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রবল ইচ্ছাশক্তি। জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে তোমাকে এমনভাবে আলোড়িত হতে হবে, যেন বাইরের আর কোনো কাজ নিয়ে ভাবার অবকাশ না থাকে। তোমার ভেতরের প্রবল ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে খুঁজতে হবে এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব সত্য। ধীরে ধীরে খোলা চোখেই আকাশের তারা চেনা শিখতে হবে। তাদের অবস্থান, নাম ও নানা রকম তথ্য সম্পর্কে জানতে হবে। কোনো নির্দিষ্ট তারাকে নিয়মিত অনুসরণ করতে হবে। জানতে হবে তার নানা রকম অবস্থান। আর তার সঙ্গেই প্রয়োজন পড়বে পদার্থবিজ্ঞানকে ভেতর থেকে বোঝা। সেটা কোনো ভাষায় নয়। পুরোটাই পদার্থবিজ্ঞানের ভেতরের শক্তিকে অনুভব করতে হবে। সব মিলিয়েই ভবিষ্যতে তুমিও হয়ে উঠতে পারো একজন জ্যোতির্বিদ।