প্রতিবছর বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ আসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটি ম্যারাথনে অংশগ্রহণ করার জন্য। গত তিন বছর এই ম্যারাথনে মানুষের পাশাপাশি অংশ নিচ্ছে একটি পাতিহাঁস। হাঁসটির নাম রিংকেল ফাইভ স্টার। এক জোড়া বিশেষ লাল জুতো পরে শুধু ম্যারাথনেই দৌড়ায়নি রিংকেল, সঙ্গে জিতে নিয়েছে মেডেল। ২০২১ সালে এই ম্যারাথনে প্রথমবার অংশ নিয়ে সবার মন জয় করে নিয়েছিল সে। এরপর রাতারাতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে ওঠে রিংকেল। কিন্তু হাঁস হিসেবে যার পুকুরে সাঁতরে বেড়ানোর কথা, সে ম্যারাথনে দৌড়াচ্ছে কেন?
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকেন জাস্টিন উড আর জয়েস কাং নামের দুজন সার্কাস জাগলার। কয়েক বছর আগে হঠাৎ একদিন ছয়টি আমেরিকান পেকিন প্রজাতির হাঁসের ডিম কিনে বাড়িতে নিয়ে আসেন তাঁরা। তারপর দুইজনে মিলে ডিমগুলো থেকে হাঁসের ছানা ফোটানোর চেষ্টা করেন। ছয়টি ডিম থেকে মাত্র একটি ছানা ফোটাতে পেরেছিল জাস্টিন-জয়েস জুটি। ছানাটির নাম রাখা হয় রিংকেল ফাইভ স্টার। কিন্তু হাঁস পালনে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় জাস্টিন আর জয়েস ছেলে হাঁস রিংকেলকে মেয়ে ভেবে বসেছিলেন। এরপর তাঁরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারলেও এখনো সবাই রিংকেলকে মেয়ে হিসেবে সম্বোধন করে।
২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ডিম ফুটে বের হয় রিংকেল। এরপর থেকেই হাঁসের ছানাটি মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকছে। শুরুর দিকে রিংকেল সারাক্ষণ জাস্টিন আর জয়েসের পিছে পিছে থাকত। এটা দেখে একসময় জাস্টিন আর জয়েস সার্কাসে তাঁদের জাগলিং পারফরম্যান্সে রিংকেলের প্যারেড যুক্ত করার কথাও ভাবেন। রানারস ওয়ার্ল্ড নামের একটি অনলাইন পোর্টালের নেওয়া সাক্ষাৎকারে জয়েস বলেন, ‘আমরা লক্ষ করেছিলাম, খুব ভালো হাঁটতে আর দৌড়াতে পারে রিংকেল। ওর এই বিশেষত্ব তুলে ধরার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় খুঁজছিলাম আমরা।’
সার্কাসের জাগলার হওয়ার পাশাপাশি জাস্টিন উড একজন কন্টেন্ট ক্রিয়েটর। নিজের জাগলিংয়ের ভিডিও অনেক বছর ধরেই ইউটিউব এবং টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড করে আসছেন তিনি। কিন্ত করোনার সময় সার্কাসের লাইভ শো বন্ধ হয়ে যায়। তাই শুধু অনলাইন ভিডিও তৈরিতে মনোযোগী হয়ে পড়েন জাস্টিন। কিন্তু তাঁর জাগলিংয়ের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুব একটা সাড়া ফেলতে পারেনি। ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরে তিনি রিংকেলের প্রথম ভিডিও আপলোড করেন টিকটকে। ভিডিওটিতে দেখা যায়, ছোট্ট একটি হলুদ রঙের হাঁসের ছানা কম্বলের ওপর দৌড়ে বেড়াচ্ছে। এর পর থেকে রিংকেলকে নিয়ে জাস্টিন আর জয়েস টিকটকে নিয়মিত ভিডিও আপলোড করা শুরু করেন। এসব ভিডিওতে কখনো রিংকেল নিউইয়র্ক সিটির চারপাশে জগিং করেছে, আবার কখনো ঘোরাঘুরি করেছে অন্ধকার করিডোরে।
