ভারতীয় উপমহাদেশে মোগল আমলের বিস্ময়কর পাঁচ স্থাপত্য

পুরান ঢাকায় লোকজীবনের কোলাহল ছাপিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি অসমাপ্ত দুর্গ। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র মোহাম্মদ আজম শাহ এ দুর্গের নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন। তবে তিনি দুর্গটি অসম্পূর্ণ রেখেই দিল্লি ফিরে যান। তাঁর প্রস্থানের পরও এর নির্মাণকাজ চলছিল। কিন্তু নাটকীয়ভাবে তৎকালীন মোগল সুবেদার শায়েস্তা খান দুর্গের কাজ স্থগিত করেন। নিজের কন্যা পরি বিবির অপ্রত্যাশিত মৃত্যুতে তিনি ভেঙে পড়েছিলেন। একসময় তিনি এই মোগল দুর্গকে ‘অপয়া’ বলে আখ্যা দেন এবং এর নির্মাণকাজও বন্ধ করে দেন। বলছি আমাদের অতি পরিচিত লালবাগ কেল্লার কথা। আর পাঁচটি মোগল স্থাপত্যের মতো এই কেল্লার পেছনেও আছে ইতিহাসের গল্প। আজকের লেখাটি এমনই পাঁচ মোগল স্থাপত্য নিয়ে। জানব এর পেছনের গল্প। চলো, জেনে আসি—সম্রাট শাহজাহানের তাজমহল ছাড়াও মোগলদের ঝুলিতে আর কী কী স্থাপত্য আছে!

১. বিবি কা মাকবারা, এ যেন আরেকটি তাজমহল

ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশ অবস্থিত বিবি কা মাকবারা।
ছবি: আইস্টক

তাজমহলের অনুরূপ একটি মোগল সমাধি রয়েছে ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশের আওরঙ্গবাদ অঞ্চলে। ‘বিবি কা মাকবারা’ নামে পরিচিত সেই সমাধিতে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের স্ত্রী দিলরাস বানু বেগম। প্রথম দেখায় কেউ কেউ এই স্থাপনাকে তাজমহল বলে ভুলও করতে পারেন। এটি ডাকখানি তাজ বা দাক্ষিণাত্যের তাজ নামেও পরিচিত। মার্বেল গম্বুজ, মিনারের কারুকাজ ও বাগান–পরিকল্পনায় এর সঙ্গে তাজমহলের দারুণ মিল রয়েছে। এই সমাধি সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে তৈরি হলেও এটি নির্মাণে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাঁর পুত্র আজম শাহ। বিবি কা মাকবারা নির্মিত হয় ১৬৭৮ সালে। তখন তাজমহলের তুলনায় এতে অনেক কম ব্যয় হয়েছিল। এর কারণ, সম্রাট আওরঙ্গজেবের স্থাপত্যশৈলীর প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না। তাঁর সময় নানান যুদ্ধের প্রস্তুতিতে অনেক অর্থ ব্যয় হওয়ায় এই সমাধিতে মার্বেল এবং অন্যান্য দামি পাথর কম ব্যবহার করা হয়েছিল। তাজমহলের তুলনায় কম বিস্তৃত হলেও সমাধিটি এখন ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্র।

আরও পড়ুন

২. বুলন্দ দরওয়াজা, বিজয়ের প্রতীক যে দরজা

বুলন্দ দরওয়াজা, ফতেহপুর সিক্রির প্রবেশদ্বার, উত্তর প্রদেশ, ভারত।
ছবি: আইস্টক

‘যে এই দরওয়াজার নিচে দিয়ে যাবে, সে গুজরাট বিজয়ের সম্মান পাবে’—বাক্যটি খোদিত রয়েছে মোগল সম্রাট আকবরের আদেশে নির্মিত বুলন্দ দরওয়াজায়। ১৪০ ফুট উঁচু এই প্রবেশদ্বার তৈরি করা হয়েছিল সম্রাট আকবরের গুজরাট বিজয়ের প্রতীক হিসেবে। তখন মোগলদের রাজপ্রাসাদ ছিল আগ্রা শহরের বাইরে ফতেহপুর সিক্রি নগরে। ফতেহপুর সিক্রি প্রায় ১৫ বছর মোগলদের সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। ১৫৭৫ সালে ফতেহপুর সিক্রিতে অবস্থিত মূল প্রাসাদের প্রবেশপথে নির্মিত হয় বুলন্দ দরওয়াজা। লাল বেলে পাথর কিংবা রেড স্যান্ডস্টোন দিয়ে তৈরি এই দরওয়াজায় সাদা-কালো মার্বেলের কাজও রয়েছে। এই সুবিশাল কীর্তি যে কেবল সম্রাট আকবর গুজরাটের সুলতান মুহম্মদ হিজাম শাহিকে পরাজিত করেছে—এই বার্তা বহন করে, তা নয়; সম্রাট আকবরের সময় থেকে আজ অবধি, মোগল রাজত্বের আধিপত্য ও সম্রাট আকবরের জৌলুশের নিশানা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে বুলন্দ দরওয়াজা।

৩. হুমায়ুনের সৌধ, যেখানে মোগলদের আড়ম্বরপূর্ণ সমাধি নির্মাণের সূচনা

মোগল সম্রাট হুমায়ুনের সমাধিসৌধের সামনের চিত্র।
ছবি: আনস্প্ল্যাশ

প্রথম মোগল সম্রাট জহিরউদ্দিন মোহাম্মদ বাবর ভারতবর্ষে এসেছিলেন তুরস্ক থেকে। এর আগে তিনি মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল জয় করেছিলেন। তাই মোগলদের নির্মিত ছোট-বড় প্রতিটি স্থাপনায় ভারতীয়, পারস্য এবং তুর্কি স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণ দেখা যায়। এই মিশ্র স্থাপত্যশৈলীর প্রাচীনতম নিদর্শন হলো সম্রাট বাবরের পুত্র সম্রাট হুমায়ুনের সমাধিসৌধ। ভারতের প্রথম গম্বুজযুক্ত মোগল সমাধি ছিল হুমায়ুনের সৌধ। দিল্লিতে অবস্থিত এই সৌধ নির্মাণের উদ্যোগ নেন হুমায়ুনের স্ত্রী হামিদা বানু বেগম। তবে এই সমাধি নির্মাণ শুরু হওয়ার প্রায় ৯ বছর আগেই এক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন সম্রাট হুমায়ুন। সমাধি নির্মাণ শুরু করতে এত দীর্ঘ সময় লাগার কয়েকটি কারণ ছিল। হুমায়ুনের মৃত্যুর পর তাঁর মাত্র ১৩ বছর বয়সী পুত্র আকবর মোগল সাম্রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু তখন রাজ্যজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল, আকবরের সিংহাসন গ্রহণের পরপরই বিদ্রোহ দমন ও যুদ্ধ পরিচালনায় ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলে সেই সময় মোগল কোষাগারে বড় স্থাপনা নির্মাণের মতো পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না। সম্রাট আকবর রাজ্যের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পরই তাঁর পিতার স্মরণে বৃহৎ ও জৌলুশপূর্ণ সমাধি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

আরও পড়ুন

৪. হিরণ মিনার, একটি পোষা হরিণের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ

ড্রোন ক্যামেরায় ধারণ করা হিরণ মিনারের ছবি।
ছবি: আইক্যাম

মোগল আমলে হরিণ থেকে বাঘ পর্যন্ত নানা প্রাণী শিকার করাই ছিল সম্রাটদের সাহসের প্রতীক। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরও ছিলেন দক্ষ শিকারি। তবে অবাক করার মতো বিষয় হলো, শিকারের প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও তিনি একটি পোষা হরিণকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। সেই হরিণের নাম ছিল মনসরাজ। সম্রাটের প্রিয় এই হরিণ কীভাবে মারা গিয়েছিল, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো ঐতিহাসিক বিবরণ নেই। তবে জানা যায়, মনসরাজের মৃত্যুতে সম্রাট গভীরভাবে শোকাহত হন। তিনি হরিণটির স্মরণে ১৬০৬ সালে পাকিস্তানের পাঞ্জাব রাজ্যের শেখুপুরায় এক অনন্য স্থাপনা, হিরণ মিনার নির্মাণ করেন। ১০০ ফুট উঁচু এই মিনারকে ঘিরে রয়েছে চারকোনা একটি বিশাল জলাধার। মোগল আমলে এটি ছিল একটি রাজকীয় বিনোদনকেন্দ্র, যেখানে শিকারের আয়োজনও করা হতো। শিকারের স্থান থেকে পোষা প্রাণীর স্মৃতিস্তম্ভে রূপ নেওয়া হিরণ মিনার এখন পাকিস্তানের অন্যতম দর্শনীয় স্থান।

আরও পড়ুন

৫. লাল কেল্লা, মোগল দুর্গ যা স্বাধীন ভারতের প্রতীক হয়ে উঠেছে

লাহোর গেট, ঐতিহাসিক লাল কেল্লার মূল প্রবেশদ্বার।
ছবি: আইস্টক

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা লাল কেল্লা দখল করে নেয় এবং শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে নির্বাসনে পাঠায়। এর মাধ্যমেই মোগল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং ভারত ব্রিটিশদের শাসনে চলে যায়। তবে লাল কেল্লার ইতিহাস আরও পুরোনো। ১৬৪৮ সালে সম্রাট শাহজাহান আগ্রা থেকে দিল্লি রাজধানী স্থানান্তর করে এ দুর্গ নির্মাণ করেন। ৭৫ ফুট উঁচু, লাল বেলে পাথরের তৈরি এই দুর্গ প্রায় ২০০ বছর মোগল সম্রাটদের বাসভবন ছিল। কেল্লার দুটি বিখ্যাত প্রবেশদ্বার লাহোর গেট ও দিল্লি গেট, যেখানে কড়া পাহারায় থাকত মোগল সেনারা। ভেতরে ছিল দেওয়ান-ই-আম ও দেওয়ান-ই-খাস, যেখানে সম্রাটরা দরবার বসাতেন। এ ছাড়া শাহি মসজিদ ও বেহেশতি বাগান ছিল এর অন্যতম অংশ। ১৭৩৯ সালে পারস্যের নাদির শাহ এই কেল্লায় আক্রমণ চালিয়ে বিখ্যাত ময়ূরসিংহাসন লুট করেন। এরপর দীর্ঘ সময় লাল কেল্লা মোগল সাম্রাজ্যের প্রতীক থাকলেও ১৮৫৭ সালে এটা ব্রিটিশদের দখলে চলে যায়, যা ভারতের সার্বভৌমত্বের ওপর বড় আঘাত ছিল। এর প্রায় ৯০ বছর পর, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট, স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু লাহোর গেটের সামনে ভারতের পতাকা উত্তোলন করেন। সেই মুহূর্তে লাল কেল্লা শুধু মোগলদের দুর্গ হিসেবে নয়, ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও বিজয়ের প্রতীক হিসেবেও ইতিহাসে জায়গা করে নেয়।

এই পাঁচ স্থাপত্যের বাইরেও মোগলদের অসংখ্য কীর্তি ছড়িয়ে আছে ভারতীয় উপমহাদেশজুড়ে। মোগলদের প্রতিটি স্থাপনাই তাদের সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য, শৌর্য ও শিল্পজ্ঞান প্রদর্শন করে, যা আজকের দিনেও বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।

আরও পড়ুন