দুপাঁ থেকেই শুরু
হঠাৎ রক্তহিম চিৎকারে খান খান হয়ে যায় ভোরের প্যারিস, জেগে ওঠে কারতিয়ে সাৎ রখের বাসিন্দারা। মর্গ সড়কের একটা বহুতল ভবন থেকে আসছে আওয়াজটা। পাঁচতলা ওই বিশাল বাড়িটায় শুধু মেয়েকে নিয়ে থাকে মাদাম লিসপানে। অনেক ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়া না পেয়ে শেষে গেট ভেঙেই ভেতরে ঢুকে পড়ে প্রতিবেশীরা। নিচে কাউকে পাওয়া যায় না। সিঁড়ি ভেঙে উঠতে উঠতে ওপর থেকে দুটি কণ্ঠ শুনতে পায় কয়েকজন প্রতিবেশী। একটা পুরুষ কণ্ঠ, ফরাসিতে কারও সঙ্গে কথা বলছে; অস্পষ্টতার কারণে অপরজনের ভাষা বা লিঙ্গ, বোঝা যায় না কোনোটাই। পঞ্চম তলায় তল্লাশি করে পেছন দিককার একটা ঘর ভেতর থেকে বন্ধ পাওয়া যায়। দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে মনে হয় যেন ঝড় বয়ে গেছে ঘরটায়, ছড়ানো-ছিটানো জিনিসপত্রের দঙ্গলের মধ্যে পড়ে আছে একটা রক্তাক্ত ক্ষুর, কয়েক গোছা ধূসর চুল আর দুই থলে স্বর্ণমুদ্রা। কিন্তু কোথাও মা-মেয়ের চিহ্ন নেই। ফায়ারপ্লেসে মাত্রাতিরিক্ত ঝুল পড়ে থাকতে দেখে সন্দেহ হয়, চিমনির ভেতর দিয়ে ওপরের দিকে তাকাতেই ওলটানো অবস্থায় মেয়ের লম্বমান লাশ দেখা যায়। পরে বাড়ির পেছনের উঠানে পাওয়া যায় মায়ের লাশ, ধারালো কিছুর আঘাতে মাথাটা প্রায় ছিন্ন।
এই জোড়া খুনের ঘটনায় এদলফ ল বু নামের এক ব্যাংক-কেরানিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আগের দিন ব্যাংক থেকে মাদামকে কিছু স্বর্ণমুদ্রা পৌঁছে দিয়েছিল বেচারা, এটাই তার অপরাধ। নিরীহ একটা লোকের এভাবে ফেঁসে যাওয়াটা কিছুতেই মানতে পারে না প্যারিসেরই আরেক বাসিন্দা অগাস্ত দুপাঁ, প্রকৃত দোষীকে খুঁজে বের করতে মাঠে নামে। এবং অচিরেই নিজের অভিনব বিশ্লেষণী ক্ষমতা খাটিয়ে ঠিক অপরাধীকে খুঁজে বের করে।
গল্পটার নাম ‘দ্য মার্ডারস ইন দ্য রু মর্গ’। মাত্র ৫৬ ডলারে গ্রাহামস ম্যাগাজিনের কাছে গল্পটা বিক্রি করেন এডগার অ্যালান পো। কে জানত, ১৪ হাজার শব্দের এই গল্পই পরে বিলিয়ন ডলার ইন্ডাস্ট্রির জন্ম দেবে। জানলে নিশ্চয়ই এত কম দামে গল্পটা বিকোতেন না পো। এমন না যে অর্থকড়ির তাঁর দরকার ছিল না। টানাটানি তাঁর ভালোই ছিল। সত্যি বলতে কী, আমৃত্যু অভাব তাঁর পিছু ছাড়েনি। তাই ১৮৪১ সালের এপ্রিল সংখ্যা গ্রাহামস ম্যাগাজিনে দুপাঁর প্রথম কীর্তিটা যখন বেরোল, ঘুণাক্ষরেও তখন যদি টের পেতেন দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারার জন্ম দিতে যাচ্ছে তাঁর এই গল্প, তাহলে ভালো একটা দাম নিশ্চয়ই হাঁকাতেন পো।
