এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় নক্ষত্র কোনটি

মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় নক্ষত্রটি সূর্যের চেয়ে ১ হাজার ৭০০ গুণ বড়।ছবি: গেটি ইমেজ/জাভিয়ের জায়াস

রাতের আকাশের দিকে তাকালে জোনাকিপোকার মতো অনেক আলো জ্বলতে দেখবে। এগুলোকে বলে ‘নক্ষত্র’। সূর্য যেমন একটা নক্ষত্র বা তারা, ওগুলোও তেমন। আকারে একটা বিশাল। কিন্তু অনেক দূরে বলে ওগুলো ছোট্ট আলোর মতো দেখা যায়।

বিষয়টা আরও একটু স্পষ্ট করে বলি। ধরো, তোমার থেকে ১০ হাত দূরে একটা ফুটবল রাখা আছে। ওটাকে তুমি একটা ফুটবলের মতোই দেখবে। কিন্তু যদি ৫০০ হাত দূর থেকে ফুটবলটা দেখো, তাহলে একটু ছোট দেখাবে। হয়তো এই কম দূরত্বে তা বুঝতে পারবে না। এবার তুমি ৫০০ মিটার দূর থেকে দেখার চেষ্টা করো। আরও ছোট দেখাবে। যদি এক হাজার মিটার দূরে যাও, তাহলে আরও ছোট দেখাবে। এবাবে দূরে সরতে সরতে একসময় ফুটবলটা দেখাবে একটা বিন্দুর মতো। কিন্তু ফুটবল কি আসলে ছোট হয়েছে? না, হয়নি। তুমি দূর থেকে দেখছ বলে ওমন ছোট দেখায়। ২০তলা বিল্ডিংয়ের ওপর থেকে কখনো নিচের দিকে তাকিয়ে দেখেছো? মানুষকে অনেক ছোট দেখায়। এ কারণে বিমান থেকে মানুষকে দেখায় পিঁপড়ার মতো।

যাহোক, আবার মূল আলোচনায় ফিরি। নক্ষত্রগুলো আমাদের থেকে অনেক দূরে বলে ওগুলো জোনাকিপোকার মতো দেখায়। ভাবতে পারো, কত দূরেই আর হবে। ওই তো আকাশ, ওটা পাড়ি দিলেই তো নক্ষত্র। আসলে বিষয়টা অত সহজ নয়। দূরত্বের ব্যাপারটাও একটু বুঝিয়ে বলি।

আরও পড়ুন

একটু আগে ফুটবলের একটা উদাহরণ দিয়েছি। খেয়াল করলে দেখবে, প্রথমে আমরা হাতের হিসেবে দূরত্ব মেপেছি, যেমন ৫০ হাত। কিন্তু দূরত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা মিটারে মাপা শুরু করেছি। আবার আরও দূরে গেলে হয়তো কিলোমিটারে মাপতাম। আসলে আমি যদি বলি এক কিলোমিটার দূর তাহলে সহজে বলা যায়। কিন্তু আমি যদি বলি ৫ কোটি ৯ লাখ হাত দূর, তাহলে সহজে বোঝা যায় না। সহজে বোঝার জন্য বিভিন্ন একক ব্যবহার করা হয়। মহাকাশের বস্তুর দূরত্ব মাপতে তেমন ব্যবহৃত হয় আলোকবর্ষ। কারণ, কিলোমিটার এত ছোট দূরত্ব যে, তা দিয়ে একটা নক্ষত্রের দূরত্ব মাপা প্রায় অসম্ভব।

এখন ভাবতে পারো, আলোকবর্ষটা আবার কী জিনিস। সহজভাবে বললে, আলো এক বছরে যতটা পথ অতিক্রম করে, তা–ই আলোকবর্ষ। মানে, আলো এক সেকেন্ডে যায় তিন লাখ কিলোমিটার। বিষয়টা কিন্তু বুঝতে হবে। তোমার এক কিলোমিটার যেতে প্রায় ঘণ্টাখানেক লেগে যাবে। আর আলো যাবে সেকেন্ডে তিন লাখ কিলোমিটার। এই গতিতে এক সেকেন্ডে আলো পৃথিবীর চারপাশে প্রায় সাতবার ঘুরতে পারে। যাহোক, এ তো গেল মাত্র এক সেকেন্ডের কথা। তাহলে এক মিনিটে কত কিলোমিটার যাবে? ওই তিন লাখকে ৬০ দিয়ে গুণ দিতে হবে। তারপর বের করবে এক ঘণ্টার হিসাব, তারপর দিন এবং তারপর বছর। এবার চিন্তা করো, এক আলোকবর্ষ মানে কত দূর। আমরা আকাশে যে ছোট আলোর বিন্দুর মতো দেখি, তা এমন হাজার হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। সেগুলো আকারেও কিন্তু বিশাল। কতটা বিশাল?

আরও পড়ুন

সে জন্য আমাদের প্রথমে সূর্যকে বুঝতে হবে। সূর্য হলো আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র। পৃথিবী থেকে প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আর কত বড়! ১৩ লাখ পৃথিবী যদি সূর্যের মধ্যে ঢোকাও, তাও এঁটে যাবে অনায়াসে। এবার নিজেই কল্পনা করে দেখ সূর্য কত বড়।

তাহলে সূর্যই কি সবচেয়ে বড় তারা? এমনটা ভেবে থাকলে তোমাকে কোনো দোষ দেওয়া যায় না। কারণ, পৃথিবী থেকে সূর্যকেই সবচেয়ে বড় দেখায়। কিন্তু আসলে সূর্য সবচেয়ে বড় নক্ষত্র নয়। সবচেয়ে বড় নক্ষত্রের ধারেকাছেও নেই সূর্য। সূর্য কোনো বড় নক্ষত্রই না। এটা একটা মাঝারি ধরনের তারা। পৃথিবী থেকে সূর্য সবচেয়ে কাছে বলে একে বড় দেখায়। তাহলে সবচেয়ে বড় নক্ষত্র কোনটি?

ওটার নাম ইউওয়াই স্কুটি (UY Scuti)। নামটা একটু কেমন যেন, তাই না? কিন্তু এটাই মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় নক্ষত্র। এটার ব্যাস আমাদের সূর্যের ব্যাসের চেয়ে প্রায় ১ হাজার ৭০০ গুণ বড়। একটা বৃত্তের ঠিক মাঝবরাবর কোনো রেখা টানলে ওই রেখাকে বলে ব্যাস। ধরো, সূর্যের ঠিক মাঝখান দিয়ে একটা দাগ টানলে। সেই দাগটা হলো ১ কিলোমিটার। তাহলে ইউওয়াই স্কুটি নক্ষত্রের মাঝবরাবর একটা দাগ টানলে সেটা হবে ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার। বুঝতে পারছো, ওটা কত্ত বড়!

মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় নক্ষত্র ইউওয়াই স্কুটি।
ছবি: ইসো/ ডিজিটাল স্কাই সার্ভে ২

ওটাকে যদি তুমি সৌরজগতের ঠিক মাঝখানে এনে রাখো, তাহলে ওটার আকর্ষণে বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গলসহ বৃহস্পতিও ওর পেটের মধ্যে চলে যাবে।

এখন ভাবতে পারো, এই নক্ষত্র তাহলে আবিষ্কার করলেন কে? এটা জার্মানের বন অবজারভেটরির সাহায্যে ১৮৬০ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা খুঁজে পান। কোনো নক্ষত্রের আলো দেখে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, তা কত বড়। অবশ্য আরও কিছু বিষয় আছে এর সঙ্গে, কিন্তু সেগুলো তোমরা আরও একটু বড় হলে জানতে পারবে।

এবার তোমাদের আরও কিছু বড় নক্ষত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আজকের লেখা শেষ করব। ‘ডব্লিউওএইচ জি৬৪’ ও ‘ডব্লিউওএইচ ৫১৭০’ দুটি বড় নক্ষত্র। এসব নক্ষত্রের চারপাশে ধূলিকণা ঘন মেঘ থাকে। সেই ধূলিকণা এক জায়গায় জড়ো হয়ে আবার নতুন গ্রহ, নক্ষত্র তৈরি করে। এর মধ্যে প্রথমটা পৃথিবী থেকে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। সূর্যের আকারের চেয়ে প্রায় ১ হাজার ৫৪০ গুণ বড়। এ রকম আরও কয়েকটি বড় নক্ষত্র হলো ‘আরএসজিসি১-এফ০১’, ‘এইচডি ২৬৯৫৫১’, ‘সিএম ভেলোরাম’, ‘এইচভি ৮৮৮’ইত্যাদি। এগুলো সবই সূর্য থেকে লাখো আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত ও কয়েক শ গুণ বড়।

ডব্লিউওএইচ জি৬৪ নক্ষত্র।
ছবি: নাসা

তবে ইউভি স্কুটি সবচেয়ে বড় নক্ষত্র হলেও এটা কিন্তু সবচেয়ে ভারী নয়। বড় আর ভারী কিন্তু এক জিনিস নয়। একটা ফুটবল লোহার গোলকের (টেনিস বলের মতো ছোট লোহার বল) চেয়ে অনেক বড়। কিন্তু গোলকের আশপাশেও হবে না ফুটবল ওজন।

ঠিক তেমনি ইউভি স্কুটি সবচেয়ে বড় নক্ষত্র ঠিকই, কিন্তু সবচেয়ে ভারী হলো ‘আর১৩৬এ১’(R136a1)। আমাদের সূর্যের চেয়ে এর ভর প্রায় ১৭০-২৩০ গুণ বেশি।

অনেক ভারী ভারী নক্ষত্রের কথা বলা হলো। এক দিনে এর চেয়ে বেশি বিজ্ঞান নিয়ে বললে তোমরা রাগ করতে পারো। আজ তাই এখানেই শেষ।

সূত্র: হাউ স্টাফ ওয়ার্কস, স্পেস ডটকম ও বিবিসি সায়েন্স ফোকাস

আরও পড়ুন