তোমরা ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য চেম্বার অব সিক্রেটস’ গল্প বা সিনেমায় বেসিলিস্কের সম্পর্কে নিশ্চয় জেনেছ। বেসিলিস্ক একটি দৈত্যাকার সাপ, যার বড় বড় হলুদ চোখ দুটির দিকে সরাসরি যে তাকাবে, সঙ্গে সঙ্গে তার মৃত্যু হবে। কিন্তু কেউ যদি তার চোখের দিকে সরাসরি না তাকিয়ে প্রতিফলনের মাধ্যমে তাকায় অর্থাৎ কোনো ক্যামেরা, আয়না বা প্রতিফলিত হয়, এমন কিছুর মাধ্যমে তাকায়, তবে সে তৎক্ষণাৎ একদম পাথরের মতো হয়ে যাবে।
যদি বলি, হ্যারি পটারের বেসিলিস্কের মতো বাস্তবেও প্রাণীরা পাথর হয়ে যায়, তবে কি বিশ্বাস করবে? পূর্ব আফ্রিকার একটি দেশ তানজানিয়ায় আছে এমন একটি হ্রদ বা লেক। নাম ‘লেক ন্যাট্রন’। শোনা যায়, এই হ্রদে যে প্রাণী যায়, হ্রদের পানির ছোঁয়া লাগলেই নাকি প্রাণীটি পাথর বা মমিতে পরিণত হয়।
ভয়ংকর শোনাচ্ছে না? আসলেই কি হ্রদটি প্রাণীদের পাথরে পরিণত করে? হ্রদ সম্পর্কে প্রচলিত খবর যেমন ভয়ানক তেমনি হ্রদটি দেখতেও অনেকটা ভয় পাওয়ার মতোই। লেক ন্যাট্রন আর সব হ্রদের মতো সুন্দর হ্রদ নয়। এটি মূলত এর অদ্ভুত রূপ এবং ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসের জন্য পরিচিত। হ্রদটি চমৎকার, তবে ভয়ংকর রক্তিম লাল রঙের চেহারার কারণে হ্রদটিকে ‘ডেডলি রেড লেক’ বলা হয়।
হ্রদটির এমন রং হওয়ার কারণ, হ্রদের পাশে থাকা ‘ওল ডোইনিও লেংগাই’ নামের একটি আগ্নেয়গিরি। এটিই একমাত্র সক্রিয় আগ্নেয়গিরি, যা ন্যাট্রোকার্বোনাটাইট নামে খুব বিরল একটি কার্বোনাইট লাভা নির্গত করে। সোডিয়াম কার্বোনাইট, সঙ্গে অন্যান্য উচ্চ ঘনত্বের সব খনিজ পদার্থ পাহাড় বেয়ে হ্রদে প্রবেশ করে হ্রদকে রক্তিম লাল রঙে রূপ দেয়, ক্ষারীয় করে তোলে। লেক ন্যাট্রনের পানি অতিরিক্ত ক্ষারীয় এবং লবণাক্ত। পানির পিএইচ স্তর ১০.৫–এরও বেশি। পিএইচ বেশি মানে বেশি ক্ষার। প্রচণ্ড ক্ষারের ফলে পানিতে কোনো জলজ প্রাণী নেই। পানিতে আগ্নেয়গিরি থেকে আসা লাভা মিশ্রিত হওয়ায় কোনো প্রাণী সেই পানি ছুঁতে বা পান করতে পারে না।
হ্রদটি সম্পর্কে প্রচলিত গল্পের পেছনের কিছু কারণ এগুলো। কারণ, প্রাণীদের মৃত্যু যদি ঘটে তবে তা পানিতে থাকা অতিরিক্ত লবণ এবং ক্ষারের কারণে ঘটে। অনেকেই হয়তো জানে না, প্রাচীন মিসরীয় মমিকরণ পদ্ধতিতে সোডিয়াম কার্বনেট ব্যবহার করা হয়েছিল। বিশ্বাস করা হয়, যেসব প্রাণী লেক ন্যাট্রনের পানিতে প্রাণ হারিয়েছে, পাথর বা মমি হয়েছে তারাও একই পদ্ধতির শিকার হয়েছে। তবে এ বিষয়ের কোনো শক্ত প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।
লেক ন্যাট্রনের ঝাঁজালো রাসায়নিক গঠন এর চারপাশে একটি বিরূপ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। তবু হ্রদটি চরম পরিস্থিতিতে কিছু প্রাণীকে বেঁচে থাকার জন্য সহায়তা করে। এর মধ্যে আছে ‘লেসার ফ্লেমিঙ্গো’। যার বৈজ্ঞানিক নাম ‘ফিনিকোনিয়াস মাইনর’। এটি ফ্লেমিঙ্গোদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট প্রজাতির ফ্লেমিঙ্গো। এই ফ্লেমিঙ্গোরা লেক ন্যাট্রনের সব ধরনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছে। এই ফ্লেমিঙ্গোর আছে বিশেষ লবণগ্রন্থি। যা তাদের খাদ্য থেকে শোষিত অতিরিক্ত লবণ বের করে দিতে সাহায্য করে। এই সুন্দর পাখিরা হ্রদের অতিমাত্রার ক্ষারীয় পানিতে জন্ম নেওয়া নীল-সবুজ শৈবাল এবং সায়ানোব্যাকটেরিয়া খায়। লেক ন্যাট্রনে অন্য পাখি পানি খেলে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে পড়ে এবং লবণে ঢেকে গিয়ে মমি হয়ে যায়। তাই সত্যি সত্যিই পাখিরা এখানে পাথরে পরিণত হয়।