নিজেকে কেন সুড়সুড়ি দেওয়া যায় না

ধরো, কোনো একটা মাঠে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে বসে বসে গল্প করছ। হঠাৎ তোমার কোনো বন্ধু তোমার পায়ের তলায় আঙুলের হালকা ছোঁয়া দিল। আচমকা তুমি লাফিয়ে উঠলে। পায়ের পাতায় কেমন যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। একে বলে সুড়সুড়ি বা কাতুকুতু। অনেকের সুড়সুড়ির পরিমাণ থাকে বেশি, শুধু হাত তুললেই সরে যায় বা হেসে ফেলে। তবে কারও কারও আবার মোটেই সুড়সুড়ি নেই। সারা দিন ওদের সামনে হাত নাড়ালেও হাসবে না। কিন্তু তুমি নিজে নিজেকে সুড়সুড়ি দেওয়ার চেষ্টা করো, দেখবে কোনো অনুভূতি হচ্ছে না। কেন এমন হয়? নিজেকে কেন সুড়সুড়ি দেওয়া যায় না?

এর সঙ্গে মস্তিষ্কের সম্পর্ক আছে। আসলে পুরো বিষয়টা মস্তিষ্কের ওপর নির্ভর করে। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির নিউরোসায়েন্টিস্ট ডেভিড ইগলম্যান জানিয়েছেন, ‘মস্তিষ্ক সব সময় ভবিষ্যদ্বাণী করার চেষ্টা করে। আমাদের মস্তিষ্ক শুধু প্রতিক্রিয়া দেখায় না, বরং আগেভাগেই বোঝার চেষ্টা করে, সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে। সেই অনুসারে আমাদের শরীর প্রতিক্রিয়া দেখায়।’

এবার ডেভিড ইগলম্যানের কথাটা একটু বোঝার চেষ্টা করি। আমরা যখন কোনো কাজ করি, তখন মস্তিষ্কের প্রাইমারি মোটর কর্টেক্স আমাদের শরীরকে নড়াচড়ার নির্দেশ দেয়। সেই নির্দেশনা অনুসারে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ কাজ করে। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ‘ইফেরেন্স কপি’।

ধরো, তুমি একটা কলম ধরতে চাও। শুরুতে মস্তিষ্ক হাতকে নির্দেশ দেবে কলমটা ধরার জন্য। একই সঙ্গে অনুভূতি ও দৃষ্টিশক্তিকেও নির্দেশ দেবে যাতে ওই অঙ্গগুলোও কাজটা করার জন্য প্রস্তুত থাকে। খেয়াল করলে দেখবে, কোনো জিনিস ধরার সময় আমাদের চোখ সেই বস্তুর ওপরই থাকে। এ কাজ করায় মস্তিষ্ক। এমনকি যখন তুমি হাঁটো, তখন তোমার পায়ের শব্দ তেমন শুনতে পাও না। কিন্তু তোমার পেছনে যদি অন্য কেউ হেঁটে আসে, তাহলে তা টের পাও। কারণ, নিজের হাঁটার বিষয়টা মস্তিষ্ক জানে। যখন অন্য কেউ হেঁটে আসে, তখন তা মস্তিষ্কের কাছে নতুন মনে হয়। মস্তিষ্ক তখন আমাদের সতর্ক করে দেয়। এ জন্য অন্যের হাঁটার শব্দ আমরা ঠিকই শুনতে পাই।

নিজেকে সুড়সুড়ি দেওয়ার ব্যাপারটাও অনেকটা এ রকম। তুমি যখন নিজেকে সুড়সুড়ি দিতে যাও, তখন মস্তিষ্ক জানে যে তোমার হাতটা কোথায় যাচ্ছে। তাই শরীরকে আলাদাভাবে সতর্ক করার প্রয়োজন হয় না। এ জন্য সুড়সুড়িও লাগে না।

ধরো, তুমি তোমার হাতটা নিজের পেটের কাছে নিয়ে গেলে সুড়সুড়ি দেওয়ার জন্য। তোমার মস্তিষ্ক কিন্তু জানে যে হাতটা পেটের দিকে যাচ্ছে। মস্তিষ্ক এটাও জানে যে হাতটা ওখানে গিয়ে কী করবে। ফলে অনুভূতি কমে যায়। আরও সহজভাবে বললে, মস্তিষ্ক পেটকে বলে দেয়, হাত তোমার দিকে যাচ্ছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই। কিন্তু হঠাৎ যদি কেউ সুড়সুড়ি দেয়, সেটা মস্তিষ্ক আগে থেকে অনুমান করতে পারে না। ফলে তখন তোমার মস্তিষ্ক প্রস্তুত থাকে না। এ জন্য অনুভূতিটা হয় প্রবল এবং যখন মস্তিষ্ক বুঝে ফেলে যে অন্যের হাত তোমার পেটের দিকে যাচ্ছে, তখন হাসি আসে।

ইগলম্যান এ ব্যাপারে বলেন, ‘সুড়সুড়ির জন্য দরকার চমক। কেউ যখন তোমাকে সুড়সুড়ি দেয়, তখন তুমি জানো না সে কীভাবে কী করবে। কিন্তু নিজের বেলায় মস্তিষ্ক আগেই ব্যাপারটা অনুমান করতে পারে। ফলে নিজেকে নিজে সুড়সুড়ি দিলে হাসি আসে না।’

তবে ব্যতিক্রমও আছে। সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্ক ঠিকঠাক অনুমান করতে পারে না। তাই তারা নিজেদের সুড়সুড়ি দিতে পারে। আসলে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিষ্ক সব সময় বুঝতে পারে না যে হাত কী করতে যাচ্ছে। তখন নিজের হাতের জন্যই প্রস্তুত থাকে না মস্তিষ্ক। তাই সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত মানুষেরা নিজেকে মাঝেমধ্যে সুড়সুড়ি দিতে পারে।

তবে শুরুতে একটা কথা বলেছিলাম, কিছু মানুষকে সুড়সুড়ি দিয়েও হাসানো যায় না। এটা কেন ঘটে। এর কয়েকটা কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, সব মানুষের মস্তিষ্ক সমানভাবে কাজ করে না। কিছু মানুষের মস্তিষ্ক স্পর্শের প্রতি কম সংবেদনশীল। তাই তারা সুড়সুড়ি টের পায় না। দ্বিতীয়ত, মানুষের শরীরের সব জায়গার সংবেদনশীলতা একরকম নয়। কারও ক্ষেত্রে গলা বা পায়ের তালু খুব সংবেদনশীল, আবার কারও হয়তো পেট। তৃতীয়ত, অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার বা অন্যান্য স্নায়বিক পার্থক্যের ক্ষেত্রে স্পর্শের প্রতিক্রিয়া সাধারণের চেয়ে ভিন্ন হতে পারে। এসব কারণে অনেকের সুড়সুড়ি থাকে না। আসলে সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই মস্তিষ্কের কারসাজি।

সূত্র: লাইভ সায়েন্স

আরও পড়ুন