ধারাটির নাম ডিটেকটিভ ফিকশন বা গোয়েন্দা সাহিত্য। গল্পটা যখন ছাপা হয়, তখন রক্ত-মাংসের ডিটেকটিভ তো দূরের কথা, অভিধানে পর্যন্ত এই শব্দটা ছিল না। পো নিজেই তো এই ধারার নাম দিয়েছিলেন রেশিওসিনেশন [যুক্তিবদ্ধ চিন্তাপ্রক্রিয়া]। কাল তাঁর এই নামটি মনে রাখেনি, তবে ধারাটি গ্রহণ করেছিল। শুধু গ্রহণই করেনি, দেড় শ বছরের মধ্যে অতি ক্ষীণ সেই ধারাকেই মহাসমুদ্রে পরিণত করেছিল।
অনেক নিন্দুক অবশ্য ধারাটি সৃষ্টির পুরো কৃতিত্ব এককভাবে পোকে দিতে নারাজ। তাঁদের দাবির সপক্ষে পুরোনো সাহিত্যের অনেক নজিরই তাঁরা হাজির করেন। একটা নজির চীনা সাহিত্য। এই গল্প ছাপা হওয়ার হাজার বছর আগে থেকেই চীনের ছিল সমৃদ্ধ এক রহস্য সাহিত্য। চীনা এই সব গোয়েন্দা সাহিত্যের অধিকাংশেরই নায়ক সাধারণত আঞ্চলিক ম্যাজিস্ট্রেট। মধ্যযুগের এই সব সরকারি কর্মকর্তার হাতেই থাকত ওই অঞ্চলের প্রশাসন, আইন ও বিচারক্ষমতা। এলাকায় কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে অভিযোগ তার কাছেই আসত, সে-ই তদন্ত করত, বিচারও করত সে। চীনা গোয়েন্দা সাহিত্যের এ রকমই দুই মশহুর গোয়েন্দা জাজ ডি ও জাজ বাও। তাদের দুজনকে নায়ক করে অনেক গল্প ও নাটক চীনে প্রচলিত আছে। এই সব গল্পের অপরাধগুলো যেমন বিচিত্র, তেমনি অভিনব। চীনা অপরাধকাহিনির আরেকটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ম্যাজিস্ট্রেট এখানে একসঙ্গে একাধিক, সাধারণত তিনটি আলাদা অপরাধের তদন্ত একসঙ্গে করে। একটা এলাকায় সব সময় একটা করে অপরাধ হয় না নিশ্চয়, একই সময়ে সংঘটিত হতে পারে একাধিক অপরাধ। সেদিক থেকে চীনা গোয়েন্দা সাহিত্যকে বেশ বাস্তবানুগ বলতে হয়, ম্যাজিস্ট্রেটরা একই সঙ্গে এসব অপরাধের তদন্ত করে। কিন্তু এসব গল্পের একটা প্রধান সমস্যা হচ্ছে গল্পের শুরুতেই আমাদের সঙ্গে অপরাধীর পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়, আর অপরাধটা সে কেন করল তা-ও বলে দেওয়া হয় বিস্তারিত। ফলে এটা আর রহস্য থাকে না, হয়ে ওঠে উল্টো কাঠামোর গোয়েন্দা গল্প। আর অপরাধী ধরার ক্ষেত্রেও অধিকাংশ সময়ই যুক্তি বা কার্যকারণ নয়, নেওয়া হয় অলৌকিকের সাহায্য। যেমন খুন হওয়া ব্যক্তিটি হয়তো নিজেই অশরীরী হাজিরা দিয়ে খুনির নাম বলে যায়। সময়ে সময়ে সম্ভাব্য খুনিকে অমানুষিক অত্যাচার করেও অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়, মারের চোটে নিরপরাধ ব্যক্তিও হয়তো অপরাধ স্বীকার করে নিত। আধুনিক গোয়েন্দা গল্পের যা অন্যতম বৈশিষ্ট্য, গোয়েন্দার বুদ্ধির ক্যারিশমার খেলা, কদাচিত এসব গল্পে তা উপস্থিত।
