মঞ্চে বসে আছেন রিফাত বিন সাত্তার, বাংলাদেশের তৃতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার। মঞ্চের সামনেই টেবিল নিয়ে বসে আছে চারজন খুদে দাবাড়ু। সামনে বোর্ড সাজানো। রিফাত একসঙ্গেই খেলবেন চারজনের সঙ্গে। খেলাটা সোজাই হওয়ার কথা, এমন সহজ প্রতিপক্ষের সঙ্গে তো দিব্যি জিতে যাবেন একজন গ্র্যান্ডমাস্টার। বাস্তবে কিন্তু ততটা সহজ ছিল না। কারণ, রিফাত বিন সাত্তারকে খেলতে হলো বোর্ডের দিকে একবারও না তাকিয়ে। যাকে ইংরেজিতে বলে ব্লাইন্ডফোল্ড। খেলার ফলাফল? সে কথায় পরে আসছি। কারণ, ঠিক পাশেই মঞ্চস্থ হচ্ছিল আরেক ঘটনা। সেদিকে ঘুরে আসা যাক।
টেবিল দিয়ে ঘিরে বর্গাকৃতির একটা স্থাপনা বানানো হয়েছে। আমরা বলতে পারি দাবার মাঠ। মাঠের চারদিকে ৫০টা দাবার বোর্ড নিয়ে বসে আছে ৫০ জন দাবাড়ু। মাঠের মধ্যে আছেন গ্র্যান্ডমাস্টার আবদুল্লাহ আল রাকিব ও এনামুল হোসেন রাজীব এবং ফিদেমাস্টার তৈয়বুর রহমান। গ্র্যান্ডমাস্টার রাকিব ও রাজীব খেলবেন একসঙ্গে ২০ জনের সঙ্গে। তৈয়বুর রহমান খেলবেন ১০ জনের সঙ্গে।
রিফাত বিন সাত্তারের গেমগুলো দেখে আসি। খেলা শুরু হয়েছে। তিনি একে একে সব কটি বোর্ডে চাল দিচ্ছেন। তিনি মুখে বলে দিচ্ছেন কোন চাল হবে। তাঁর হয়ে আরেকজন বোর্ডে চালটা দিয়ে দিচ্ছেন। প্রতিপক্ষ চাল দেওয়ার পর আবার জানিয়ে দিচ্ছেন রিফাতকে। তিনি এভাবে খেলছেন চারটা বোর্ডেই। ঝটপট তিনি তিনজনের সঙ্গে জিতে গিয়েছেন। একটা বোর্ডে ছিল রুদ্রনীল দত্ত। রুদ্র অনেকক্ষণ ঠেকিয়ে রেখেছিল হার। তবে ৪১ চালে হারতে হলো রুদ্রকেও।
এদিকে তৈয়বুর রহমান খেলছিলেন খুব দ্রুত। তিনি একজনের সঙ্গে জিতে যান মাত্র ১৩ চাল পরেই। তারপর নিয়মিত বিরতিতে ৩৫ চালের মধ্যে ১০ জনের সঙ্গেই খেলা শেষ করে ফেলেন। কিন্তু ১০টা খেলাই কিন্তু জিততে পারেননি। সবাইকে অবাক করে তাকে হারিয়ে দেয় ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের মহিদুল হক। বাকি নয়টা ম্যাচ অনায়াসেই জিতেছেন বলা যায়।
এনামুল হোসেন রাজীব খেলেন ধীরেসুস্থে। তাই প্রথম ২০টা বোর্ডে খেলা হচ্ছিল ধীরে। তবে সবার বোর্ডের পজিশন দেখে মনে হচ্ছিল জিতে যাবেন সব কটিই। ঘণ্টা দেড়েক হয়ে যাওয়ায় কয়েকজন রাজীবকে ড্র করার প্রস্তাব দিল। তিনিও আনন্দের সঙ্গে ড্র মেনে নিলেন। এভাবে চারটি ম্যাচ ড্র হয়েছিল। তবে আরও অবাক করে দিয়ে বুয়েটের শিক্ষার্থী মাহতাব শাণ জিতে গেল। বাকি ম্যাচগুলো জিতেছিলেন রাজীবই।
আবদুল্লাহ আল রাকিব খেলছিলেন শেষ ২০টা বোর্ডে। এই বোর্ডগুলোতে উল্লেখ করার মতো ঘটনা নেই। সবাইকে তিনি প্রায় হারিয়েই দিয়েছিলেন। একজন ড্র করতে চাইলে তিনি মেনে নেন। বাকিগুলো জিতেছেন অনায়াসেই।
খেলা শেষে রিফাত বিন সাত্তারের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল কেমন লাগল। তিনি বললেন, তিনি খুবই আনন্দ পেয়েছেন। না দেখে খেলায় অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ থাকে। খেলা জয়ের আগে এই চ্যালেঞ্জ জিততে হয়।
রাজীব, রাকিব এবং তৈয়বুরও জানালেন তাঁদের ভালো লাগার কথা। খেলাগুলো উপভোগ করা সহস্রাধিক শিক্ষার্থীকে জানালেন তাঁরা কীভাবে দাবাড়ু হয়েছেন সে কথা। ছোটবেলায় দাবা খেললে যে বুদ্ধির বিকাশ ভালো হয়, সে কথা তো সবাই জানে। তবে দাবায়ও শেখার আছে অনেক কিছু। তাই ভালো দাবাড়ু হতে চাইলে পড়তে হবে অনেক।
মজার এই আয়োজন করা হয়েছিল ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো গণিত উত্সব ২০১৮-এর ঢাকা আঞ্চলিক পর্বে। এই পর্বে অংশ নিয়েছিল তিন হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। দাবা খেলায় অংশ নিতে পেরেছে মাত্র ৫৪ জন। অন্যরা চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে এই চমত্কার ঘটনার সাক্ষী হচ্ছিল। অনেকের আফসোস ছিল একজন গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে খেলার সুযোগ না পাওয়ায়। তাই গণিত অলিম্পিয়াডের সমন্বয়ক বায়েজিদ ভূঁইয়া জানালেন ভবিষ্যতে আবারও করা হবে এমন আয়োজন। শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে যেহেতু দাবার চর্চা বিশেষভাবে সহায়ক, তাই সারা দেশে একটি দাবা অলিম্পিয়াডই আয়োজন করা হবে। শুরু হয়ে গেছে সে প্রস্তুতি।
তুমিও খেলতে চাও গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে? সে সুযোগ আসতে পারে অচিরেই। তবে রিফাত বিন সাত্তারের সঙ্গে অনেকক্ষণ লড়ে যাওয়া রুদ্রের মতো চাইলে তুমিও কিন্তু স্বপ্ন দেখতে পারো একদিন নিজেই গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার।