ছোটবেলায় কেউ যখন আমাকে জিজ্ঞাসা করত, ‘বড় হয়ে তুমি কী হবে?’ তখন আমি চট করে বলতাম, ‘ট্রাকের ড্রাইভার হব!’ মাঝেমধ্যে পুলিশও হতে চাইতাম। আমার এ ইচ্ছার পেছনে অনেক কারণই ছিল হয়তো। কিন্তু একটা কারণ ছিল গাড়ি! শুক্রবারে বিটিভিতে বাংলা সিনেমা দেখতাম সবার সঙ্গে। সিনেমায় নায়ক বা ভিলেনদের ছাদখোলা জিপ দেখলেই চালাতে ইচ্ছা করত। এরপর আবিষ্কার করলাম, টিম নাইট রাইডার নামের একটা টিভি সিরিজ। এটাও প্রচার হতো বিটিভিতেই। ওই সিরিজে বেশ কিছু গাড়ি ছিল, যেগুলো নিজেদের মধ্যে কথা বলত! এটা দেখে আরও বেড়ে গেল আমার গাড়িবিষয়ক পাগলামি। পাগলামির মাত্রা চূড়ান্ত রূপ পেল এসএসসি পরীক্ষার পর। তখন প্রথমবারের মতো ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস মুভি সিরিজের মুভি টু ফাস্ট টু ফিউরিয়াস দেখলাম! একটা বিশাল বিল্ডিংয়ের মধ্য থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গাড়ি বের হয়ে আসছে...এই দৃশ্যটা এখনো আমার চোখে ভাসে। এই সিরিজের আরও কয়েকটা মুভি দেখে ফেললাম। পল ওয়াকার আর ভিন ডিজেলদের সঙ্গে তাদের ড্রাইভ করা গাড়িগুলোরও ভক্ত হয়ে পড়লাম খুব দ্রুতই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় ‘ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস’ সিরিজের মুভিগুলো বেশ কয়েকবার দেখা হয়ে গিয়েছিল আমার। তত দিনে ইন্টারনেটের কল্যাণে বিভিন্ন গাড়ির মডেল চিনতে শুরু করেছি। যদিও বাংলাদেশে জাপানিজ গাড়িগুলোর জনপ্রিয়তা অনেক বেশি, কিন্তু বন্ধু সুজয় আর আমার বেশি আগ্রহ ছিল ক্ল্যাসিক আমেরিকান গাড়ির প্রতি। সত্তর-আশির দশকের ফোর্ডের মাস্টাং, শেভ্রোলেটের ক্যামেরো, পন্টিয়াক জিটিও—এসব গাড়ির ভিডিও আর ওয়ালপেপারে ভরা ছিল আমাদের কম্পিউটারের ড্রাইভ। বেশ কয়েক বছর পরের কথা। পড়াশোনা শেষ করে যে যার মতো ক্যারিয়ার বেছে নিয়েছি। একবার এক খেলনার দোকানে পেয়ে গেলাম শেভ্রোলেট শেভেল গাড়ির একটা হট হুইলস মডেল। মডেলটি দেখে আমার মাথায় এল, বাস্তবের পছন্দের গাড়িগুলো হয়তো কোনো দিন পাওয়া হবে না। কিন্তু গাড়িগুলোর মডেল পেলে তো মন্দ হয় না!
সেই থেকেই আমার যাত্রা শুরু মডেল গাড়ির জগতে। সংগ্রহ করার চেষ্টা করি পছন্দের মডেলের গাড়ি। জনপ্রিয় টিভি সিরিজ, অ্যানিমেশন আর মুভির পরিচিত গাড়ির মডেলগুলোও সংগ্রহের চেষ্টা করি আমি। আগে শখ ছিল ছবি আঁকা। এখন ছবি আঁকা আমার পেশা। তবে নতুন আরেকটা শখের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলাম। মডেল গাড়ি সংগ্রহ করে এদের ছবি তোলা আর মডেল গাড়ির জন্য ডায়োরামা বানানো হয়ে উঠল আমার নতুন শখ। কাজকর্মের ফাঁকে সুযোগ পেলেই চেষ্টা করি মডেল গাড়ির ফটোগ্রাফি করতে। আর খেলনার দোকান ঘুরে ঘুরে পছন্দের মডেল সংগ্রহ করাতেও খুঁজে পাই অন্য রকম আনন্দ। এ পর্যন্ত আমার সংগ্রহে আছে প্রায় দেড় শ মডেল গাড়ি। এর মধ্যে আছে ব্যাটমোবিল, ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াসের বেশ কিছু গাড়ির মডেল, ব্রেকিং ব্যাড সিরিজের আরভি থেকে মিস্টার বিনের বিখ্যাত মিনির মডেলও।
