গ্রাফিতি শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের একটি শিপইয়ার্ডের পরিদর্শক হিসেবে কাজ করতেন জেমস জে কিলরয়। একটি জাহাজ বানানোর পর সেটার সবকিছু পরিদর্শন করতেন তিনি। পরিদর্শন শেষে জাহাজটায় চক দিয়ে দাগ দিয়ে দিতেন। এতে বোঝা যেত জাহাজটি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। জাহাজের প্রতিটি অংশের পর্যবেক্ষণ করা হলে মজুরি পেতেন নির্মাণশ্রমিকেরা। তাই বাড়তি মজুরি পাওয়ার আশায় পরিদর্শকের দেওয়া দাগগুলো মুছে দিতেন তাঁরা। এই সমস্যায় পড়তেন কিলরয়। সমাধানের জন্য তিনি ঠিক করলেন, এখন থেকে চকের বদলে ব্যবহার করবেন রং, যা সহজে মুছে ফেলা যাবে না। যে–ই ভাবা সে–ই কাজ। প্রতিবার জাহাজ পরিদর্শনের পর কিলরয় জাহাজের গায়ে গোটা অক্ষরে লিখে দিতেন ‘কিলরয় ওয়াজ হেয়ার’ অর্থাৎ কিলরয় এখানেই ছিলেন। তাঁর এই কাজ যে একসময় বিশ্ববাসীর মনে আতঙ্ক ছড়াবে, সেই ব্যাপারে তখনো তাঁর বিন্দুমাত্র ধারণাও ছিল না। জাহাজ পানিতে নামার আগে রং করা হতো। ফলে মুছে যেত কিলরয়ের দেওয়া চিহ্ন। কিন্তু বিপত্তি বাধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। তখন জরুরি অবস্থায় জাহাজ পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। কিলরয়ের চিহ্নসহই অনেক জাহাজ বন্দর ছেড়ে যেতে শুরু করে।
এ ধরনের চিহ্ন দেখে জার্মান প্রেসিডেন্ট এডলফ হিটলার মনে করেন, এটা নিশ্চয়ই আমেরিকানদের কোনো দুর্ধর্ষ স্পাইয়ের কোড। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। এই সুযোগটা কাজে লাগাল কিছু শিল্পী। জার্মানির অলিগলির দেয়ালে দেখা গেল অদ্ভুত এক ছবি—লম্বা নাকের টাকমাথার এক লোক দেয়ালের পেছন থেকে উঁকি দিচ্ছে। তার সঙ্গেই কিলরয়ের সেই চিহ্ন দুটি মিলে এক দেয়াললিখন। জার্মান মুলুকে এই নিয়ে বেশ হইচই পড়ে গেল। কিলরয়ের সাধারণ একটা পরিদর্শন চিহ্ন ভিন্ন দেশে গিয়ে হয়ে গেল প্রতিবাদের এক ভাষা।
প্রতিবাদী গ্রাফিতির উত্থান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হলেও প্রাগৈতিহাসিক সময়েও এর দেখা মেলে। গ্রাফিতি পরিচিতি পায় প্রাচীন রোমে। আর ‘গ্রাফিতি’ শব্দটিও ইতালিয়ান ‘গ্রাফিতো’ থেকে আগত। যার অর্থ ‘খচিত’। গ্রাফিতিতে প্রায়ই প্রেম, রাজনৈতিক স্লোগান এবং সময়ে জনপ্রিয় উদ্ধৃতি প্রকাশ করত তারা। তখনকার সময়ে এটিকে জনতা ভালো চোখে দেখত না। গ্রাফিতি শব্দটি দিয়ে শিলালিপি, চিত্র অঙ্কন এবং এ ধরনের শিল্প বোঝালেও এখন গ্রাফিতিকে প্রতিবাদের একধরনের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। দেয়াল বা রাস্তায় আঁকা কোনো চিত্র বা লেখা, যার ধরন খুব সহজ, সাধারণ কোনো কিছু, কিন্তু পেছনের বোধটা থাকবে খুব গভীর। সহজ ভাষায় এটাই গ্রাফিতি। কোনো পৃষ্ঠপোষকের মাধ্যমে দেয়ালের শোভাবর্ধনের জন্য যেসব চিত্র আঁকা হয়ে থাকে, সেগুলোকে অবশ্য গ্রাফিতি বলা যায় না।
আধুনিক গ্রাফিতির প্রচলন শুরু হয় ষাটের দশকের শুরুর দিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া থেকে। ডেরিল ম্যাকরে বা কর্নব্রেডকে বলা হয় আধুনিক গ্রাফিতির জনক। প্রেমিকার মনোযোগ আকর্ষণের জন্য তাঁর নাম শহরের দেয়ালে দেয়ালে লিখে যেতে শুরু করেন কর্নব্রেড। তখনই আরও কিছু গ্রাফিতি ট্যাগের উত্থান হয়। সেই সূত্র ধরে সত্তরের দশকে নিউইয়র্কে বাড়ির দেয়াল, ট্রেন, বাসের গায়ে বিভিন্ন দলের নাম লিখে জনতার মনোযোগ আকর্ষণ করতে শুরু করেন সেসব দলের সদস্যরা। গোপনে করা এসব দেয়াললিখনে অনেকে তখন শৈল্পিক ছোঁয়া দিতে শুরু করে। শুধু লেখাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। সঙ্গে সমসাময়িক কোনো চিত্রও তুলে ধরতে শুরু করে। শুধু নিউইয়র্কেই নয়, পরবর্তী দশকগুলোয় গ্রাফিতি একটি বৈশ্বিক শিল্প হয়ে দাঁড়ায়। বড় শহরগুলোয় অধিকার আদায়, প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হয় গ্রাফিতিকে। একটা সামাজিক বার্তা মানুষের কাছে সহজে পৌঁছে দিতে বিভিন্ন স্থাপনা, রাস্তায় গোপনে গ্রাফিতি এঁকে দিয়ে যেতে শুরু করে কে বা কারা। এসব শিল্পীর আসল পরিচয় কেউই কখনো জানতে পারত না। কখনো দেয়ালে কোনো নাম ব্যবহার করলেও সেটা হতো ছদ্মনাম। কিন্তু এগুলো প্রবল ছাপ ফেলত মানুষের মনে।
যেহেতু শিল্পীরা গোপনে শহরের বিভিন্ন দেয়ালে ছবি আঁকতেন, সেখানে কোনো পৃষ্ঠপোষক থাকত না। তাই অনেক সময় দেখা যেত, কোনো এক ব্যক্তির বাড়ির সদ্য রং করা দেয়ালে তাঁর সম্মতি ছাড়াই কেউ একজন কিছু একটা লিখে বা এঁকে দিয়ে গেছেন। তা দেখে বেশ চটে যেতেন বাড়ির মালিকেরা। আবার অনেক সময় বাস বা ট্রেনের গায়ে লিখতে গিয়ে সেগুলোর কাচের জানালাও রঙে ঢেকে দিতেন। তাই অনেকে একে ভ্যান্ডালিজম বা ধ্বংসাত্মক শিল্পও বলে থাকে। অনেক জায়গায় রাজনৈতিক বিভিন্ন দল গ্রাফিতিকে ভ্যান্ডালিজমের অংশ দাবি করে মুছে দিত বিভিন্ন স্লোগান, চিত্র।
বাংলাদেশে দেয়ালচিত্র বা মুর্যাল আজকাল ব্যাপক জনপ্রিয় হলেও গ্রাফিতি এখনো স্বাভাবিক নয়। ঢাকার বিভিন্ন দেয়ালে ২০১৭ সালের পর থেকে হুটহাট ‘সুবোধ’ নামের যেসব চিত্র দেখা যেত, তা যে আদতে গ্রাফিতি, সেটি বুঝতে আমাদের অনেকেরই বেশ সময় লেগেছে। রাতের আঁধারে গোপনে কেউ একজন পলায়নরত উষ্কখুষ্ক চুলের এক যুবক, হাতে একটি খাঁচায় বন্দী সূর্য এঁকে ঢাকাবাসীকে জানান দিত ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না’। এই শিল্পের পেছনের শিল্পীর নাম জানা যায়নি, পাওয়া যায়নি কোনো পৃষ্ঠপোষকও। এমনকি কোনো দেয়ালের শোভাবর্ধনের জন্যও এই চিত্র আঁকা হয়নি। তবু সাধারণ একটা যুবকের অবয়ব, সঙ্গে একটি বা দুটি বাক্য মানুষকে ভাবাচ্ছে। এগুলোকে নিঃসন্দেহে গ্রাফিতি বলা যায়। সেই থেকে গ্রাফিতি বাংলাদেশিদের কাছে জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজেও বিভিন্ন ধরনের গ্রাফিতি দেখা যায় আজকাল। গ্রাফিতি করার মজার ব্যাপার হচ্ছে, এতে ছবি আঁকার কোনো ব্যাকরণ প্রয়োজন হয় না। গ্রাফিতি এখন এমন একটি শিল্প হয়ে উঠেছে, যার নিয়ম সহজ, কিন্তু ভাবনা গভীর।