হাজার বছর ধরে গাছ কীভাবে বাঁচে
টিকে থাকার জন্য প্রাণীরা নির্ভর করে উদ্ভিদের ওপর। ধারণা করা হয়, পৃথিবীতে ৩ লাখ ৫০ হাজারের বেশি প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। বৃক্ষ, গুল্ম, বিরুৎ—এই তিন ধরনের উদ্ভিদ রয়েছে পৃথিবীতে। পৃথিবীর বৃহত্তম জীবন্ত গাছ ‘জেনারেল শেরম্যান’ থেকে শুরু করে ক্ষুদ্রতম উদ্ভিদ ‘বামন উইলো’—সবই এই বিশাল উদ্ভিদ জগতের অন্তর্ভুক্ত। সাধারণত পোকা আক্রমণ না করলে কোনো গাছকে মরতে দেখা যায় না। বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদের আয়ু সাধারণত ৫০০ থেকে ৮০০ বছরের মতো হয়। তবে পৃথিবীতে কিছু কিংবদন্তি গাছ হাজার বছর ধরে টিকে আছে। সে তুলনায় মানুষের গড় আয়ু মাত্র ৬৮ থেকে ৭৪ বছরের মতো। প্রশ্ন হলো, কীভাবে কোনো গাছ এত বছর ধরে বাঁচে?
বীজ থেকে গাছ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। ধীরে ধীরে মাটিতে শেকড় গেঁথে, ডালপালা ছড়িয়ে গাছ বড় হয়। বাধা না পেলে শতাব্দী ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। ঋতুর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাতা ঝরে, নতুন পাতা গজায়। কত ঝড়, বন্যা, খরার কবলে পড়ে, তার ঠিক নেই। তবু গাছ টিকে থাকে। প্রকৃতিতে লড়াই করে টিকিয়ে রাখে নিজেকে।
শরৎকালে মেইডেনহেয়ার গাছের পাতা আকর্ষণীয় হলুদ বর্ণ ধারণ করে। একেকটি মেইডেনহেয়ার গাছ বেঁচে থাকে এক হাজার বছরের বেশি সময়। মেইডেনহেয়ার গাছ জীবনকালে কিছু জৈব রাসায়নিক তৈরি করে।
গাছের দীর্ঘ জীবনের রহস্য লুকিয়ে আছে এদের জৈবিক গঠনে। বিষয়টি জানা গেছে একদল বিজ্ঞানীর গবেষণায়। গাছের হাজার বছর বেঁচে থাকার রহস্য ভেদ করেছেন তাঁরা। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের একদল বিজ্ঞানী এ গবেষণা করেছেন। এ–সংক্রান্ত একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে ‘প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা’ (পিএনএএস) জার্নালে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেসের জার্নাল এটি। এই বিজ্ঞানী দল গবেষণাপত্রে দাবি করেছেন যে তাঁরা গাছের দীর্ঘায়ুর রহস্য ভেদ করেছেন। সে জন্য তাঁরা গবেষণা করেছেন বিশ্বের প্রাগৈতিহাসিক গাছগুলো নিয়ে।
বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণার কাজ চালান মেইডেনহেয়ার নামে পরিচিত গিংকগো বাইলোবা গাছে। শরৎকালে মেইডেনহেয়ার গাছের পাতা আকর্ষণীয় হলুদ বর্ণ ধারণ করে। একেকটি মেইডেনহেয়ার গাছ বেঁচে থাকে এক হাজার বছরের বেশি সময়। মেইডেনহেয়ার গাছ জীবনকালে কিছু জৈব রাসায়নিক তৈরি করে, যা একে রোগ, পোকামাকড় ও বৈরী পরিবেশ যেমন খরা মোকাবিলায় সাহায্য করে। এ ছাড়া গাছটির বিশেষ জিনও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।
গবেষণার সময় গিংকগো বাইলোবা গাছের ১৫ থেকে ৬৬৭ বছর বয়সী কয়েকটি গাছের কোষ, বাকল, পাতা ও বীজ বিশ্লেষণ করেছেন বিজ্ঞানীরা।
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জোট আইইউসিএনের লাল তালিকায় রয়েছে এই উদ্ভিদ প্রজাতি। বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা প্রাণী ও উদ্ভিদকে তালিকাভুক্ত করে আইইউসিএন। উদ্ভিদজগতের মেইডেনহেয়ার গাছ গিংকগোলস বর্গের সদস্য। এই বর্গের বাকি প্রজাতিগুলো এরই মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গিংকগো বাইলোবা গাছটির আদি নিবাস চীনে। এখনো দেশটির ঝেজিয়াং এলাকার সিতিয়ানমু পার্বত্য এলাকায় গিংকগো বাইলোবার দেখা পাওয়া যায়। বন উজাড়সহ নানা কারণে বিশ্বের আর কোনো বনে এই গাছ অবশিষ্ট নেই বলে দাবি করেছেন বিজ্ঞানীরা। তবে বিভিন্ন উদ্যান ও বাগানে দেখা মেলে এই গাছের।
গিংকগো বাইলোবা প্রজাতির আদিতম যে সদস্যের জীবাশ্মের খোঁজ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা, তা ডাইনোসর যুগের। গবেষণাপত্রে বলা হয়, গবেষণার সময় গিংকগো বাইলোবা গাছের ১৫ থেকে ৬৬৭ বছর বয়সী কয়েকটি গাছের কোষ, বাকল, পাতা ও বীজ বিশ্লেষণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা দেখেছেন, খরা বা কোনো জীবাণুর আক্রমণ হলে শরীরে যে চাপ তৈরি হয়, তা মোকাবিলায় তরুণ ও বয়স্ক সব গাছের শরীরেই একই ধরনের রাসায়নিক তৈরি হয়। এর মধ্যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল ও বিশেষ উদ্ভিজ্জ হরমোন উল্লেখযোগ্য। অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করে কোষের ক্ষতি রোধ করে। গাছের নিজস্ব অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট তৈরি করার ক্ষমতা থাকে। আবার কিছু অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট তারা মাটি থেকেও শোষণ করে।