মডেল গাড়ির ধরনধারণ আর পরিচিত মডেল ব্র্যান্ড
বিভিন্ন ধরনের মডেল গাড়ি পাওয়া যায়। এই মডেলগুলোর ম্যাটেরিয়াল হিসেবে সাধারণত ব্যবহার করা হয় মেটাল, প্লাস্টিক, রেজিন ইত্যাদি। ডাইকাস্ট পদ্ধতিতে মেটাল দিয়ে যে মডেলগুলো তৈরি হয়, সেগুলো ডাইকাস্ট মডেল হিসেবেই বেশি পরিচিত। আর মডেলের ক্ষেত্রে সবাই যে বিষয়টির প্রতি সবচেয়ে বেশি নজয় দেয়, তা হলো স্কেল। সাধারণত ১: ৬৪, ১: ৪৩, ১: ৩২, ১: ২৪ আর ১: ১৮ স্কেলের মডেলগুলোর চাহিদাই বেশি। এর মধ্যে হট হুইলস, ম্যাচবক্স, টমিকা—এসব ব্র্যান্ড তুলনামূলক সহজলভ্য। এই ব্র্যান্ডগুলোর কল্যাণে ১: ৬৪ স্কেলের মডেলগুলোই বেশি জনপ্রিয়।
তবে দুনিয়াজুড়ে অনেক ব্র্যান্ডই স্কেল মডেল গাড়ি তৈরি করে। এদের মধ্যে হট হুইলস, ম্যাচবক্স, গ্রিনলাইট, টমিকা, অক্সফোর্ড, অটোআর্ট, মাটিসো, ওয়েলি, এমটু মেকানিস, সলিডো, বুরাগো, মেজোরেট, শুকো, মিনি জিটি—এই ব্র্যান্ডগুলো বেশ জনপ্রিয়। পুরোনো ব্র্যান্ডের মধ্যে কর্গি, ডিংকি টয়সের মতো ব্র্যান্ড পুরোনো সংগ্রাহকদের কাছে নস্টালজিয়ার অপর নাম। এই ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে অনেককেই আবার কালেক্টর গ্রেড হিসেবে মানেন না সিরিয়াস সংগ্রাহকেরা। কোনো মডেল টয় গ্রেড বা কালেক্টর গ্রেডের কি না, তা নিয়ে কথা বলতে গেলে বিরাট ইতিহাস লিখতে হবে, সে নাহয় আরেক দিন লিখব।
শখ হিসেবে বাংলাদেশে মডেল গাড়ির জনপ্রিয়তা
মডেল গাড়ি সংগ্রহ শুরুর পর দেখলাম বাংলাদেশের মডেল গাড়ি সংগ্রাহকদের বিভিন্ন গ্রুপ আছে। ফেসবুকেই অনেক গ্রুপ আছে, যেখানে সংগ্রাহকেরা নিজেদের সংগ্রহে থাকা মডেল গাড়ির ছবি আর খোঁজখবর শেয়ার করেন। করেন কেনাবেচাও। DCBD (Diecast Collectors Of BD) অন্যতম পরিচিত একটি গ্রুপ। গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডমিন জহির ইবনে মজিব জানান, শখ থেকেই গ্রুপটা শুরু করেছিলেন তিনি। যাঁরা মডেল গাড়ি সংগ্রহ করেন, তাঁদের সংগ্রহ শেয়ার করাই গ্রুপের উদ্দেশ্য। ২০১৫ সালে যাত্রা শুরু করা এই গ্রুপে বর্তমানে ছয় হাজার সদস্য।
আরেকজন সংগ্রাহক শরিফুল ইসলাম জানান, ইউটিউবে Initial D নামের একটা অ্যানিমের ক্লিপ দেখার পর থেকেই গাড়ির প্রতি ভালোবাসা জন্মায় তাঁর। তখন থেকেই মডেল গাড়ি সংগ্রহ করছেন তিনি। শুরুটা হট হুইলসের মডেল দিয়ে। এখন অটো আর্টের মডেলও সংগ্রহ করছেন। শরিফুল জানান, দেশে ফেরারি, ল্যাম্বরগিনি আর জাপানিজ ব্র্যান্ডগুলোর মডেল গাড়ির চাহিদা বেশি। বাংলাদেশে সংগ্রাহকদের মধ্যে আরেকজন পরিচিত মুখ সাইফুল হাসান। পেশায় স্থপতি ও শিক্ষক সাইফুলের শুরুটাও হট হুইলসের মডেল দিয়েই। ১: ৬৪ থেকে ১: ১৮ মোটামুটি সব স্কেলের মডেল আছে তাঁর সংগ্রহে। ভালোবাসেন মডেলের জন্য ডায়োরামা বানাতে। নিজের তৈরি ডায়োরামাতে করেন মডেল গাড়ির ফটোগ্রাফি।
