ওয়াল্ট ডিজনির দেহ সংরক্ষিত আছে হিমায়িত অবস্থায়— ইন্টারনেট কিংবা বাস্তব দুনিয়ায় এমন একটা কথা প্রচলিত আছে। তুমি ডিজনি ওয়ার্ল্ড, মিকি মাউস অথবা ডিজনি অ্যানিমেশন স্টুডিওর ফ্রোজেন, জুটোপিয়া, রেক-ইট-র৵ালফ, বিগহিরো সিক্স বা লায়ন কিংস–এর মতো মুভির ভক্ত হয়ে থাকলে এ কথা নিশ্চয়ই এত দিনে শুনেছ। কিন্তু আসলেই কি তাই? আসলেই কি ওয়াল্ট ডিজনি তাঁর মৃত্যুর পর দেহ ক্রয়োনক্যালি ফ্রোজেন করে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাতে উন্নত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সহায়তায় একসময় আবার জেগে উঠতে পারেন?
ওয়াল্ট ডিজনিকে ঘিরে কানাঘুষা এখানেই শেষ নয়। বলা হয়ে থাকে, ডিজনির থিমপার্ক ডিজনি ল্যান্ডের পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান রাইডে সত্যিকারের মানুষের মৃতদেহ লুকানো আছে। এ গুজবের অবশ্য কিছুটা সত্যতা আছে। শুরুর দিকে এ রাইডের অনেক চরিত্রের কঙ্কাল ছিল সত্যিকারের মানুষের। সেটা ১৯৬৭ সালের দিককার কথা। কিন্তু এখন সেসব জায়গায় বিভিন্ন প্লাস্টিক বা অন্যান্য উপাদানের তৈরি মডেল বসানো হয়েছে। এই লেখার আলোচ্য বিষয় অবশ্য সেটা নয়। বরং আমরা জানার চেষ্টা করব স্বয়ং ওয়াল্ট ডিজনিকে নিয়ে।
বিংশ শতকের অন্যতম প্রভাবশালী মানুষ ছিলেন ওয়াল্ট ডিজনি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত দ্য ওয়ার্ল্ড ডিজনি কোম্পানি এখন এতটাই বড় যে নতুন করে তার পরিচয় আর দিতে হয় না। ১৯০১ সালের ৫ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে জন্ম নেন তিনি। একাধারে তিনি ছিলেন চলচ্চিত্র প্রযোজক, নির্দেশক, অ্যানিমেটর, ভয়েস আর্টিস্ট ও কাহিনিকার। ১৯৬৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর মাত্র ৬৫ বছর বয়সে ভদ্রলোক মারা যান। এর প্রায় এক দশক পরেই গুজব ছড়িয়ে পড়ে, ওয়াল্ট ডিজনি মারা গেলেও তাঁর মৃতদেহ আছে বহাল তবিয়তে। ক্রোয়োনিক্স প্রযুক্তিতে তিনি নিজের দেহ সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন।
কীভাবে এই গুজব ছড়ায় তা এখনো ঠিকভাবে জানা যায় না। ধারণা করা হয়, ডিজনির ওপর লেখা বায়োগ্রাফি ধরনের দুটি বই থেকে গুজব ছড়ায়। একটি ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত লিওনার্ড মোসলের লেখা ডিজনিস ওয়ার্ল্ড, অন্যটি মার্ক এলিয়টের ওয়াল্ট ডিজনি: হলিউডস ডার্ক প্রিন্স। এটা প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। দুটি বইয়েই প্রচুর ভুল তথ্য আছে। তথ্যসূত্র যাচাই না করেই তা তুলে ধরার অভিযোগ আছে বই দুটির বিরুদ্ধে।
অনুমাননির্ভর অনেক কথাই আছে সেগুলোতে। যেমন মার্ক এলিয়টের বইটির একটা অংশে বলা হয়, ‘ডিজনি নিজের আকাঙ্ক্ষা ও নীতিবোধ থেকে একসময় ক্রয়োজোনিক্স বিজ্ঞানের দিকে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ক্রয়োজনিক্স হলো বয়স্ক বা অসুস্থ ব্যক্তির শরীরকে হিমায়িত করে রাখার পদ্ধতি। এভাবে কোনো মানুষকে হিমায়িত করে রাখা হয়, যাতে পরে তাদের আবার পুনরুজ্জীবিত করে তোলা যায়। ডিজনি সম্ভবত মাঝেমধ্যেই রয়কে তাঁর দেহ হিমায়িত করার ইচ্ছার কথা বলতেন, এই ধারণা তিনি পেয়েছিলেন…তাঁর ভাইয়ের আন্তরিক সম্মতি থেকে।’
কিন্তু এ কথা একদমই সত্য নয়। ডিজনি ক্রয়োনিক্স সম্পর্কে আদৌ জানতেন কি না বা আগ্রহ দেখিয়েছিলেন কি না, তা নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না। ১৯৬৬ সালে ফুসফুসে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। মৃত্যুর পর তাঁকে দাহ করা হয়। অর্থাৎ মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলে সৎকার করা হয়।
তা ছাড়া ১৯৭২ সালে ওয়াল্ট ডিজনির মেয়ে ডায়ান ডিজনি মিলার তাঁর এক লেখায় সরাসরি এ গুজবের গোড়ায় পানি ঢেলে দেন। তিনি লেখেন, ‘আমার বাবা ওয়াল্ট ডিজনি কখনো হিমায়িত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছেন, এটা একেবারেই সত্য নয়। আমার সন্দেহ হয়, বাবা কখনো ক্রয়োনিক্সের কথা শুনেছেন কি না।’
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইট স্নুপ এ গুজবের সত্যতা যাচাই করে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে ১৯৯৫ সালে। তাতে আরও বিস্তারিতভাবে সবকিছু ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আগ্রহী হলে পুরোটা তুমি নিজে পড়ে দেখতে পারো।_Was Walt Disney Frozen? | Snopes.com
ক্রয়োনিক্সের মাধ্যমে দেহ সংরক্ষণের বিষয়টি এখনো পুরোপুরি কার্যকর নয়। এর প্রধান সমস্যা হলো দেহকোষে বরফের কেলাস জমে যায় এবং কোষের কার্যক্ষমতা চিরতরে ধ্বংস করে ফেলে। এখন পর্যন্ত ক্রয়োনিক্স থেকে পুনরুজ্জীবিত করার কোনো উপায় আবিষ্কার করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। তাঁরা মনে করেন, অদূর ভবিষ্যতেও ক্রয়োনিক্স থেকে দেহকে পুনরায় কর্মক্ষম করে তোলার সম্ভাবনা বেশ কম। বরং বর্তমান প্রযুক্তিতে হিমায়িত ব্যক্তির দেহ উষ্ণ করা হলে সেটা অর্ধশক্ত কাদার মতো হয়ে উঠতে পারে।
মৃত মানুষের জন্য সেটা কোনো সম্মানজনক বিষয় নয়। ওয়াল্ট ডিজনির মরদেহ যে উপায়ে সৎকার করা হয়েছে, তাতে সম্মান বেড়েছে বৈ কমেনি, এ কথা বলাই যায়।