আজকের এ লেখায় দেখব এমন ১০টি দেশ, যেখানে পাহাড়-পর্বতের রাজত্ব। মেঘের কোলে ঘেরা এই দেশগুলো অপূর্ব সৌন্দর্য, ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার জন্য পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। জেনে নেওয়া যাক, দেশের আয়তনের তুলনায় পাহাড়ি অঞ্চল সবচেয়ে বেশি, এমন ১০টি দেশের কথা।
পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে থাকা কিছু দেশ নিজেদের অসাধারণ ভূপ্রকৃতির জন্য সব স্থান থেকে বেশ আলাদা। এমনই এক অসাধারণ দেশ হলো ভুটান। পূর্ব হিমালয়ের কোলে অবস্থিত এই দেশটি ‘ল্যান্ড অফ দ্য থান্ডার ড্রাগন’ নামেও পরিচিত। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পাহাড়ি অঞ্চল ভুটানে। কারণ, এর ৯৮ দশমিক ৮ শতাংশ পাহাড়ে আবৃত। তিব্বত ও ভারতের মধ্যে স্থলবেষ্টিত এই দেশ অপূর্ব সৌন্দর্য, ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও রহস্যময় পরিবেশের জন্য পর্যটকদের কাছে খুব জনপ্রিয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৬০ ফুট উচ্চতায় শুরু হয়ে ২৩ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ভিন্ন ভিন্ন আবহাওয়া ও দৃশ্য উপহার দেয়। পাহাড়ি দেশ হলেও জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে ভুটান অনন্য। ঘন জঙ্গল, উঁচু পর্বতমালা ও নদীর তীরে বসবাসকারী অসংখ্য প্রাণী ভুটানের পরিবেশকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলেছে। সোনালি লাঙ্গুর (একপ্রকার বানর), বেঙ্গল টাইগার, হিমালয় ব্ল্যাক বিয়ার ও লাল পান্ডার মতো বিরল প্রাণীরা এখানে নিরাপদে বাস করে।
মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত তাজিকিস্তান ৯৩ শতাংশ পাহাড়ে আচ্ছাদিত। আয়তনের দিক থেকে এটি এই অঞ্চলের সবচেয়ে ছোট স্থলবেষ্টিত দেশ হলেও এর ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু ও সংস্কৃতি বৈচিত্র্যপূর্ণ। তাজিকিস্তানের পর্বতমালা বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পর্বতমালাগুলোর মধ্যে একটি। পামির পর্বতমালা দেশের বেশির ভাগ অংশজুড়ে বিস্তৃত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এটি প্রায় ৯ হাজার আটশ ফুট ওপরে অবস্থিত। বৈচিত্র্যময় জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থল তাজিকিস্তান। পাহাড়ি এলাকার পাশাপাশি এর উত্তরাংশে ফারগানা উপত্যকা অবস্থিত, যেখানে পাহাড়ের উচ্চতা কিছুটা কম, রয়েছে উর্বর জমিও। দেশের দক্ষিণ অংশের উপত্যকায় নদী বহমান, যা কৃষিকাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাজিকিস্তানের জলবায়ুও বৈচিত্র্যপূর্ণ। উঁচু পাহাড়ি এলাকায় মহাদেশীয় জলবায়ু বিরাজমান, যেখানে শীতকালে হিমশীতল এবং গ্রীষ্মকালে মনোরম আবহাওয়া থাকে।
মধ্য এশিয়ার মাঝে অবস্থিত কিরগিজস্তান। এটিও তাজিকিস্তানের মতো একটি স্থলবেষ্টিত দেশ। চীন, কাজাখস্তান ও উজবেকিস্তানের সঙ্গে সীমানা ভাগ করে নেওয়া এ দেশটি তার অসাধারণ ভূপ্রকৃতি, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও আতিথেয়তার জন্য বিখ্যাত। কিরগিজস্তান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সবচেয়ে ওপরে থাকা দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষস্থানে অবস্থান করে। দেশের ৯০ শতাংশ জায়গা পাহাড়ে আচ্ছাদিত এবং এর গড় উচ্চতা তিন হাজার মিটারের বেশি। এই উচ্চতার কারণে দেশের নদীগুলো প্রবাহিত হয়ে সমুদ্র বা মহাসাগরে পড়ে না। কিরগিজস্তানকে প্রায়ই ‘মধ্য এশিয়ার সুইজারল্যান্ড’ বলা হয়। এর কারণ হলো, দেশটির অপূর্ব পাহাড়ি দৃশ্য, শান্ত হ্রদ, বরফে ঢাকা চূড়া ও বিস্তৃত উপত্যকা। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত কিরগিজস্তান প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য একটি স্বর্গ। কিরগিজস্তান প্রাকৃতিক সম্পদেও সমৃদ্ধ। দেশটিতে বিরল ধাতু ও সোনার বড় ভান্ডার রয়েছে।
লেসোথো দক্ষিণ আফ্রিকার একটি ছোট্ট স্থলবেষ্টিত দেশ। এটি আশ্চর্যজনক পর্বতমালার জন্য পরিচিত। এখানে রয়েছে ড্রাকেন্সবার্গ পর্বতমালা, যা দেশের পূর্ব সীমান্ত বরাবর বিস্তৃত। এই দেশটির চারপাশে দক্ষিণ আফ্রিকার সীমান্ত। এর অসাধারণ ভূপ্রকৃতি, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও অসাধারণ জীববৈচিত্র্য দেশটিকে ভ্রমণকারীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে পরিচিত করেছে। লেসোথোর প্রায় ৯০ শতাংশ ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কমপক্ষে ৫ হাজার ৯০০ ফুট ওপরে অবস্থিত। উচ্চতার কারণে লেসোথোতে অনন্য জীববৈচিত্র্য রয়েছে। দেশটিতে ৩০০টির বেশি পাখির প্রজাতি এবং ৬০টি স্তন্যপায়ী প্রজাতি রয়েছে। লেসোথোতে বেশ কয়েকটি জাতীয় উদ্যান ও সংরক্ষিত এলাকা রয়েছে, যা এই জীবজগৎ রক্ষা করে। এটি একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যসম্পন্ন দেশ। দেশের জনসংখ্যার বেশির ভাগ অংশ বাসোথো জাতির, যারা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, সংগীত ও নৃত্যের জন্য পরিচিত।
ইউরোপের তিনটি পাহাড়ি দেশের তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে মন্টেনিগ্রো। দক্ষিণ ইউরোপের বলকান অঞ্চলে অবস্থিত এ দেশটি তার অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও উষ্ণ আতিথেয়তার জন্য পরিচিত। মন্টেনিগ্রোর প্রায় ৮৯ শতাংশ অঞ্চল পাহাড়ে আচ্ছাদিত। মন্টেনিগ্রোর পর্বতগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬ হাজার ৬০০ ফুট ওপরে। মন্টেনিগ্রোকে জীববৈচিত্র্যের একটি ‘হটস্পট’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দেশটিতে হাজার হাজার প্রজাতির পোকামাকড় এবং হাজার হাজার গাছপালাসহ সমগ্র ইউরোপের সবচেয়ে বেশি বন্য প্রাণীর বসবাস রয়েছে।
স্থলবেষ্টিত দেশগুলোর তালিকায় আরেকটি উল্লেখযোগ্য দেশ হলো আর্মেনিয়া। পশ্চিম এশিয়ার দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে অবস্থিত আর্মেনিয়া তার সমৃদ্ধ ইতিহাস, অনন্য সংস্কৃতি ও অসাধারণ ভূপ্রকৃতির জন্য পরিচিত। দেশটির পশ্চিমে তুর্কি পর্বতমালা অবস্থিত, যা আর্মেনিয়ার সর্বোচ্চ বিন্দু আরাগাটস পর্বতের আবাসস্থল। আর্মেনিয়া প্রায় ৮৫ শতাংশ পাহাড়ে আচ্ছাদিত। আর্মেনিয়ার মাঝ দিয়ে বেশ কয়েকটি নদী প্রবাহিত হয়। দেশটির সর্বোচ্চ বিন্দু আরাগাটস পর্বত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩ হাজার ৪১৯ ফুট ওপরে অবস্থিত। এর বিপরীতে সর্বনিম্ন বিন্দু, ডেবেড নদীর তীর ১ হাজার ২৮০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত।
উত্তর মেসিডোনিয়া দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের একটি পর্বতময় দেশ। দেশের প্রায় এক–তৃতীয়াংশ পর্বতমালায় আচ্ছাদিত। সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হলো কোরাব পর্বত, যা ৯ হাজার ৬৮ ফুট উঁচু। বুলগেরিয়ার সীমান্তের কাছে দেশের উত্তর-পূর্ব অংশে অবস্থিত কসোভো-বেলাসিকা পর্বতমালা। এটি হাইকিং ও স্কিইংয়ের জন্য জনপ্রিয়। উত্তর মেসিডোনিয়া সমৃদ্ধ ইতিহাস, অনন্য সংস্কৃতি ও মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যের জন্য পর্যটকদের কাছে পরিচিত।
ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, লিচেনস্টাইন ও অস্ট্রিয়ার সীমান্তবর্তী সুইজারল্যান্ড মধ্য ইউরোপে অবস্থিত একটি স্থলবেষ্টিত দেশ। এটি একটি পার্বত্য দেশ, যার ৮৩ শতাংশ ভূমি পাহাড়ি ভূখণ্ডে আবৃত। ইউরোপের সর্বোচ্চ ও বৃহত্তম পর্বতমালা আল্পস দেশটির মধ্য দিয়ে বিস্তৃত। সুইজারল্যান্ডে নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু রয়েছে। গ্রীষ্মকালে হালকা এবং শীতকালে তীব্র শীত থাকে, তুষারপাত হয় নিয়মিত। সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে বিখ্যাত পর্বত হলো ম্যাটারহর্ন। এর চূড়া ১৪ হাজার ৬৯২ ফুট উঁচু। এর আইকনিক পিরামিড আকৃতি এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর পর্বতের মধ্যে একটির মর্যাদা দিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ লেবানন। আনুষ্ঠানিক নাম লেবানন প্রজাতন্ত্র। ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এই দেশ ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত। লেবাননের পশ্চিমে সমুদ্রের চমৎকার দৃশ্য এবং পূর্বে আছে পর্বতমালার তুষারাবৃত চূড়া। এই বিপরীতমুখী ভূপ্রকৃতি দেশটিকে অনন্য ও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। লেবাননের পূর্ব অংশে লেবানন পর্বতমালা অবস্থিত, যা দেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট লেবাননের আবাসস্থল। মাউন্ট লেবানন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০ হাজার ১৩১ ফুট ওপরে অবস্থিত। এই পর্বতমালা দেশের জলবায়ু ও প্রাকৃতিক পরিবেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লেবাননের একটি ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু রয়েছে, যার গ্রীষ্মকাল গরম ও শুষ্ক, আর শীতকাল হালকা শীত ও স্যাঁতসেঁতে।
নেপাল শুধু বিশ্বের সবচেয়ে পাহাড়ি দেশগুলোর মধ্যে একটি নয়; বরং এটি অনন্য ভূপ্রকৃতি ও এর সঙ্গে যুক্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্যও পরিচিত। নেপাল হিমালয় পর্বতমালার দক্ষিণ ঢালে অবস্থিত। এই বিশাল পর্বতমালা দেশের বেশির ভাগ অংশজুড়ে বিস্তৃত এবং গড় উচ্চতা আট হাজার মিটারের বেশি। নেপাল বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট এভারেস্টের আবাসস্থল। এই বিশাল শৃঙ্গটি পর্বতারোহী ও অভিযাত্রীদের জন্য একটি জনপ্রিয় জায়গা। নেপাল ছোট দেশ হলেও বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের আবাসস্থল। দেশটিতে বিশ্বের ৪ শতাংশ স্তন্যপায়ী প্রজাতি এবং প্রায় ৯ শতাংশ পাখির প্রজাতি রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে পাহাড়ি দেশগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে নেপাল অভিযাত্রী, প্রকৃতিপ্রেমী ও সাংস্কৃতিক অনুসন্ধিৎসুদের জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্য।
সূত্র: দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া, এমএসএন ডটকম