রাতের আকাশে আমরা তারা, বড়জোর চাঁদ দেখতে অভ্যস্ত। মাঝেমধ্যে দেখা যায় ছুটে যাওয়া কোনো উড়োজাহাজ বা উল্কার ঝলকানি। কিন্তু তুমি যদি উত্তর বা দক্ষিণ মেরুতে বেড়াতে যাও, তাহলে রাতের আকাশজুড়ে দেখবে এক অপার্থিব আলো। চাঁদ বা সূর্যের মতো একরঙা নয় এ আলো। নয় স্থির। সারাক্ষণ যেন নেচে চলেছে এই আলোকশিখা।
বিজ্ঞানীরা এই অবিশ্বাস্য সুন্দর আলোর নাম দিয়েছেন অরোরা বা মেরুজ্যোতি। সাধারণত পৃথিবীর দুই মেরু অঞ্চল ও এর আশপাশের অঞ্চলে মেরুজ্যোতি দেখা যায়।
তবে, অতি সম্প্রতি এই মেরুজ্যোতি দেখা গেছে আমাদের পাশের দেশ ভারত থেকেও! ঘটনাটা মোটেই স্বাভাবিক নয়। ভারতের অবস্থান পৃথিবীর প্রায় মাঝামাঝি অর্থাৎ বিষুবীয় অঞ্চলে। দক্ষিণ মেরু থেকে দেশটির দূরত্ব প্রায় সাড়ে সাত হাজার কিলোমিটার। এত দূরে মেরুজ্যোতি দেখা যাওয়ার কারণ কী? বাংলাদেশ থেকেও কি দেখা যাবে? হচ্ছেটা কী? চলো, জানার চেষ্টা করি।
তোমরা হয়তো জানো, পৃথিবীর চারপাশে আছে এক অদৃশ্য সুরক্ষা বলয়। এটা মূলত পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র। পৃথিবীর কেন্দ্রে আছে প্রচণ্ড উত্তপ্ত এক ধাতব কোর। কোরের চারপাশে আছে গলিত ম্যাগমার আস্তরণ। ফলে, এই কেন্দ্র অবিরাম ঘুরছে। আর তৈরি হচ্ছে তড়িৎচুম্বকের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ। এ কারণেই পৃথিবী নামের এই গ্রহের চারপাশে তৈরি হয় এক অদৃশ্য চৌম্বকক্ষেত্র।
এই চৌম্বকক্ষেত্রকে সুরক্ষা বলয় বলার কারণ আছে। পৃথিবীতে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি আসে সূর্য থেকে। সূর্য এক অতিকায় অগ্নিগোলক। নক্ষত্র। নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে এ নক্ষত্রের বুকে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে শক্তি। অতিকায় হওয়ায় সূর্য থেকে নির্গত শক্তির পরিমাণও প্রচণ্ড। এই শক্তির একটা অংশ পৃথিবীতে আসে আলো হয়ে। বাকি অংশটা আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। না দেখা এই অংশে থাকে গামা রশ্মি, উচ্চ শক্তিসম্পন্ন চার্জিত কণা। এসব রশ্মি ও কণা পৃথিবীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের কল্যাণে এসব চার্জিত কণা ও ক্ষতিকারক রশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে এসে পড়ে না। বিশেষ করে বিষুবীয় অঞ্চলে চৌম্বকক্ষেত্রের প্রাবল্য বেশি হওয়ায় এ অঞ্চলে সূর্যের মারাত্মক থাবা পড়ে না। কিছুটা পড়ে মেরু অঞ্চলে। কারণটা সহজ। মেরু অঞ্চলে চৌম্বকক্ষেত্রের প্রাবল্য তুলনামূলক কম থাকে। সূর্য থেকে আসা চার্জিত কণা সেখানকার চৌম্বক বলয় ভেদ করে ঢুকে পড়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে। তারপর শুরু হয় বায়ুমণ্ডলের খেলা।
স্কুলে আমরা জেনেছি, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে পাঁচটি স্তরে ভাগ করা হয়। সবার ওপরের স্তরের নাম এক্সোস্ফিয়ার বা বহির্মণ্ডল। এর ঠিক নিচেই থার্মোস্ফিয়ার বা তাপমণ্ডলের অবস্থান। আয়নস্ফিয়ার বা আয়নমণ্ডল নামের উপমণ্ডল এই স্তরের একটি অংশ। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে এই অংশ প্রায় ১০০ কিলোমিটার ওপরে অবস্থিত। এখানে প্রচুর চার্জিত বা আয়নিত কণা থাকে। সূর্য থেকে আসা চার্জিত কণা আয়নমণ্ডলের কণাগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। সংঘর্ষের সময় চার্জিত কণাগুলো থেকে নির্গত হয় দৃশ্যমান আলো। এ আলোকেই বলা হয় অরোরা বা মেরুজ্যোতি।
