বছর শুরু হলো। স্কুল খুলতে দেরি নেই। স্কুল খোলা মানেই পড়াশোনা শুরু। আর পড়াশোনার অনেকগুলো লক্ষ্য থাকে। এর মধ্যে একটি হলো, পরীক্ষায় ভালো করা। পরীক্ষা শেষ করেই বছরের শুরুতে তুমি নতুন ক্লাসে উঠছ। পরীক্ষা কারও কাছে ভালো লাগে, আবার কারও জন্য পরীক্ষা বাড়তি চাপ তৈরি করে। মনে মনে তুমি হয়তো ভাবো, এই পরীক্ষাপদ্ধতি কে বানাল? তাকে যদি পেতাম…। অনেকে মিলে কাজটা করেছে, নাকি একজনের আবিষ্কার? কেনই বা করল? কীভাবে পরীক্ষাপদ্ধতি এল আমাদের দেশে?
আজ আমরা জানব, পরীক্ষা কেমন করে শুরু হলো! পরীক্ষা কে আবিষ্কার করল, এর উত্তর যে এককথায় বলা সম্ভব নয়, তা তো বুঝতেই পারছ। পরীক্ষার ইতিহাস নিয়ে মতভেদ আছে। তুমি যদি সবজান্তা গুগলকে জিজ্ঞেস করো, ‘Who invented exam system?’ দেখবে গুগল সংক্ষেপে জানিয়ে দেবে, Henry Fischel। অর্থাৎ পরীক্ষা আবিষ্কার করেছেন হেনরি ফিশেল। গুগলের এই উত্তর নিয়েও মতভেদ আছে। কেন?
কারণ, হেনরি ফিশেলের জন্ম ১৯১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ছিলেন। পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় অধ্যাপক হন। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, তিনি আসলে ব্যবসায়ী ছিলেন। ফিশেল অধ্যাপক বা ব্যবসায়ী যা–ই হোন না কেন, প্রশ্ন আসে; তাঁর জন্মের আগে কি পরীক্ষাপদ্ধতি ছিল না?
ইতিহাস বলছে, পৃথিবীতে প্রথম পরীক্ষাপদ্ধতির প্রমাণ পাওয়া যায় ৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে। চীনের সুই রাজবংশে পরীক্ষাপদ্ধতির সূচনা হয়। তবে সেই পরীক্ষার ভোগান্তি শিক্ষার্থীদের ছিল না। শুধু যাঁরা সরকারি চাকরি করতে ইচ্ছুক, তাঁদের পরীক্ষা দিতে হতো। পরীক্ষায় পাস করলে সুইয়ের সম্রাট ইয়াংয়ের নেতৃত্বে সরকারি চাকরি করার সুযোগ মিলত। চীনের তাং রাজবংশ এই পরীক্ষাপদ্ধতিকে আরও উন্নত করেছিল।
১৮০৬ সালে সিভিল সার্ভিসের প্রার্থী নির্বাচনের জন্য ব্রিটিশরা যুক্তরাজ্যে পরীক্ষাপদ্ধতির প্রচলন করে। পরে ১৮৫৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ পদ্ধতি নিয়ে আসে ভারতীয় উপমহাদেশে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা নিয়ে তারা কোম্পানির জন্য বেসামরিক কর্মচারী নিয়োগ দিত। তবে পরীক্ষা বলতে এখন আমরা যেমন খাতা–কলমে প্রশ্নোত্তর লেখা বুঝি, আগে কিন্তু এমন ছিল না।
‘পরীক্ষা’ শব্দটির বেশ কয়েকটি অর্থ রয়েছে। যেমন, গভীরভাবে কোনো কিছু পর্যবেক্ষণ করা, পরিদর্শন বা অধ্যয়ন করা। লন্ডনে একটা পরীক্ষা নেওয়া হতো প্রতিবছর আগস্ট মাসে। সেখানে পরীক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলক ঘোড়ায় চড়ে দেখাতে হতো। ব্রিটিশদের হাত ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে আসে পরীক্ষাপদ্ধতি। আর সেখান থেকেই যে পরীক্ষা বাংলাদেশে এসেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তবে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশরা পরীক্ষাপদ্ধতি চালু করলেও পড়ালেখা শুরু হয়েছিল অনেক অনেক আগে। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ভারতে ‘গুরুকুল’ নামে শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল। এ ব্যবস্থায় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা (আগে শিক্ষকদের গুরু বলা হতো) একটি নির্দিষ্ট ঘরে থাকতেন। সেখানেই খাওয়াদাওয়া ও পড়ালেখা হতো। অনেকটা আধুনিক হোস্টেলের মতো বলা যায়।
তবে সেই গুরুকুলে ছিল না কোনো পরীক্ষাপদ্ধতি। গুরু যদি মনে করতেন, ছাত্রের পর্যাপ্ত জ্ঞান হয়েছে, তাহলেই তার পড়ালেখার পাঠ শেষ। তবে ব্রিটিশদের কারণে এ শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়। নিজেদের আধিপত্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশরা অর্থ ও শাসন বিভাগের দায়িত্ব নেয়। তাদের সঙ্গে কাজ করতে হলে তো ইংরেজি না জেনে উপায় নেই। তাই ভারতীয়রা ইংরেজি শিক্ষায় গুরত্ব দেয়। এভাবে ভারতের প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা চিরতরে হারিয়ে যায়।
শিক্ষাব্যবস্থার এই ইতিহাস সত্যি হলে হেনরি ফিশেল কোনোভাবেই পরীক্ষাপদ্ধতির জনক হতে পারেন না। কারণ, তাঁর জন্মের প্রায় ১০৭ বছর আগে লন্ডনে পরীক্ষাপদ্ধতির প্রমাণ পাওয়া যায়। ভারতেই তাঁর জন্মের ৬০ বছর আগে পরীক্ষাপদ্ধতি চালু হয়েছে। তাহলে কীভাবে ফিশেলের নাম পরীক্ষাপদ্ধতির সঙ্গে জড়িয়ে গেল?
এর আসল উত্তর হয়তো এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। হয়তো ফিশেল যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষাপদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন। যদি তিনি জাতীয় অধ্যাপক হন, তাহলে তাঁর পক্ষে সম্পূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো সম্ভব। সেই খবরই বিভিন্ন পত্রিকার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে দেশে দেশে। ইন্টারনেটের কল্যানে তিনি পরিণত হয়েছেন পরীক্ষাপদ্ধতির জনকে।
অন্য একটা সম্ভাবনাও থাকতে পারে। হয়তো আগে পরীক্ষাপদ্ধতিতে খাতা–কলমে লেখার প্রচলন ছিল না। ঘোড়ায় চড়া বা এ ধরনের কোনো পরীক্ষা নেওয়া হতো। হয়তো শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দেওয়াই লাগত না। শুধু চাকরি করার জন্যই বরাদ্দ ছিল এই ব্যবস্থা। হেনরি মিশেল শিক্ষার্থীদের জন্য খাতা–কলমে লিখে পরীক্ষার পদ্ধতি চালু করেন। হতে পারে ওপরের দুটি ধারণার কোনো একটি ঠিক। আবার হতে পারে, প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে যুগে যুগে পরীক্ষাপদ্ধতির আধুনিকায়ন হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দেওয়ার পদ্ধতির প্রচলন করেছেন হেনরি মিশেল। অনেক রকম সম্ভাবনাই রয়েছে। কিন্তু সত্যিটা কী, তা এখন শতভাগ নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।
সূত্র: মিডিয়াম ডটকম, কলেজ সার্চ ডট ইন, গিগস ফর গিগস ডট অর্গ