ঢাকার শ্যামলীর শিশুমেলা থেকে যাচ্ছিলাম আগারগাঁও। মেট্রো চেপে যাব। যেতে যেতে রাস্তার এক অংশে দেখি একটা ঘর। ভেতরে অনেকগুলো টায়ার। টায়ারের দোকান হবে হয়তো। বাইরে আদালতের আদেশের ব্যানার ঝোলানো। রাস্তার মাঝখানে এমন অবকাঠামো দেখে শুধু আমি না, অনেকেই থমকে যাচ্ছে। রাস্তার মাঝখানে এমন অদ্ভুত বাড়ি চলাচলের পথে অবাক করে। শুধু আগারগাঁওয়ে এমন বাড়ি আছে? নাকি অন্য জায়গাতেও এমন আজব বাড়ি দেখা যায়?
খুঁজতে গিয়ে দেখলাম চীনের গুয়াংঝুতেও আছে। যাকে বলা হচ্ছে ‘নেইল হাউস’। সোশ্যাল মিডিয়া ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। এক্স হ্যান্ডলে শেয়ার হয়েছে। প্রচুর মানুষ এটি নিয়ে কথা বলছে। ভিডিওতে তুমি দেখতে পাবে, একটি বাড়ি মহাসড়কের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। মহাসড়কের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এই বাড়িকে ‘নেইল হাউস’ বলা হয়। কারণ, বাড়ির মালিকেরা বাড়ি ছেড়ে যেতে অস্বীকার করেছিল। ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণ করতে না পেরে বাড়ির চারপাশে রাস্তা তৈরি করে সরকার। এমন কিছু নেইল হাউসের পেছনের ঘটনা জেনে নিই।
চীনে এমন অনেক বাড়ি আছে
কিছুদিন আগেও বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ ছিল চীন (এখন ভারত চীনকে ছাড়িয়ে গেছে)। দেশটাও বেশ বড়। কিন্তু বাসযোগ্য শহরে মানুষের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই। তাই বসবাসের জন্য ভালো জায়গা খুঁজে পেতে সমস্যায় পড়তে হয় মানুষকে। কিছু মানুষ নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় যেতে চান না। বসবাসের জায়গা দিয়ে যখন রাস্তা তৈরি হয়, তখন বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া এই মানুষদের জন্য কষ্টকর।
এমন এক ছোট বাড়ির মালিক লিয়াং। তিনি বাড়ি থেকে সরতে চাননি, কারণ সরকার তাঁকে একটি ভালো জায়গায় বাড়ি দেওয়ার প্রস্তাব দেয়নি। তাঁকে দুটি ফ্ল্যাট দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রাজি হননি লিয়াং। তিনি তাঁর বাড়ির পরিবর্তে চারটি ফ্ল্যাট দাবি করেন। এক দশক ধরে সরকার তাঁর এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার চেষ্টা করেও সফল হয়নি। লিয়াং নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। তিনি রাজি না হওয়ায় কর্তৃপক্ষ মহাসড়কের ঠিক মাঝখানে বাড়িটি ঘিরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। শেষমেশ মহাসড়কটি নির্মিত হয় এবং তাঁর বাড়ির চারপাশে একটি গাড়ি চলাচলের সেতু নির্মিত হয়।
যুক্তরাজ্যে লিটল হাউস অন দ্য প্রেইরি
যুক্তরাজ্যে এমন একটি বাড়ি আছে। নেইল হাউসের মতোই। তবে এর পেছনের গল্পটি বেশ আলাদা। চীনের মালিকের মতো যুক্তরাজ্যের এই বাড়ির মালিক একগুঁয়ে ছিলেন না। বাড়ি থেকে সরে যেতেও অস্বীকার করেননি। স্টট হল ফার্ম নামে পরিচিত এই বাড়ি রাস্তার মাঝখানে অবস্থিত হওয়ার আসল কারণও অদ্ভুত। যে জমিতে বাড়িটি নির্মিত হয়েছে, সেখানে একটি ‘ভূতাত্ত্বিক অসংগতি’ আছে। মানে বাড়ির নিচের মাটি সমতল বা সমান নয়। খুব খাড়া জমি হওয়ায় রাস্তার ছয়টি লেন তৈরি করা প্রকৌশলীদের মতে অসম্ভব। তাই বাড়িটি সরানো বা রাস্তার জন্য অন্য জায়গা খোঁজার পরিবর্তে প্রকৌশলীরা বাড়ির চারপাশে রাস্তা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। প্রত্যন্ত জায়গায় এই ফার্ম থাকায় এটিকে ‘লিটল হাউস অন দ্য প্রেইরি’ বলা হয়।
চীনের জিনহুয়ায় ইয়ংজি নামের রাস্তায় ইয়াও বুকিংয়ের বাড়ি। রাস্তার ঠিক মাঝখানে। এই বাড়ির কারণে রাস্তাটি চার লেন থেকে দুই লেনের হয়ে গেছে। পাঁচ বছর ধরে বাড়িটি এখানে আছে।