কেউ কেউ আবার ‘হাজার এক রজনী’র ‘তিনটি আপেল’ গল্পকে প্রথম গোয়েন্দা গল্প আর জাফরকে প্রথম গোয়েন্দার স্বীকৃতি দিতে চান। তাঁদের কাছে এটা বহু টুইস্টসমৃদ্ধ প্রথম ‘হুডানিট’। তাঁদের দাবির সত্যতা যাচাইয়ের আগে চলো ছোট করে গল্পটা একবার জেনে নেওয়া যাক। দজলা নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে তালাবদ্ধ একটা সিন্দুক পায় এক জেলে। সিন্দুকটা সে খলিফা হারুন-অর-রশিদের কাছে বিক্রি করে। তালা ভেঙে সিন্দুক খোলা হলে দেখা যায় ভেতরে এক তরুণীর টুকরো টুকরো লাশ। রহস্য সমাধানের দায়িত্ব পায় খলিফার প্রিয় আমাত্য উজির জাফর। তিন দিন সময় দেওয়া হয় তাকে, এর মধ্যে খুনিকে ধরতে হবে, না হলে তাকেই শূলে চড়তে হবে। এ পর্যন্ত পড়ার পর আমরা বেশ আগ্রহী হয়ে উঠি। দারুণ একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। মনে মনে জমাটি একটা মার্ডারমিস্ট্রির জন্য প্রস্তুত হই আমরা। কিন্তু অচিরেই জাফর আমাদের হতাশ করে। রহস্য সমাধানে কার্যকর কিছুই সে করে না। পুরো ব্যাপারটা সে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেয়। পরে খুনি নিজেই এসে হত্যাকাণ্ডের স্বীকারোক্তি করে। আবার জাফরকে দায়িত্ব দেওয়া হয় কে তাকে এ কাজে প্ররোচিত করল তাকে ধরতে, এবারও সে ব্যর্থ হয়। পরে বুদ্ধিবলে নয়, দৈবক্রমে একটা আলামত আবিষ্কার করে সে, আর সেই সূত্রে উসকানিদাতাকে ধরে নিজের গর্দানটা বাঁচায়। এহেন নিরেট ও অকর্মা একজন লোককে আর যে-ই মানুক, আমরা অন্তত সাহিত্যের প্রথম গোয়েন্দা মানতে নারাজ।
চীনারা দাবিদার, আরবদেরও দাবি আছে, আরেক প্রাচীন সাহিত্যের ভান্ডারি ভারতীয়রাই বা বসে থাকবে কেন? তাদের দাবি, চীনা ম্যাজিস্ট্রেট ডি বা বাও নয়, হারুন-অর-রশিদের উজির জাফরও নয়, সাহিত্যের প্রথম গোয়েন্দা হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ। আর এই দাবির সপক্ষে তারা কৃষ্ণের স্যমন্তকমণি উদ্ধারের ঘটনাটিকে দাখিল করতে চায়। ঘটনাটা শোনা যাক।