আগেই বলেছি, বিষুবীয় অঞ্চলে চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাব অনেক বেশি হওয়ায় সাধারণ অবস্থায় এখানকার আকাশে অরোরা দেখা যায় না। তবে, সূর্যের সক্রিয়তা ও সৌরঝড়ের পরিমাণ বাড়লে স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটতে পারে।
সম্প্রতি ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী সৌরঝড়ের মুখোমুখি হয় পৃথিবী। সূর্য থেকে বেরিয়ে আসে প্লাজমার এক বিশাল স্রোত। ছোট পরিসরে এমন ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটে সৌর পৃষ্ঠে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় করোনাল ম্যাস ইজেকশন। তবে, এবারের করোনাল ম্যাস ইজেকশনটা ছিল অনেক বড়।
এই তীব্র করোনাল ম্যাস ইজেকশনের কারণেই গত ২২-২৩ এপ্রিল ভারতের সরস্বতী পর্বতের ওপর স্থাপিত ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান মানমন্দির (ইন্ডিয়ান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবজারভেটরি) থেকে দেখা যায় বিরল দৃশ্য। দেশটির লাদাখ অঞ্চলের আকাশে তৈরি হয় এই অরোরা। মেঘমুক্ত পরিষ্কার আকাশ, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজিক্স এক টুইট বার্তায় সেই ঘটনার একটি টাইমল্যাপস ভিডিও প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, তীব্র সৌরঝড় পৃথিবীতে আঘাত করার কারণে এই অরোরার সৃষ্টি হয়েছে।
সূর্য থেকে আসা প্লাজমার স্রোত পৃথিবীকে আঘাত করে ঘণ্টায় প্রায় ২১ লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার বেগে। করোনাল ম্যাস ইজেকশনের সময় এসব কণা সাধারণত ঘণ্টায় প্রায় তিন কোটি কিলোমিটার বেগে মহাশূন্যে ছুটে আসে সূর্য থেকে। পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের বাধায় কমে যায় এদের গতি। কিছু কণা ঢুকে পড়ে পৃথিবীতে। এরপরে কী হয়েছে, তা তো বুঝতেই পারছ।
এখন আসা যাক, বাংলাদেশের প্রসঙ্গে। বাংলাদেশ থেকে কি অরোরা দেখা যাবে? এ প্রশ্নের উত্তর এখনই সঠিকভাবে বলার সুযোগ নেই। কোন অঞ্চলে করোনাল ম্যাস ইজেকশনের প্রভাব পড়বে, তা নির্ভর করে পৃথিবী ও সূর্যের অবস্থানের ওপর।
১৭৭৫ সাল থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সূর্যের সক্রিয়তা (Solar activity) পর্যবেক্ষণ করছেন। দেখা গেছে, সূর্য ১১ বছরের একটি চক্রের মধ্য দিয়ে যায়। প্রতিটি চক্রের কিছু সময় সৌরঝড় বা সৌরশিখার পরিমাণ থাকে কম, কিছু সময় আবার বেশি থাকে। বর্তমানে সূর্য বেশি সক্রিয়তার সময় পার কাছে। দ্য ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা নোয়ার (NOAA) মতে, সূর্যের কম সক্রিয় থাকার সময়ের তুলনায় বর্তমানে প্রায় দ্বিগুণ সানস্পট তৈরি হয়েছে।
সূর্যের সক্রিয়তা বেড়ে যাওয়ার কারণে উচ্চশক্তির আয়নিত কণা, এক্স–রে ও গামা বিকিরণ পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রে আছড়ে পড়ার পরিমাণ বেড়েছে। সে জন্যই ঘটছে বিষুবীয় অঞ্চলে অরোরা তৈরির মতো ঘটনা।
সামনের বছরগুলোয় সৌরশিখার আঘাত আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। সূর্যের সক্রিয়তা স্বাভাবিক হওয়ার আগে আগামী ২০২৫ সালে এটা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এ নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই।