অনেক কাল আগের কথা। সাঁওতাল পুরাণ মতে তখন চারদিকে ছিল শুধু পানি আর পানি। পৃথিবী সৃষ্টির ইচ্ছা প্রকাশ করলেন ঠাকুর জিয়ো (সৃষ্টিকর্তা)। তিনি পানির মধ্যে কাঁকড়া, কুমির, বোয়াল, কাছিম, কেঁচোর মতো জীবের আবির্ভাব ঘটালেন। এরপর মাটি থেকে একজোড়া মানব-মানবী সৃষ্টি করলেন। কিন্তু যখনই তিনি তাদের ভেতর জীবন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তখনই আকাশ থেকে আজব এক ঘোড়া এসে মানব-মানবীর মূর্তিগুলো খেয়ে ফেলে। ঠাকুর জিয়ো এতে কষ্ট পান। পরে তিনি নিজের বুকের অংশ থেকে সৃষ্টি করলেন একজোড়া পাতিহাঁস। হঠাৎ একদিন ওই আজব ঘোড়াটি এসে তাদের গ্রাস করার চেষ্টা করল। ঠাকুর জিয়ো তখনই ঘোড়াটিকে সমুদ্রের ফেনায় পরিণত করলেন। সেই ফেনার পানিতে পাতিহাঁস দুটি মনের আনন্দে ভেসে বেড়াতে থাকল।
কিন্তু এভাবে আর কত দিন? তাদের আশ্রয়ের জন্য মাটি চাই, বাঁচার জন্য চাই খাদ্য। এমন প্রার্থনায় ঠাকুর জিয়ো কাছিমকে নির্দেশ করলেন পানির নিচ থেকে মাটি তুলে আনতে। কাছিম ব্যর্থ হলো। চিংড়িকে বললে, সে-ও চেষ্টা করে সফল হলো না। এভাবে বোয়াল, কাঁকড়া একে একে সবাই ব্যর্থ। রাগান্বিত হয়ে ঠাকুর জিয়ো হুকুম করলেন কেঁচোকে। কেঁচো পানির অতল থেকে মাটি তুলে আনল। তা দিয়ে ঠাকুর জিয়ো আনন্দের সঙ্গে পৃথিবী সৃষ্টি করলেন। পৃথিবীতে স্থাপন করলেন পাহাড়, অরণ্য সবকিছু। সেখানে পাতিহাঁস দুটি বাসা বাঁধে এবং প্রকৃতির নিয়মেই ডিম পাড়ে। সেই ডিম ফুটলে ভেতরে দেখা মিলল দুটি মানবসন্তানের। একটি ছেলে, অন্যটি মেয়ে। ছেলেটির নাম পিলচু হড়ম ও মেয়েটির নাম পিলচু বুড়ি। সাঁওতালরা বিশ্বাস করে, এঁরাই তাঁদের জাতির আদি পিতা-মাতা।
সাঁওতাল জাতির আদি নিবাস ভারতের ছোট নাগপুরের মালভূমি এবং আসামের পাহাড় ও বিস্তীর্ণ অঞ্চল। বাংলাদেশে রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, দিনাজপুর প্রভৃতি জেলায় তারা বসবাস করছে।
সাঁওতালদের সবচেয়ে বড় উত্সবের নাম সোহরাই। ‘শাহার’ শব্দ থেকে এসেছে ‘সোহরাই বা সহরায়’ শব্দটি। যার অর্থ বৃদ্ধি হওয়া। এ উত্সবে মূলত ধনসম্পত্তি ও গরু-বাছুর বৃদ্ধির জন্য বিশেষ আচারের মাধ্যমে বোঙ্গাদের (দেবতা) কাছে আবেদন জানানো হয়। প্রতি পৌষ-মাঘ মাসে আয়োজন চলে উত্সবটির।
পৌষ-মাঘ মাসে গোত্রের সবাই মহতের (প্রধান) উপস্থিতিতে নির্ধারণ করে উত্সবের দিনটিকে। সাত দিন ধরে চলে এই উত্সব।
প্রথম দিনের আনুষ্ঠানিকতাকে সাঁওতালদের ভাষায় বলে ‘উম’। ওই দিন গ্রামের পুরুষেরা জমায়েত হয় একটি মাঠের মধ্যে। সেখানে একটি জায়গায় আতপ চাল দিয়ে ঘেরাও বা বাউন্ডারি তৈরি করা হয়। সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে রাখা হয় সিঁদুর ও পাতার ঠোঙায় সামান্য হাঁড়িয়া বা চুয়ানি। অতঃপর মহৎ সেখানে মুরগি বলি দেন জাহের এরা, মারাঙ্গবুরু, মড়ৈকো, তুরুই কো, গোসাই এরা, পারগানা বোঙ্গা ও অন্যান্য বোঙ্গার উদ্দেশ্যে। প্রতিটি ঘর থেকে দেওয়া হয় বলির মুরগিগুলো। পরে মহতের বাড়িতে রান্না করা হয় খিচুড়ি। খাওয়া চলে তাদের প্রিয় পানীয় হাঁড়িয়া আর চুয়ানি। এভাবে মহতের বাড়িতে রান্নার মধ্য দিয়েই সোহরাই উত্সবের শুভসূচনা ঘটে।