পুরাকালে দ্বারকা নগরীর যাদবকুলে প্রসেন নামে এক লোক বাস করত। তার স্যমন্তক নামের অতি মূল্যবান একটা রত্ন ছিল। রত্নটা তার এতই প্রিয় ছিল যে সব সময় ওটা সঙ্গে সঙ্গেই রাখত। এটা পরা অবস্থাতেই একদিন শিকারে গিয়ে সে আর ফিরল না। প্রসেনের এই রহস্যময় অন্তর্ধানের ঘটনায় লোকে যাদবকুলেরই আরেক প্রভাবশালী সদস্য শ্রীকৃষ্ণকে সন্দেহ করল। কারণ, আগে একবার এই রত্নটার ব্যাপারে সে আগ্রহ দেখিয়েছিল। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ এবং স্যমন্তকমণি উদ্ধার করতে তাই একদিন সে দলবলে বেরিয়ে পড়ল। প্রসেনের পদরেখা খুঁজে বের করে সেটা অনুসরণ করতে করতে একটা জায়গায় এসে সে প্রসেন আর তার ঘোড়ার মৃতদেহের সন্ধান পেল। পাশেই পড়ে ছিল একটা সিংহের দাঁত আর নখের কয়েকটা টুকরা। এ থেকে সিদ্ধান্তে এল যে প্রসেন নিশ্চয় সিংহের থাবায় মারা পড়েছে। কিন্তু স্যমন্তকমণি গেল কই? আশপাশটা আরও ভালো করে খেয়াল করতেই পাওয়া গেল সিংহের পায়ের ছাপ। সেটা অনুসরণ করে দ্বিতীয় আরেকটা ধস্তাধস্তিস্থলে হাজির হলো। সেখানে পড়ে আছে মরা একটা সিংহ। পাশেই একটা ভালুকের পায়ের ছাপ। বোঝা গেল, এই জায়গায় সিংহটাকে আবার একটা ভালুক আক্রমণ করে। কিন্তু এখানেও তো মণি নেই। ভালুকের পায়ের ছাপ অনুসরণ করে এবার একটা গুহায় গিয়ে হাজির হলো শ্রীকৃষ্ণ। গিয়ে দেখে একটা ভালুকছানা মণিটা নিয়ে খেলা করছে। মণিটাকে মাংসের টুকরা মনে করে নিয়ে এসেছিল ভালুক, পরে ভুল বুঝতে পেরে ওটা তার বাচ্চাকে দিয়ে দেয়। ভালুকটার সঙ্গে লড়াই করে মণিটা উদ্ধার করল শ্রীকৃষ্ণ। খুন ও চুরির মিথ্যা অভিযোগ, নির্দোষ প্রমাণ করতে নিজেই তদন্তে নামা, পায়ের ছাপ অনুসরণ করে অপরাধস্থলে পৌঁছানো, পারিপার্শ্বিক আলামত বিশ্লেষণ করে প্রকৃত খুনি শনাক্তকরণ—আধুনিক গোয়েন্দা গল্পের অনেক উপাদানই এই গল্পে আছে, কিন্তু হাজার বছর আগের বিষ্ণুপুরাণের এই গোয়েন্দা গল্পেরও সেই একই সমস্যা, এখানেও গল্পের শুরুতেই অপরাধীর পরিচয় বলে দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ উপাদান গোয়েন্দা গল্পের হলেও বলা হয়েছে অ্যাডভেঞ্চার গল্পের মতো করে। অথচ গল্পটা কীভাবে বলা হলো, গোয়েন্দা গল্পে এটা একটা ভীষণই জরুরি বিষয়। শুধু এই বলার ধরনের কারণেই উপাদানে সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও ‘রাজা ইডিপাস’কে কেউ গোয়েন্দাকাহিনি বলেন না।
কেউ কেউ আবার অত দূর অতীতেও যাননি। অপেক্ষাকৃত আধুনিক সাহিত্য থেকেই উদাহরণ টেনেছেন। এখানেও অনেক দাবিদার। ব্রিটেনের উইলিয়াম গডউইন, টমাস স্কিনার স্টার ও উইলিয়াম ইভান্স বার্টন, ডেনমার্কের স্টিন স্টিনসেন ব্লিগা, নরওয়ের মরিৎস হানসেন, জার্মানির ই টি এ হফমান—কত নাম বলব। সবার কথা তো আর এখানে বলা যাবে না, অত জায়গা নেই; আমরা শুধু দুপাঁর সবচেয়ে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীটির কথাই বলব। নাম তার জাদিগ, ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের একই নামের একটি উপন্যাসের সে নায়ক। আগের উদাহরণগুলোর মতো ভলতেয়ারের এই কাহিনিকে কিন্তু কোনো অবস্থাতেই অপরাধমূলক বলা যাবে না, এটা বরং মানুষের জীবনে ভাগ্যের খেলা নিয়ে একটা দার্শনিক কাহিনি। স্রষ্টার মতো এই বইয়ের নায়কও দার্শনিক। কিন্তু একজন দার্শনিক কী করে গোয়েন্দা হলো, জানতে হলে এই বইয়েরই একটা বিশেষ অধ্যায় আমাদের মন দিয়ে পড়তে হবে। অনেক ঘাটের জল খেয়ে জাদিগ তখন ফোরাতকুলে থাকে। একদিন সে বনের ধারে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এমন সময় রানির এক প্রহরী এসে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এই ছোকরা, রানির কুকুরকে এই পথে যেতে দেখেছ?’ জবাবে জাদিগ জানাল, ‘ওটা কুকর নয়, কুকুরী; জাতে স্পানিয়েল, কিছুদিন হয় মা হয়েছে, ওটার সামনের বাঁ পা খোঁড়া আর কানগুলো ঝোলা।’ সবচেয়ে বিস্ময়কর কথাটা বলল সে সবশেষে, ‘কিন্তু আমি পশুটিকে দেখিনি!’
এ সময় রাজার ঘোড়ার খোঁজে এসে সহিসও তার কাছ থেকে হারানো ঘোড়ার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা পেল। তাকেও একই কথা বলল জাদিগ, ‘ঘোড়াটাকে আমি দেখিনি।’
প্রহরী বা সহিস কেউই তার কথা বিশ্বাস করল না, দেখেনি তাহলে বলছে কী করে, ব্যাটা নিশ্চয় চোর। তাকে ধরে সোজা আদালতে হাজির করা হলো। তখন বাধ্য হয়ে আদালতে যে জবানবন্দিটা জাদিগ দিল, সেটাই তাকে প্রথম গোয়েন্দার দাবিদার করে তুলেছে। সে বলল, ‘বনে হাঁটার সময় বালুর মধ্যে কিছু পদচিহ্ন দেখতে পাই, সহজেই বুঝতে পারি কুকুরের পায়ের ছাপ। পায়ের ছাপের মাঝখানে একটা টানা সরু দাগ দেখতে পাই, বুঝতে পারি একটা বাঁটের ছাপ, সদ্য বাচ্চা দেওয়ায় ঝুলে পড়েছে, আরও দেখলাম পায়ের একটা ছাপ অন্যগুলোর তুলনায় হালকা। বুঝলাম কুকুরীটার একটা পা খোঁড়া। সামনের পায়ের পাশে বালু ঘষটে যাওয়ার আরেক জোড়া দাগ, তাতে বুঝলাম কানগুলো ঝুলে গেছে।’ একইভাবে না দেখেও কীভাবে ঘোড়াটাকে ‘দেখল’ ব্যাখ্যা করল জাদিগ। কী আরেকজন গোয়েন্দার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে? ঠিক। প্রায় দেড় শ বছর পরে ঠিক একই প্রক্রিয়ায় সামান্য থেকে অসামান্য সব সিদ্ধান্তে উপনীত হবে শার্লক হোমস। এই হিসাবে অপরাধ সমাধান পদ্ধতির উদ্ভাবকের কৃতিত্বটা ভলতেয়ারকে দেওয়াই যায়, কিন্তু পদ্ধতিটা ডিটেকটিভ কাহিনিতে প্রয়োগ করেননি, করেছেন দার্শনিক উপন্যাসে। যে কারণে আর্থার কোনান ডয়েলের গুরু জোসেফ বেলকে কেউ গোয়েন্দা বলে না, যদিও তাঁর কাছ থেকেই হোমসের তদন্ত পদ্ধতিটা পেয়েছিলেন ডয়েল। কারণ পদ্ধতিটা তিনি প্রয়োগ করতেন রোগ নির্ণয়ের কাজে।
