দুর্দান্ত সাহসী ছেলে সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস। শৈশবেই যার দুষ্টুমির নানারকম বহিঃপ্রকাশ ঘটে। দুঃসাহসিক সব কাজ করতে পারেন নিমেষেই। বাজি ধরে ২০ ফুট লম্বা মইয়ের মাথায় ওঠা, বিশাল গাছের মগডাল থেকে পাখির ছানা চুরি করা কিংবা একটি লাঠি দিয়েই হিংস্র বন্য শূকর মারা—এসব ছিল সুরেশের কাছে খুব সাধারণ কাজ। বিকেলে তাঁর বয়সী আর পাঁচটা কিশোরের মতো মাঠে দৌড়াদৌড়ি না করে সুরেশ শরীরচর্চা করতেন। এসব চক্করে পড়ালেখায় মন বসত না। ফলে সুরেশের বাবা গিরিশচন্দ্র প্রচণ্ড খেপে গেলেন। তিনি ছেলের এই বাউন্ডুলেপনা মানতে পারছিলেন না কিছুতেই। স্বভাবতই তিনি ছেলেকে বকাঝকা করতেন। বাবার গালমন্দ সুরেশের সহ্য হলো না। বাড়ি আসা বন্ধ করে দিলেন। এক খ্রিষ্টান বন্ধুর বাসায় রাতে থাকতে শুরু করলেন। সেই বন্ধুর কাছে থাকতে থাকতে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন খ্রিষ্টধর্মের প্রতি। তারপর হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান হলেন সুরেশ। গিরিশচন্দ্র তাই রেগে ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করলেন।
সুরেশ এরপর মন দিলেন পড়াশোনায়। কিছুদিনের মধ্যেই বিলাতে যাওয়ার সুযোগ আসে। বিএসএন কোম্পানির জাহাজে সহকারী স্টুয়ার্টের চাকরি নিয়ে বিলাতে পাড়ি জমান তিনি। বয়স তখন ১৭। লন্ডনে গিয়ে পত্রিকা বিক্রি থেকে শুরু করে ফেরির কাজ পর্যন্ত করেছেন।
আশ্রয়হীন সুরেশের নতুন ঠিকানা হলো কলেজের অধ্যক্ষ আটসন সাহেবের কাছে। সেখানে থেকেই তিনি নানান জায়গায় চাকরির খোঁজ করেন। অনেক দিন পরে একটি হোটেলের ভ্রমণ গাইড হিসেবে চাকরি পেলেন। জাহাজ থেকে সাহেব-মেমদের লাগেজ ও স্যুটকেস বয়ে আনা তাঁর কাজ। গাইড হিসেবে ঘুরিয়ে দেখাতে হতো তাঁদের শহরের নানান জায়গা। ভ্রমণকারীদের কাছে শুনতেন দেশ–বিদেশের নানান গল্প। এভাবে সাহেবদের সঙ্গে ভাব হয়ে যায় সুরেশের। মনের মধ্যে বিলাতে যাওয়ার সুপ্ত ইচ্ছা আরও প্রবল হয়; কিন্তু বিলাতে যাওয়ার মতো অর্থ তাঁর ছিল না। তাই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বেরিয়ে পড়েন রেঙ্গুনের উদ্দেশে। বয়স তখন তাঁর মাত্র ১৩।
রেঙ্গুনে পৌঁছে হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজেও কোনো উপায় করতে পারলেন না। একদিন নৌকাভ্রমণ শেষে ফেরার পথে পড়লেন মগ ডাকাতের কবলে। তুমুল লড়াই হলো সুরেশের সঙ্গে। একা দুই ডাকাতের সঙ্গে লড়াই করা চাট্টিখানি কথা নয়; কিন্তু সুরেশকে কাবু করাও সহজ না। হঠাৎ একদল বরযাত্রী সেখানে চলে আসায় সেবার কোনো রকমে প্রাণটা রক্ষা পেল। রেঙ্গুন ছেড়ে মাদ্রাজে চলে গেলেন তিনি।
নতুন জায়াগায় ভাষা নিয়ে পড়লেন দারুণ বিপাকে। নিজেও কিছু বুঝতে পারছেন না আর কাউকে কিছু বোঝাতেও পারছেন না। কী আর করা? আত্মহত্যা করার ভূত চাপল মাথায়। তখন এক ইংরেজ সাহেব তাঁকে বাঁচান। একটা কাজের ব্যবস্থাও করে দেন তিনি। কাজটা হলো, সেই ইংরেজ সাহেবের দুই নাতিকে দেখাশোনা করা। কিছুদিন ওই চাকরি করার পর সেখানেও মন বসল না তাঁর। বাউন্ডুলে জীবন ছাড়া যেন তাঁর ভালোই লাগে না। উপায় না দেখে আবার ফিরে এলেন আটসন সাহেবের কাছে।
সুরেশ এরপর মন দিলেন পড়াশোনায়। কিছুদিনের মধ্যেই বিলাতে যাওয়ার সুযোগ আসে। বিএসএন কোম্পানির জাহাজে সহকারী স্টুয়ার্টের চাকরি নিয়ে বিলাতে পাড়ি জমান। বয়স তখন ১৭। লন্ডনে গিয়ে পত্রিকা বিক্রি থেকে শুরু করে ফেরির কাজ পর্যন্ত করেছেন। পড়াশোনাও চালিয়েছেন একই সময়ে। লন্ডনে গিয়ে বুঝতে পারেন, পড়াশোনা ছাড়া উপায় নেই। হঠাৎ একদিন কেন্ট শহরে একটি সার্কাস পার্টির দেখা মেলে। সার্কাসের পালোয়ান কুস্তিগিরকে নিজের বুদ্ধি ও কৌশল দিয়ে মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে পরাজিত করেন সুরেশ। ফলে সার্কাসের মালিক সুরেশকে সার্কাসে চাকরি দেন। পশুর প্রশিক্ষণ দেওয়া তাঁর কাজ।