দীর্ঘায়ু গাছের বেঁচে থাকার পেছনে ভাজক টিস্যু বা মেরিস্টেমেটিক কোষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মেরিস্টেমেটিক কোষ হলো উদ্ভিদের অবিভাজিত কোষ, যা বিভিন্ন ধরনের স্থায়ী কোষে রূপান্তরিত হতে পারে।
অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল পদার্থ গাছের স্বাস্থ্য রক্ষা ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এগুলো গাছকে সংক্রমণ, রোগ, পোকামাকড়ের আক্রমণ ও আঘাত থেকে রক্ষা করে। খরার সময় গাছ অ্যাবসিসিক অ্যাসিড তৈরি করে, যা পানিশূন্যতা কমাতে সাহায্য করে। জীবাণুর আক্রমণের সময় গাছ স্যালিসাইলিক অ্যাসিড তৈরি করে, যা জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে।
পৃথিবীতে মেইডেনহেয়ার বা গিংকগো বাইলোবা গাছ ছাড়া আরও অনেক প্রজাতির হাজার বছর বেঁচে থাকা বৃক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো গ্রেট বেসিন ব্রিসেলকোন পাইন। ধারণা করা হয়, পৃথিবীতে এখন যেসব গাছপালা ও পশুপাখি বেঁচে আছে, তার মধ্যে গ্রেট বেসিন ব্রিসেলকোন পাইনই সবচেয়ে প্রাচীন গাছ। সারা বিশ্বে সবচেয়ে বিখ্যাত ব্রিসেলকোন পাইনগাছটির নাম ‘মেথুসেলাহ’। মনে করা হয়, গাছটির বয়স ৪ হাজার ৮০০ বছরের বেশি। অর্থাৎ মিসরীয়রা যখন পিরামিড নির্মাণ করছিল, তখন এটি একটি চারা গাছ ছিল। এর দীর্ঘ জীবনের পেছনে দারুণ একটি বিষয় হচ্ছে, গাছটি অত্যন্ত বিরূপ ও বৈরী পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। এসব গাছের জন্মও হয় সে রকম পরিবেশে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, নেভাদা ও ইউটার উঁচু উঁচু পর্বতে এ গাছ জন্মায়। এদের জীবনচক্র খুব ধীর।
দীর্ঘায়ু গাছের বেঁচে থাকার পেছনে ভাজক টিস্যু বা মেরিস্টেমেটিক কোষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মেরিস্টেমেটিক কোষ হলো উদ্ভিদের অবিভাজিত কোষ, যা বিভিন্ন ধরনের স্থায়ী কোষে রূপান্তরিত হতে পারে। এগুলো উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আফ্রিকান বেওবাব বৃক্ষ দুই হাজার বছরের বেশি সময় ধরে বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু সম্প্রতি এই প্রজাতির অনেক প্রাচীন গাছ মারা গেছে। বিজ্ঞানীরা এর জন্য জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী করেন। এই গাছ নানা কাজে ব্যবহৃত করা হয়।
আরেকটি দীর্ঘায়ু গাছ ক্রিপ্টোমেরিয়া। এটি জাপানি সেডার নামেও পরিচিত। হালকা শীতল আবহাওয়ার মধ্যে এই গাছ জন্মায়। জাপানের এ রকম কিছু কিছু গাছের বয়স ৬৫০ বছরের বেশি বলে ধারণা করা হয়। এ ছাড়া চিলি ও আর্জেন্টিনার দক্ষিণাঞ্চলে আলেরসা গাছ খুঁজে পাওয়া যায় যা প্যাটাগোনিয়ান সাইপ্রেস নামেও পরিচিত। বিজ্ঞানীরা বলেন, এই গাছে এমন এক ধরনের রস আছে, যা এদের পচনের হাত থেকে রক্ষা করে। এমনকি পানিতে থাকলেও এই গাছ পচে না।
আফ্রিকান বেওবাব বৃক্ষ দুই হাজার বছরের বেশি সময় ধরে বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু সম্প্রতি এই প্রজাতির অনেক প্রাচীন গাছ মারা গেছে। বিজ্ঞানীরা এর জন্য জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী করেন। এই গাছ নানা কাজে ব্যবহৃত করা হয়। এটি এমন ফল দেয় যাতে কমলার চেয়ে বেশি ভিটামিন সি পাওয়া যায়। এর শেকড় থেকে লাল রং তৈরি করা যায়। বাকল দিয়ে ঝুড়ি ও দড়ির মতো নানা রকম জিনিস তৈরি করা যায়।
গাছের শক্তিশালী কাণ্ড ও শিকড় আবহাওয়ার চরম অবস্থা সহ্য করতে সাহায্য করে। যেমন বৃক্ষের মূল মাটিকে শক্তভাবে ধরে থাকে এবং শরীরের ওজন বহন করে। কাণ্ড ও ডালপালা শক্তিশালী ও নমনীয় হয়ে ঝড় বা বৃষ্টির মতো অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। গাছের কোষ দীর্ঘজীবী হয়। এই কোষ ক্ষত সারাতে সাহায্য করে। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবসৃষ্ট নানা কারণে প্রাগৈতিহাসিক এসব গাছ ঝুঁকির মুখে পড়েছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে খুব দ্রুতই এসব গাছ হারিয়ে যাবে।