মোট কথা, দুপাঁ-পূর্ব এসব কাহিনি পড়লে বোঝা যায়, আজকে আমরা গোয়েন্দা গল্প বলতে যা বুঝি, তার কোনোটাই পরিপূর্ণভাবে এগুলোতে নেই। গোয়েন্দা সাহিত্যের ইতিহাসকার জুলিয়ান সিমন্স এগুলোকে তাই সর্বোচ্চ গোয়েন্দা-ধাঁধা বলে মানতে রাজি, তার বেশি নন। কিন্তু ধাঁধা তো উপাদানমাত্র, পূর্ণাঙ্গ গোয়েন্দা সাহিত্য নয়। এগুলোর মধ্যে সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে গোয়েন্দা সাহিত্যে রূপান্তরিত করতে পারেননি এই স্রষ্টারা কিংবা তাঁদের উদ্দেশ্যই ছিল অন্য কিছু সৃষ্টি। প্রথম এটাকে তার পুরো সম্ভাবনা নিয়ে আবিষ্কার করলেন এডগার অ্যালান পো, রচনা করলেন ‘দ্য মার্ডারস ইন দ্য রু মর্গ’, জন্ম নিল প্রথম আধুনিক গোয়েন্দা ল শাভেলিয়ে সি অগুস্ত দুপাঁ। আজকে দুনিয়াজুড়ে পৃষ্ঠা আর পর্দায় যত গোয়েন্দা ঘুরে বেড়ায়, এরা সবাই দুপাঁর সন্তান, তার বেঁধে দেওয়া নিয়মকানুনের গণ্ডির মধ্যেই তাদের চলাফেরা।
দুপাঁকে নিয়ে তিনটা মাত্র গল্প লিখেছিলেন পো: ‘দ্য মার্ডারস ইন দ্য রু মর্গ’, ‘দ্য মিস্ট্রি অব মারি রোজে’ ও ‘দ্য পারলয়েন্ড লেটার’। এই তিনটা গল্পেই গোয়েন্দা সাহিত্যের মূল কানুনগুলো প্রতিষ্ঠা করে গেছেন পো।
প্রথম কানুন: নায়ক হবে তুখোড় বুদ্ধির অধিকারী। দুপাঁর বিশ্লেষণী ক্ষমতা অসাধারণ আর পঠনপাঠন এনসাইক্লোপেডিক। তাঁর অন্য কারোর চিন্তাপ্রক্রিয়া অনুসরণ করার ক্ষমতাকে প্রথমে মনে হবে অলৌকিক, কিন্তু ব্যাখ্যা করার পর মনে হবে অতি স্বাভাবিক। পরবর্তীকালের অনেক গোয়েন্দার বিচিত্র খামখেয়ালিপনার প্রথম বীজও কিন্তু দুপাঁতেই আছে। দিনের বেলা দরজা-জানালা সব বন্ধ করে ঘর অন্ধকার করে সে পড়াশোনা করে আর রাত হলে বন্ধুকে নিয়ে নগর পরিদর্শনে বেরিয়ে পড়ে। আর গোয়েন্দাগিরিও সে টাকার জন্য নয়, নিতান্ত শখের বশে করে।
দ্বিতীয় কানুন: প্রথম পুরুষ বর্ণনা। দুপাঁর সব কাহিনিই বর্ণনা করেছে তার অনামা এক বন্ধু। এই বর্ণনাভঙ্গি পাঠকের সঙ্গে লেখকের একধরনের অন্তরঙ্গতা তৈরি করে, পাঠকের মনে হয় সে-ও বুঝি ঘটনাস্থলে হাজির আছে, কিন্তু একই সঙ্গে এটা আবার গোয়েন্দার সঙ্গে তার দূরত্বও তৈরি করে। গোয়েন্দা আসলে কী ভাবছে তার কিছুই সে জানতে পারে না। গোয়েন্দা গল্পের জন্য এই রীতি দারুণ কার্যকর। শার্লক হোমস থেকে শুরু করে আমাদের ব্যোমকেশ ফেলুদা—সবাই পরে এই রীতি অনুসরণ করেছে।
