হস্তিনাপুরের রাজা দুষ্মন্ত ও রানি শকুন্তলার ছেলে ভরত। তিনি রাজা হয়ে সিংহাসনে বসে দক্ষিণ এশিয়ার বিশাল একটি অঞ্চল দখল করে রাজত্ব শুরু করেন। তাঁর নামানুসারে সেই অঞ্চলের নাম হয় ভারতবর্ষ। যদিও ভারত নামকরণে আরও কয়েকটি মত প্রচলিত আছে।
পুরাণ ঘাঁটলে ভারতবর্ষ অঞ্চলের বিস্তার সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। দক্ষিণে বিশাল সমুদ্র ও উত্তরে বরফের আবাস—এমন বর্ণনা থেকে ধারণা করা যায়, ভারতবর্ষের ভৌগোলিক অবস্থান বর্তমান ইন্ডিয়া ও তার আশপাশের অঞ্চলজুড়েই ছিল। রাজা ভরতের পর এই অঞ্চলে যুগে যুগে বহু শাসক এসেছেন। বিভিন্ন যুদ্ধবিগ্রহে ধীরে ধীরে ভারতবর্ষ ভাগ হতে থাকে। ভিন্ন দেশ থেকে নতুন অধিবাসীরা আসেন। একেক অঞ্চল একেক শাসকের হাতে চলে যায়। কালের পরিক্রমায় ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে যাওয়ার পর এর নামেরও পরিবর্তন হয়।
সম্প্রতি পুরাণ ও এই অঞ্চলের নামের আদিকথা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু হয়েছে হঠাৎ করে ভারতীয় সংসদের একটি জরুরি অধিবেশন ডাকার ফলে। গুঞ্জন রয়েছে, খুব দ্রুত ভারতের দাপ্তরিক নাম ‘ইন্ডিয়া’ বদলে আবার ভারত করার জন্যই এই অধিবেশন। এই গুঞ্জনটা অবশ্য জোরেশোরে ওঠে গত সেপ্টেম্বরে। ভারতের রাজধানী দিল্লিতে আয়োজিত জি-২০ সামিটের ইংরেজি লিফলেট, ব্যানারে ‘ইন্ডিয়া’ নামের পাশাপাশি ‘ভারত’ নামের দেখা মেলে। এমনকি রাষ্ট্রপতি ভবনে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্য এক নৈশভোজের আমন্ত্রণেও দেখা যায়, রাষ্ট্রপতিকে সবাই ‘ভারতের রাষ্ট্রপতি’ বলেই সম্বোধন করছেন।
কিন্তু হঠাৎ করেই কেন নামবদলের এই তোড়জোড়, ইন্ডিয়া থেকে ভারতই কেন কিংবা ভারতবর্ষের নামই-বা কেমন করে ইন্ডিয়া হয়ে গেল, তা জানতে হলে ইতিহাসের পাতা ওলটাতেই হয়।
ভারতবর্ষে যখন অন্যান্য দেশের অধিবাসীরা রাজত্ব শুরু করেন, তখন এই অঞ্চলে প্রবহমান সিন্ধু নদীর নামানুসারে এখানকার অধিবাসীদের ডাকতে শুরু করা হয়। কিন্তু তাঁদের ভাষাগত পার্থক্যের কারণে সিন্ধু নামের অপভ্রংশ হয় ‘হিন্দু’। আনুমানিক ৫২৮ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে এই হিন্দু নামের শেষে ফারসি শব্দ ‘স্তান’ জুড়ে দিয়ে এই অঞ্চলের নাম হয় হিন্দুস্তান।
প্রায় সমসাময়িক কালেই এই ‘হিন্দু’ শব্দটি ছড়িয়ে পড়ে গ্রিকদের কাছে। কিন্তু প্রাচীন গ্রিক ভাষায় ‘হ’ বর্ণের উচ্চারণ ছিল ঊহ্য। সেখান থেকেই জন্ম হয় ইন্ডিয়ার মূল শব্দ ‘ইন্দ’-এর। গ্রিকরাই প্রথম সিন্ধুকে ‘ইন্দু’ হিসেবে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এখনকার ইন্ডিয়া শব্দটির আগমন মূলত লাতিন হয়ে ইংরেজি ভাষায় হলেও পরবর্তী সময়ে ফরাসি ভাষার প্রভাবে ‘ইন্দু’ হয়ে যায় ‘ইন্দে’।
পরে লাতিন, স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ ভাষার বিস্তারের ফলে আবার ইন্ডিয়া শব্দের পুনরুত্থান হয়। যার উল্লেখ পাওয়া যায় কিং জেমসের বাইবেল এবং প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও নাট্যকার উইলিয়াম শেকসপিয়ারের বিভিন্ন লেখায়। তবে এসবই বিদেশিদের দেওয়া নাম। ষোলো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই অঞ্চলের অধিবাসীরা নিজেদের জন্মভূমিকে পার্সিক নাম ‘হিন্দুস্তান’ বলেই ডাকতেন। তবে এখানে ব্রিটিশদের রাজত্ব শুরুর পর আঠারো শতকের শেষের দিকে ব্রিটিশ মানচিত্রে এই অঞ্চলকে ‘ইন্ডিয়া’ বলেই উল্লেখ করা হয়। এর পর থেকেই অধিবাসীদের কাছেও ইন্ডিয়া নামটি গ্রহণযোগ্যতা পেতে থাকে।
ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ শাসকেরা বিদায় নিয়েছে অর্ধশত বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে হয়েছে কয়েকটি আলাদা রাষ্ট্র। তবু দলিলে-দপ্তরে রয়ে গেছে ব্রিটিশদের দেওয়া নাম। দেশভাগের পর ১৯৫১ সালে ভারতের সংবিধান কার্যকর হলে সেখানে ‘হিন্দুস্তান’ নামটি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে থেকে যায় ইন্ডিয়া নামটি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই নামই প্রাধান্য পায়। সংবিধানে থেকে যায় ভারত নামটিও। সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদেই ইন্ডিয়াকে ভারত নামেও উল্লেখ করা হয়েছে; অর্থাৎ যা ইন্ডিয়া, তা-ই ভারত। তার মানে, দুটি নামই ভারতের সব ধরনের দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার করা যাবে।
সব মিলিয়ে সংসদের অধিবেশনে ইন্ডিয়া নাম বদলে শুধুই ভারত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কি না, ব্যাপারটি এখনো নিশ্চিত না হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে এটি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলের সদস্যদের অনেকেই বিরোধিতা করেছে এই উদ্যোগের। আবার অনেকে সাদরে গ্রহণও করছে। তারা বিদেশিদের দেওয়া নামের বদলে নিজের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বাহক নামটিকেই আবার ফিরে পেতে চাইছে রাষ্ট্রীয় পরিচয় হিসেবে। অনেক জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বও এরই মধ্যে ভারত নামটি নিয়ে তাঁদের অনুভূতি টুইট করে জানিয়েছেন। ভারতীয় ক্রিকেটার বীরেন্দ্রর শেবাগ টুইটারে বিসিসিআইয়ের কাছে আরজি জানিয়েছেন, ভারতীয় ক্রিকেট দলের জার্সিতেও ইন্ডিয়া নামের বদলে যেন ভারত নামটি ব্যবহার করা হয়।
শেষ পর্যন্ত ভারতের নাম শুধুই ভারত হচ্ছে, নাকি ইন্ডিয়া নামটিও থেকেই যাচ্ছে, সে প্রশ্নের উত্তর সহসাই জানা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে এই আলোচনা যে আরও বহু দূর গড়াবে, সেটা সুনিশ্চিতই।