রিংকেল যুক্তরাষ্টের ব্রনক্স অঞ্চলে অনুষ্ঠিত প্রায় দুই কিলোমিটারের একটি হ্যালোইন প্যারেডে হেঁটেছে। যার কারণে ইন্টারনেটে ‘দ্য রানিং ডাক’ উপাধি পায় এই হাঁস। রিংকেলের হাঁটার অসামান্য ক্ষমতা দেখে একটি নতুন চ্যালেঞ্জ খুঁজে বের করেন জাস্টিন আর জয়েস। এই চ্যালেঞ্জ ছিল প্রায় ৪২ কিলোমিটারের নিউইয়র্ক সিটি ম্যারাথন। পাকা রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটা একটি হাঁসের জন্য নিরাপদ নয়। রুক্ষ রাস্তায় অনেকক্ষণ হাঁটলে কিংবা দৌড়ালে হাঁসের বাম্বলফুট নামের একটি ইনফেকশন হওয়ার শঙ্কা থাকে। জাস্টিন-জয়েস জুটি রিংকেলের দেখভালের ব্যাপারে অনেক সচেতন। তাই দুজন মিলে রিংকেলের জন্য বানিয়ে ফেলেন বিশেষ একজোড়া জুতো। এক ধরনের ওয়াটারপ্রুফ উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয় রিংকেলের লাল জুতা জোড়া। হাঁসের পায়ের মাপে বানানো ছোট্ট কিউট এই জুতোজোড়া কারও চোখ এড়াতে পারেনি।
২০২১ সালের ৭ নভেম্বরে নিজের রানিং শু পরে ব্রুকলিনের লাফায়েট স্ট্রিটে হাজির হয় রিংকেল ফাইভ স্টার। নিউইয়র্ক সিটি ম্যারাথনে সাধারণত প্রচুর মানুষের ভিড় থাকে। রিংকেলের দৌড়ানোর জন্য তুলনামূলক খালি জায়গা খুঁজে বের করেন জাস্টিন আর জয়েস। নিউইয়র্ক সিটি ম্যারাথনের ৫০তম আসরে প্রায় এক কিলোমিটার দৌড়াতে পেরেছিল দুর্দান্ত এই হাঁসটি।
দৌড়ের সময় রিংকেলের দেখা হয় বেশ কিছু ভক্তের সঙ্গে। অনেকে নিজেদের মুঠোফোন বের করে ছুটে আসে রিংকেলের সঙ্গে ছবি তোলার জন্য। এত মানুষকে একসঙ্গে দেখে ঘাবড়ে যায়নি দ্য রানিং ডাক। ম্যারাথন শেষ করতে না পারলেও, এই বিস্ময়কর হাঁসটির দৌড়ানোর একটি ভিডিও টিকটকে প্রায় ৮০ লাখ ভিউ পেয়েছিল। ছোট্ট একটি হাঁসের ম্যারাথনে দৌড়ানোর গল্প প্রত্যক্ষ–পরোক্ষভাবে অনেকের মনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে!
২০২২ সালে আবারও নিউইয়র্ক সিটি ম্যারাথনে যোগদান করে রিংকেল। সেবার হাঁস হিসেবে ১৮ মিনিট দৌড়ানোর একটি রেকর্ড তৈরি করে দ্য রানিং ডাক। এই রেকর্ডের সঙ্গে পুরস্কার হিসেবে একটি মেডেল জিতে নিয়েছিল রিংকেল। এই বছর ৫ নভেম্বরে নিউইয়র্ক সিটি ম্যারাথনের ৫২তম আসর বসেছিল। ২০২৩ সালে তৃতীয়বারের মতো ম্যারাথনে দৌড়াতে এসে রিংকেল আরও একটি মেডেল জিতেছে। আজ ইউটিউবে ‘রিংকেল দ্য ডাক’ লিখলেই দেখা যায় লাল জুতো পরা একটি সাদা হাঁসের টুকটুক হাঁটার ভিডিও।