তৃতীয় কানুন: কল্পনাকুশল প্লট। রু মর্গকে বলা হয় প্রথম লকড রুম মিস্ট্রি বা বদ্ধঘরের রহস্য। এ ধরনের গল্পে অপরাধটা সংঘটিত হয় বদ্ধ কোনো জায়গায়, যেখানে বাইরে থেকে কারও ঢোকা বা বেরোনো অপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব। এই গল্পে পাঁচতলার যে ঘরে খুন দুটি সংঘটিত হয়, সেটা ছিল ভেতর থেকে বন্ধ। ‘দ্য মিস্ট্রি অব মারি রোজে’কে বলা হয় সত্যি ঘটনা অবলম্বনে লেখা প্রথম গোয়েন্দা গল্প। নিউইয়র্কে ঘটে যাওয়া এক তরুণীর অমীমাংসিত হত্যাকাণ্ডের সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেছে দুপাঁ। ‘আর্মচেয়ার ডিটেকটিভ’ ঘরানারও জন্ম দিয়েছে এই গল্প। এ ধরনের গল্পে গোয়েন্দা কখনো অপরাধস্থলে যায় না, কাউকে জিজ্ঞাসাবাদও করে না, অন্যের কাছ থেকে শুনে বা পত্রিকায় বিবরণ পড়ে সমাধান দেয়। ‘দ্য পারলয়েন্ড লেটার’-এর বিষয় চুরি যাওয়া একটা চিঠি, চিঠিটা উদ্ধার করতে না পারলে সমূহ বিপদ। কোন বাড়িতে চিঠিটা আছে পুলিশ জানে, কিন্তু সেখানে তন্নতন্ন করে কয়েক দফা তল্লাশি চালিয়েও কোথাও চিঠিটা পায় না তারা। দুপাঁ কিন্তু ঠিকই খুঁজে পায়। পরে আর্থার কোনান ডয়েল, আগাথা ক্রিস্টি থেকে শুরু করে আমাদের শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত অনেক গোয়েন্দা লেখকই এই ‘লুকানো বস্তু’ খুঁজে বের করা নিয়ে গল্প লিখেছেন।
চতুর্থ কানুন: ‘বোকা ও আত্মম্ভরী পুলিশ’। গোয়েন্দা গল্পে পুলিশকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করার যে দীর্ঘ ইতিহাস, তার সূচনাও করেছে দুপাঁ। তার ঠাট্টার লক্ষ্য ছিল প্যারিস পুলিশের প্রিফেক্ট জি.। পরে হোমস কাহিনিতে ইন্সপেক্টর লেস্ট্রাডকে আরও এক কাঠি বাড়িয়ে কাজটা করেছেন আর্থার কোনান ডয়েল।
পঞ্চম কানুন: অপরাধ উন্মোচন পদ্ধতি। প্রথমে সমাধান, তারপর কোন যুক্তিতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তার ব্যাখ্যা—গোয়েন্দা গল্পের এই প্রচলিত কানুনটাও ‘দ্য মার্ডারস ইন দ্য রু মর্গ’-এ প্রথম প্রয়োগ করেন পো।
অনেকে হয়তো আধুনিক অনেক উদাহরণ দেখিয়ে বলবেন, কই এখানে তো এই কানুনগুলোর একটাও নেই, তারপরও গোয়েন্দা সাহিত্য হিসেবে সফল। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, এই কানুনগুলোর সচেতন অনুপস্থিতি পরোক্ষে কানুনগুলোকেই স্বীকার করে নিয়েছে। এই নিয়মগুলো ছিল বলেই নিয়মগুলোকে ভাঙতে পারা গেছে।