১৯৭১ সাল। দেশের অভ্যন্তরে স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়ছিল মুক্তিকামী বাঙালি। অন্যদিকে জীবন বাঁচাতে প্রায় এক কোটি মানুষ আশ্রয় নেয় সীমান্তের ওপারে, ভারতে। সেখানে গড়ে ওঠে শরণার্থী ক্যাম্প। ক্যাম্পগুলোয় খাদ্যের সংকট আর কলেরা রোগে মারা যাচ্ছিল অসংখ্য মানুষ।
এমন খবরে ব্যথিত হন বিশ্ববিখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর। তিনি তখন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায়। শরণার্থীদের দুর্ভোগ লাঘবের পাশাপাশি বাংলাদেশকে নৈতিক সমর্থন জানিয়ে সহায়তার জন্য একটি তহবিল গঠনের কথা ভাবেন তিনি। এ নিয়ে যোগাযোগ করেন তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু বিটলস ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য বিখ্যাত গায়ক জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে।
বিটলস ব্যান্ড তখন ভেঙে গেছে। ফলে হ্যারিসন নিজস্ব গানের জন্য কাজ শুরু করেন। তাঁর অল থিংস মাস্ট পাস অ্যালবামটি তখন ব্যাপক সাড়া ফেলে। ফলে ওই সময় হ্যারিসনকে নিয়ে সারা বিশ্বের তরুণদের মধ্যে দারুণ উন্মাদনা তৈরি হয়।
একাত্তরের জুনে হ্যারিসন রাগা অ্যালবামের জন্য লস অ্যাঞ্জেলেসে কাজ করছিলেন। সে সময় রবিশঙ্কর তাঁকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত নানা দেশের পত্রিকা ও সাময়িকীর সংবাদগুলো পাঠান এবং শরণার্থীদের জন্য একটি কনসার্ট আয়োজনের কথা জানান।
হ্যারিসনের মনে হয়, প্রিয় বন্ধু সাহায্য চেয়েছেন, তাঁর পাশে দাঁড়ানো উচিত। এভাবেই বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে তিনিও জড়িয়ে যান।
কিন্তু জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে রবিশঙ্করের এমন মানবিক উদ্যোগের চিন্তার যোগসূত্রটি আগেই ছিল। সেটি ১৯৭০ সালের কথা। একবার প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় হয় বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে। হ্যারিসন ভারতীয় রাগসংগীতের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। সে সুবাদেই ওই সময় সেতার বাজানো শিখছিলেন রবিশঙ্করের কাছে। তখনই বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য কিছু করার কথা ভাবেন দুজন মিলেই।
বিটলসের নিজস্ব কোম্পানি অ্যাপল রেকর্ডসে রবিশঙ্কর রেকর্ড করেন ‘জয় বাংলা’ আর হ্যারিসন তাঁর ‘বাংলাদেশ’ গানটি। উদ্দেশ্য ছিল গানের বিক্রি ও রয়্যালটি থেকে পাওয়া অর্থ বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য ব্যয় করবেন। কিন্তু এই মানবিক উদ্যোগ চূড়ান্ত হওয়ার আগেই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ।
ফলে মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থীদের সাহায্যে কনসার্ট আয়োজনে প্রস্তাবটি হ্যারিসনের কাছে ছিল বিশেষ কিছু। তিনি বেশ উদ্যোগী হয়ে কনসার্টে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানান বব ডিলান, রিঙ্গো স্টার, বিলি প্রেস্টন, লিওন রাসেল, এরিক ক্ল্যাপটনসহ বিখ্যাত সব রক শিল্পীকে। এগিয়ে আসেন তাঁরাও।
