২০২৩ সালের শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ইরানের অধিকারকর্মী নার্গিস মোহাম্মদি। নরওয়েজীয় নোবেল কমিটি ইরানে নারীদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তাঁকে এ পুরস্কার দিয়েছে। নারী-পুরুষ—সবার মানবাধিকার ও স্বাধীনতার জন্য তিনি লড়াই করেছেন। সংগ্রামের জন্য ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। ইরানের সরকার তাঁকে ১৩ বার গ্রেপ্তার করেছে, ৫ বার আদালতে দোষী সাব্যস্ত করেছে। মোট ৩১ বছরের জেল ও ১৫৪টি বেত্রাঘাতের শাস্তি দিয়েছে। নার্গিস মোহাম্মদি এখনো কারাগারে।
২০২২ সালে ইরান বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছিল। সেপ্টেম্বর মাসে কুর্দি তরুণী মাসা আমিনি (২২ বছর) ইরানের ‘নীতি পুলিশের’ হেফাজতে নিহত হন। ‘যথাযথ নিয়ম’ মেনে হিজাব না পরার অভিযোগে মাসাকে তেহরানে আটক করেছিল নীতি পুলিশ। আটকের পর নীতি পুলিশের হেফাজতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে তেহরানের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৬ সেপ্টেম্বর মাসা আমিনির মৃত্যু হয়।
মাসা আমিনির মৃত্যুতে ইরানি শাসকদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক বিক্ষোভ শুরু হয়। সেই বিক্ষোভকে স্মরণ করে এবারের শান্তিতে নোবেল ঘোষণার সময় উচ্চারণ করা হয়—‘নারী-জীবন-স্বাধীনতা’। এটি ছিল ওই বিক্ষোভের স্লোগান। সে সময় কয়েক হাজার ইরানি বর্বরতা ও নারীর প্রতি নিপীড়নের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন। সরকার কঠোর হাতে বিক্ষোভ দমন করে। ৫০০ জনের বেশি বিক্ষোভকারী নিহত হন। অন্তত ২০ হাজার লোককে গ্রেপ্তার করা হয়।
নার্গিস মোহাম্মদি নব্বইয়ের দশকে একজন তরুণ পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে সমতা ও নারী অধিকারের লড়াইয়ে যুক্ত হন। পড়াশোনা শেষ করে প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেন। একই সঙ্গে সংবাদপত্রে কলামিস্ট হিসেবে কাজ করেন। ২০০৩ সালে তিনি তেহরানের ডিফেন্ডারস অব হিউম্যান রাইটস সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত হন। এ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ২০ বছর আগে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী শিরিন এবাদি।
২০১১ সালে নার্গিস মোহাম্মদিকে প্রথমবারের মতো গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কারাবন্দী ও তাঁদের পরিবারকে সহায়তা করার চেষ্টার জন্য তাঁকে অনেক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। দুই বছর পর তিনি জামিনে মুক্তি পান। এরপর শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করেন। তাঁর দাবি ছিল, কাউকেই শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে না। মৃত্যুদণ্ড দেয়, এমন দেশগুলোর মধ্যে ইরান তালিকায় ওপরের দিকে রয়েছে। ২০২২ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ইরানে ৮৬০ জনের বেশি বন্দীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কারণে ২০১৫ সালে নার্গিস মোহাম্মদিকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। কারাগারে আসার পর তিনি ইরানের কারাগারে রাজনৈতিক বন্দী, বিশেষ করে নারীদের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত নির্যাতন ও যৌন সহিংসতার বিরোধিতা করা শুরু করেন।
তেহরানের আলোচিত ইভিন কারাগারের রাজনৈতিক বন্দীদের কাছে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর নেতৃত্বে কারাবন্দীরা বিক্ষোভকারীদের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। কারা কর্তৃপক্ষ এবার নার্গিস মোহাম্মদির ওপরে কঠোর শর্ত আরোপ করে। ফোনে কথা বলা ও দর্শনার্থীদের সামনে যাওয়া নিষিদ্ধ করে।
কারারক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে নার্গিস মোহাম্মদি একটি নিবন্ধ পাচার করতে সক্ষম হন, যা নিউইয়র্ক টাইমস মাসা আমিনি হত্যার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশ করে।
নার্গিস মোহাম্মদি কারাগারে বন্দী আছেন। নোবেল কমিটি আশা করে, ডিসেম্বরে নোবেল পুরস্কার তুলে দেওয়ার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন এবারের শান্তিতে নোবেলজয়ী নারী অধিকারকর্মী নার্গিস মোহাম্মদি। নার্গিস মোহাম্মদির মুক্তির জন্য ইরান সরকারের প্রতি নোবেল কমিটি আহ্বান জানিয়েছে।
সূত্র: নোবেল প্রাইজ ডট অর্গ