সেই সার্কাসের এক জার্মান মেয়েকে পছন্দ হয় সুরেশের; কিন্তু একই শহরে তাঁর বেশি দিন ভালো লাগে না। ফলে সব ছেড়েছুড়ে একদিন চলে যান অন্য সার্কাস দলে। এভাবে এক শহর থেকে আরেক শহরে ঘুরতে ঘুরতে জার্মানিতে গিয়ে পৌঁছান। সেখানে গিয়ে দেখা হয় সেই পছন্দের মেয়েটির সঙ্গে। সে দেখা অবশ্য সুখকর ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে জার্মানি ছেড়ে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে।
১৮৮৫ সালে ওয়েলস নামের এক সাহেবের হিংস্র পশু পালনের দায়িত্ব পান সুরেশ। যুক্তরাষ্ট্রের নানা জায়গায় সেই পশুর খেলা দেখিয়ে তিনি প্রশংসিত হন। সেখান থেকে সার্কাস দলের সঙ্গে প্রথম বাঙালি হিসাবে মেক্সিকোয় এবং সেখান থেকে ব্রাজিলে পাড়ি জমান। ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোয় বসবাস শুরু করেন তিনি। আগের অভিজ্ঞতার গুণে ব্রাজিলের রাজকীয় পশুশালার পরিদর্শক ও রক্ষক হিসেবে যুক্ত হন। সেখানে পরিচয় হয় এক চিকিৎসকের সঙ্গে। চিকিৎসকের মেয়েকে দেখে তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। অবশ্য তা প্রস্তাব পর্যন্তই ছিল। তবে তাঁর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে ২৫ বছর বয়সী সুরেশের। তাঁর কথাতেই ব্রাজিলের সম্রাটের সৈন্য দলে যোগ দেন তিনি। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। অল্প দিনেই নিজের মেধা ও বুদ্ধি দিয়ে সৈন্য দলে ক্যাপ্টেন নিযুক্ত হন তিনি। তার পরই চিকিৎসকের মেয়ের সঙ্গে সুরেশের বিয়ে হয়। পরে সুরেশকে পাঠানো হয় একটি হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে। অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে সার্জেন্ট পদে পদায়ন হয় তাঁর।
১৮৯৩ সালে সুরেশ ব্রাজিলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হন। সে বছরই ব্রাজিলে এক ভয়ানক বিপ্লবের সূচনা হয়। রিও ডি জেনিরোকে ঘিরে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ চলতে থাকে। সুরেশ তখন শহরের স্থলভাগের দায়িত্বে ছিলেন। তার দলে ছিল মাত্র ৫০ জন সৈন্য। এই সামান্য সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ জয় অসম্ভব। পরাজয় নিশ্চিত বুঝে সৈন্যরাও প্রাণ নিয়ে পালানোর চেষ্টা করছেন। সুরেশ তখনো সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন দলকে। বুদ্ধি খাঁটিয়ে শেষ রাতের দিকে শত্রুঘাঁটিতে আঘাত হানেন সুরেশ। তাঁর এই অসীম সাহস ও অসামান্য পারদর্শিতায় যুদ্ধে জয় লাভ করে ব্রাজিল। যুদ্ধে সাহসিকতার পুরস্কারস্বরূপ কর্নেল পদে উন্নীত হন সুরেশ। বাঙালি বাউন্ডুলে সুরেশ হন ব্রাজিলের অন্যতম দুর্গ।
সুরেশচন্দ্র ১৮৬১ সালে নদীয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ব্রাজিলেই ছিলেন। রিও ডি জেনিরো শহরের সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিত ব্যক্তির মর্যাদা ছিল তাঁর। ১৯০৫ সালে সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তাঁর কীর্তির কথা ভারতবর্ষে পৌঁছালে তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। তাকে নিয়ে অনেকে বই লেখা হয়েছে। বনফুলের ছোট গল্প ‘বিশ্বাস মসাই’-তে সুরেশ বিশ্বাসের উল্লেখ আছে। এ ছাড়া সুরেশের ব্রাজিলের জীবনের প্রেক্ষাপটে ময়ুখ চৌধুরী তৈরি করেন কমিকস 'বাংলাদেশের রঙ্গ'। হুর চন্দ্র দত্ত সুরেশকে নিয়ে লিখেছেন ‘সুরেশ বিশ্বাস: তার জীবন ও ভ্রমণ’।