রাস্তার মাঝে থাকা এই বাড়িগুলো ছাড়াও এমন অনেক বাড়ি আছে, যেগুলো বাড়ির মালিক ছাড়তে চাননি। বাধ্য হয়ে এর পাশে রেস্তোরাঁ, রেলস্টেশন অথবা শপিং সেন্টার তৈরি করা হয়েছে।
এডিথ মেসফিল্ডের বাড়ি
যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে বাস করতেন এডিথ মেসফিল্ড। তাঁর ছিল ১০৮ বছরের পুরোনো এক বাড়ি। ডেভেলপাররা তাঁর বাড়ির জায়গার বিনিময়ে দিতে চেয়েছিলেন ১০ লাখ ডলার। এত বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ নিতেও তিনি অস্বীকার করেন। পরে তাঁর বাড়ির পাশে পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল তাঁর জন্য। তবু তিনি সরে যাননি। তাঁর মৃত্যুর পরে বাড়িটি নতুন ডেভেলপারের কাছে দেওয়া হয়। পরে বাড়িটি বিক্রি হয়ে যায়।
অস্টিন স্প্রিগস হাউস
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির একটি বাড়িতে থাকতেন স্প্রিগস। সেখানকার ডেভেলপারদের পরিকল্পনার সঙ্গে তাঁর বাড়িটি মানানসই না হওয়ায় তাঁকে ৩০ লাখ ডলার দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ডেভেলপারদের দিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে তিনি একটি পিৎজার দোকান খোলেন।
চীনের শেনজেনে একটি সাততলা ভবনের মালিক ভবনটি বিক্রি করার জন্য ৩.২ মিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ভবনটির সামনে রেলস্টেশন আছে। একই রকমভাবে চীনের চাংশায় একটি বাড়ির চারপাশে তৈরি করা হয়েছে শপিং মল। আধুনিক শপিং মলের মাঝখানে পুরোনো বাড়ি থাকাটা বেশ অদ্ভুত।
এসব বাড়ির অনেকেই উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পেলে বাড়ি ছেড়ে দেন। কেউ আবার নিজের অধিকারে ছাড় দিতে চান না।
যেমন চীনের চংকিং-এ, ‘উ পরিবার’। দুই বছরের জন্য তাঁদের বাড়ি খালি করতে বলা হয়েছিল। তাঁরা রাজি হননি। তাঁদের বাড়ির চারপাশে গভীর করে খনন করে ডেভেলপার কোম্পানি। তাঁদের বিদ্যুৎ ও পানির সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারটি শেষমেশ ডেভেলপারদের সঙ্গে একটি চুক্তি করে। ক্ষতিপূরণের সঙ্গে পায় একটি নতুন অ্যাপার্টমেন্ট।
অন্যদিকে চীনের ওয়েনলিংয়ে এক বৃদ্ধ দম্পতি ২০০১ সাল থেকে তাদের বাড়ি বিক্রি করতে অস্বীকার করছিলেন। তাঁদের বাড়ির চারপাশে একটি মহাসড়ক এবং একটি রেলস্টেশন তৈরি করা হয়েছিল। পরে মালিকেরা ক্ষতিপূরণ নিতে রাজি হন। অবশেষে বাড়িটিও ভেঙে ফেলা হয়।
এসব বাড়ি যেহেতু অন্যদের কাছে খুব বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে, তাই বিনিময় মূল্য হয় চড়া। যেমন চীনের শেনজেনে কাই ঝুক্সিয়াং এবং ঝাং লিয়ানহাও একটি সাততলা ভবনের মালিক ছিলেন। ডেভেলপাররা চাইছিল বাড়িটি কিনে নিতে। ডেভেলপারদের কাছে বাড়িটি বিক্রি করতে অস্বীকার করেন তাঁরা। এক বছর ধরে লড়াইয়ের পর তাঁরা ডেভেলপারদের প্রস্তাবে রাজি হন। যদিও চুক্তির সঠিক মূল্য প্রকাশ করা হয়নি। তবে এর পরিমাণ প্রায় এক মিলিয়ন ডলার বলে মনে করা হয়।
আগারগাঁওয়ের রাস্তায় নেইল হাউস
আমাদের দেশে রাস্তার ঠিক মাঝখানে এমন একটি বাড়ি আছে। শুরুতেই আগারগাঁওয়ের এই বাড়ির কথা বলেছি। এই বাড়ির পাশ দিয়ে তৈরি হয়েছে ছয় লেনের রাস্তা। সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ রোডে আর্কাইভস ও লাইব্রেরি অধিদপ্তরের সামনে এক টুকরা জমির ওপর এই একতলা ভবনের মালিক নূরজাহান বেগম। তিনি ১৯৬৪ সালে এই জমি কিনেছিলেন। ঢাকায় এটি তাঁর মালিকানাধীন একমাত্র জমি।
নূরজাহান বেগম ও তাঁর ছেলে রহমত উল্লা জমি রক্ষার জন্য আইনি লড়াই করেছেন। রায় এসেছে তাঁদের পক্ষে। উচ্চ আদালতের রায়ে তাঁদের সম্পত্তি আপাতত অক্ষত রাখার পক্ষে এসেছে। এই জমি তাঁদের পরিবারের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি বিক্রি করার কোনো ইচ্ছা তাঁদের নেই। যদিও অনেকের ধারণা, তাঁরা জমির জন্য ন্যায্যমূল্য পেলে হয়তো জমি বিক্রি করতেও পারেন।