দেশের বেশির ভাগ সংগ্রাহকই চেষ্টা করেন নিজেদের পছন্দের গাড়ির মডেল সংগ্রহ করতে আর সুযোগ পেলেই সে মডেলগুলোর ছবি তুলতে। সাধারণত সুপার কার, বিভিন্ন মুভি-টিভি সিরিজের গাড়ি, জাপানিজ গাড়িগুলোর মডেলের চাহিদা সংগ্রাহকদের মধ্যে বেশি থাকে। কেউ কেউ বিভিন্ন ব্র্যান্ড আর স্কেলের মডেল সংগ্রহ করেন আবার কেউ আছেন, যাঁরা শুধু একটি ব্র্যান্ডের বা একটি স্কেলের মডেল গাড়ি সংগ্রহ করে থাকেন।
মডেল গাড়ির দরদাম
বর্তমানে বাংলাদেশের বাজারে মডেল গাড়ির দাম শুরু হয় ১৮০ টাকা থেকে। সে দাম এক লাখ টাকাও পেরোতে পারে। দরদাম নির্ভর করে ব্র্যান্ড, স্কেল আর রিলিজের ওপর। রিলিজ যত বেশি পুরোনো হয় আর ডিটেইল থাকে, দাম তত বেড়ে যায় ওই মডেল গাড়ির। হট হুইলসের মডেলগুলোই সাধারণত সবচেয়ে কম দামে পাওয়া যায়। কয়েক বছর আগেও দেশের বিভিন্ন সুপার শপ আর খেলনার দোকানে ১৫০ টাকায় হট হুইলসের রেগুলার মডেল আর ২৫০-৩০০ টাকায় ম্যাচবক্সের রেগুলার মডেলগুলো পাওয়া যেত। কোভিডের কারণে দীর্ঘদিন শিপমেন্ট বন্ধ থাকায় এখন সেই গাড়ির দাম শুরু হয় ১৮০-২০০ টাকা থেকে। চাহিদা বুঝে আরও বেশিও হতে পারে। রেগুলার টমিকা ব্র্যান্ডের মডেলগুলোর দাম ৬০০ টাকা থেকে শুরু হয়। আবার একই ব্র্যান্ডের প্রিমিয়াম মডেলগুলোর দাম সাধারণত বেশি হয়। গ্রিনলাইট, মিনি জিটি ব্র্যান্ডের মডেলগুলোর দাম ১০০০ থেকে ১ হাজার ২০০ দিয়ে শুরু হয়। মডেল জগতে অটো আর্ট ব্র্যান্ডের গাড়িগুলোর ডিটেইল এবং দাম সাধারণত বেশি হয়।
মডেল গাড়ির যত্নআত্তি
মডেল গাড়ি সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে যে ব্যাপারটি চলে আসে, সেটি হচ্ছে এদের যত্নআত্তি! ধুলাবালু, রোদ আর স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ থেকে মডেল গাড়ির রং আর ফিনিশিংকে বাঁচাতে সংগ্রাহকেরা সাধারণত মডেলকে অ্যাক্রিলিক বক্স, কাচের দরজাওয়ালা শেলফ বা পিভিসি বক্সে রাখেন। মাঝেমধ্যে ধুলাবালু পরিষ্কার করার জন্য অনেকেই ব্যবহার করেন মাইক্রো-ফাইবার কাপড় আর মেক-আপের জন্য ব্যবহৃত ব্রাশ। বড় স্কেলের গাড়িগুলোর জন্য পলিশিং ম্যাটেরিয়ালও ব্যবহার করেন পেশাদার সংগ্রাহকেরা।
তো এই গেল মডেল গাড়ির জগতে বিচরণ নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা। যাঁরা মডেল গাড়ি সংগ্রহ করেন, তাঁদের সবারই শখের শুরু গাড়ির প্রতি ভালোবাসা থেকে। পছন্দের গাড়ির মডেল হাতে পেলেই চোখ চকচক করে ওঠে সংগ্রাহকদের। গাড়ির ছবি তোলার মধ্যেও আছে অন্য রকম আনন্দ। কিশোর আলোর যে বন্ধুরা এই শখে নতুন করে আসতে চাও, তাদের জন্য নিজের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া একটা শিক্ষার কথা বলে লেখাটা শেষ করছি। শিক্ষাটা হলো, এই শখ যেন কোনোভাবেই নেশাতে পরিণত না হয়। যেহেতু গাড়ির মডেলের মোটামুটি দাম আছে, তাই এই শখটা একটু খরচের। তাই নতুনরা কোনোভাবেই নিজের বাজেটের বাইরের কোনো মডেল কিনবে না। একসঙ্গে সব পছন্দের মডেল না কিনে আস্তে আস্তে একটা–দুটো করে কিনলেই একসময় গিয়ে দেখা যায়, নিজের পছন্দের বেশ বড় একটা সংগ্রহ দাঁড়িয়ে গিয়েছে। তোমার সঙ্গে সঙ্গে বড় হবে তোমার সংগ্রহ—এটাই তো শখের মজা। কী বলো?