‘হ্যারিসন অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’ দুটি কনসার্টের আয়োজন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশের জন্য—জুলাইয়ের শুরুতেই এমন ছোট্ট একটি বিজ্ঞাপন ছাপা হয় নিউইয়র্ক টাইমস–এর পেছনের পাতায়। ফলে মাত্র ৬ ঘণ্টার মধ্যেই দুটি কনসার্টের ৪০ হাজার টিকিট বিক্রি হয়ে যায়। সাংবাদিকেরাও এ উদ্যোগের নেপথ্যের কারণটি জেনে প্রায় ১২ হাজার ডলার অনুদান দিয়েছিলেন কনসার্ট আয়োজকদের।
আগে কখনো কোনো কনসার্টে একসঙ্গে এত বিখ্যাত সব শিল্পীর সম্মিলন ঘটেনি। ফলে এই কনসার্টকে ঘিরে ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রে তরুণদের মধ্যে তৈরি হয় তুমুল আগ্রহ।
তখন নিক্সনের মার্কিন প্রশাসন ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে। তাই কনসার্ট আয়োজনে তারা যেন বাধার কারণ হয়ে না দাঁড়ায়, সে কারণে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের দুর্গত শিশুদের ত্রাণের কথা তুলে ধরা হয়। এ কনসার্ট থেকে পাওয়া সব অর্থ ইউনিসেফের মাধ্যমে শরণার্থী শিশুদের সাহায্যে পাঠানো হবে বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। এমনকি কনসার্টের পোস্টারেও ব্যবহৃত হয় একটি শিশুর ছবি, যা ছিল একটি বিশেষ কৌশলমাত্র।
১ আগস্ট ১৯৭১। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত হয় ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নামে একটি চ্যারিটি বা বেনিফিট কনসার্ট। প্রায় ৪০ হাজার দর্শকের সামনে ওই কনসার্টের প্রথমে অংশ নেন প্রখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর, সরোদবাদক আলী আকবর খান ও তবলাবাদক আল্লারাখার মতো ভারতীয় সংগীতের সুপরিচিত ওস্তাদেরাসহ উপমহাদেশীয় ধ্রুপদি সংগীতের অনেক দিকপাল। পরিবেশিত হয় বাংলা লোকসংগীতের অনন্য সুর ‘বাংলা ধুন’। সব শেষের পরিবেশন ছিল জর্জ হ্যারিসনের লেখা ও সুরে ‘বাংলাদেশ’ নামক গানটি, যা মিশে আছে বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে।
এভাবেই রবিশঙ্করের উদ্যোগে আর জর্জ হ্যারিসনের প্রচেষ্টায় রচিত হয় এক অনন্য ইতিহাস। এই কনসার্ট থেকে সংগৃহীত আড়াই লাখ মার্কিন ডলার পরবর্তীকালে শরণার্থীদের জন্য ব্যয় করা হয়। কিছু অর্থ দিয়ে সহায়তা করা হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকেও।
এই কনসার্ট প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংগীতের এক মেলবন্ধন তৈরি করেছিল। এ কনসার্টে কীভাবে জড়িয়ে গেলেন, সেটি তুলে ধরে জর্জ হ্যারিসন তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই আই, মি, মাইন-এ লিখেছেন, ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ ছিল একটি নৈতিক পদক্ষেপ...আমরা দেখিয়েছি যে রাজনীতিকদের চেয়ে শিল্পীরা ও সাধারণ মানুষ বেশি মানবিক। মানুষ রকশিল্পীদের চ্যারিটির জন্য পারফর্ম করাকেও গ্রহণ করেছিল।’
‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ ছিল বিশ্বে প্রথমবারের মতো আয়োজিত বেনিফিট কনসার্ট। শুধু তা–ই নয়, এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ববিবেককেও জাগ্রত করেছিল।
যে দেশের নামটি পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিত করে তোলার আগ্রহ দেখা যায়নি, এই কনসার্টের কারণে সেই ‘বাংলাদেশ’ নামটিই এক দিনে সারা বিশ্বে পরিচিত হয়ে ওঠে।
তাই ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ কেবল একটি সংগীতানুষ্ঠানই ছিল না, এই কনসার্ট ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক সাহসী প্রতিবাদ।