এ পর্ব শেষ হলে প্রতিটি বাড়ির রাখালেরা গাভির মাথায় তেল মেখে গাভিগুলোকে পূজার স্থানে নিয়ে আসে। আগেই একটি স্থানে বিশেষভাবে ডিম রেখে দেওয়া হয়। প্রতি বাড়ি থেকে গাভিগুলোকে তাড়া করে ডিমের জায়গায় দিয়ে নিয়ে যেতে হয়। যে গাভি ওই ডিম ভাঙে বা স্পর্শ করে, সে গাভির মালিককে ভাগ্যবান মনে করেন সাঁওতালরা। তাঁদের বিশ্বাস, সেই ব্যক্তির জমিতে পরবর্তী বছর অধিক ফসল ফলবে।
সোহরাইয়ের দ্বিতীয় দিনকে বলে ‘ডাকা’। ওই দিন প্রতিটি পরিবার তাদের নিকটাত্মীয়দের দাওয়াত করেন। সবার বাড়িতে থাকে ভালো ভালো খাবার। তৃতীয় দিনটি চলে হাস্যরস আর আনন্দের মধ্যে। এ দিনকে বলে ‘খুনটাও’। ওই দিন একটি বাড়ির উঠানে গোল দাগ দিয়ে দাগের ভেতরে খুঁটিতে বেঁধে দেওয়া হয় একটি ষাঁড়। ষাঁড়ের শিং আর গলায় ঝোলানো থাকে তেলের পিঠা। অতঃপর মাদল বা ঢোল বাজানো হয়। মাদলের শব্দে ছটফট করতে থাকে ষাঁড়টি। এ রকম অবস্থাতেই দাগের বাইরে থেকে গোত্রের যুবকেরা হুড়োহুড়ি করে ষাঁড়ের শিং ও গলা থেকে তেলের পিঠা নেওয়ার চেষ্টা করেন। এভাবে পিঠা ছিনিয়ে নেওয়ার আনন্দে মেতে ওঠে গোটা গ্রাম।
উত্সবের চতুর্থ দিনে মাছ বা কাঁকড়া ধরতে সবাই দল বেঁধে জাল আর পলো নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। সাঁওতালরা এটিকে বলে ‘হাকু কাটকোম’। পঞ্চম দিনে আগের চার দিনের ভুলত্রুটি সংশোধন ও পরের দিনগুলোর পরিকল্পনা করা হয়। এটিকে ‘ঝালি’ বলে।
উত্সবের ষষ্ঠ দিনটি মূলত শিকারকেন্দ্রিক। সাঁওতালদের ভাষায় এটি ‘সেন্দ্ররা’। ওই দিন সকালে একদল তির-ধনুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে শিকারে। শিকার থেকে ফিরলে তাদের নিয়ে চলে নানা খেলা। কেমন সেই খেলা?
মাঠে একটি কলাগাছ দাঁড় করিয়ে তার ওপর রাখা হয় মহতের স্ত্রীর হাতের তৈরি তিনটি তেলের পিঠা। দূর থেকে তির-ধনুক দিয়ে যে কলাগাছ লাগাতে পারে, সে-ই হয় বিজয়ী। বিজয়ীকে আবার পালন করতে হয় বেশ কিছু নিয়ম। পাঁচটি ধনুক মাটিতে লম্বালম্বি সাজিয়ে বিজয়ীকে ব্যাঙের মতো লাফিয়ে এর চারদিক ঘুরে মাটিতে থাকা ধনুক একটি একটি করে তুলতে হয় এবং একই নিয়মে আবার মাটিতে সাজাতে হয়। অতঃপর কলাগাছটি গোত্র পরিষদের সদস্যের জন্য পাঁচ বা তিন টুকরো করে বিজয়ী কাঁধে তুলে নেন। এই অবস্থায় বিজয়ীকে সবাই কাঁধে তুলে হইহুল্লড় করে নিয়ে আসেন মহতের বাড়িতে।
এ সময় এখানে সবাইকে আপ্যায়ন করা হয় মুড়ি আর হাঁড়িয়া দিয়ে। শিকারগুলো দিয়ে চলে খিচুড়ি রান্না। আনন্দে ভাসতে থাকে গোটা গ্রাম। উত্সবের সপ্তম দিনটিতে প্রত্যেকে প্রত্যেকের বাড়িতে গিয়ে ভালোমন্দ খাবার খান।
এভাবে নানা লোকাচার, আয়োজন আর ধুমধামের সঙ্গে শেষ হয় সোহরাই উত্সবটি। নানা বৈষম্য, অভাব ও অবহেলায় থাকা সাঁওতালদের চিরচেনা কষ্টগুলোও ভেসে যায় উত্সবের বাঁধভাঙা আনন্দের স্রোতে।