চায়ে মাইক্রোপ্লাস্টিক, চা খাওয়া কি বন্ধ করে দিতে হবে

টি–ব্যাগ থেকে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা বা মাইক্রোপ্লাস্টিক তৈরি হয়ছবি: পেক্সেলস

চা খায় না এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। চা বানাতে এখন লোকে সাধারণত টি–ব্যাগ ব্যবহার করে। লোকে বলেন, টি–ব্যাগে থাকে মাইক্রোপ্লাস্টিক। প্রশ্ন হলো, এর কি কোনো ভিত্তি আছে? আসলেই কি টি–ব্যাগে মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকে? টি–ব্যাগে যদি মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকে, তবে এ থেকে বাঁচার উপায় কী? আমারা চা খাওয়া ছেড়ে দেব?

প্লাস্টিক আছে, এমন সবকিছুতেই আছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। কাপড়, পানির বোতল, প্যাকেট ইত্যাদিতে থাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা। এ রকম কণাযুক্ত বস্তুর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। এখন কিছু টি–ব্যাগও এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে। ২০২৪ সালের একটি গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন, প্লাস্টিক (পলিপ্রোপিলিন) দিয়ে তৈরি টি–ব্যাগ দিয়ে চা বানালে প্রতি মিলিলিটার চায়ে থাকে প্রায় ১.২ বিলিয়ন ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা। এটি বেশ বড় একটি সংখ্যা।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মাইক্রোপ্লাস্টিকের সংস্পর্শ নিয়ে সতর্ক হওয়া ভালো। তবে এখনই চা খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার মতো যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আমরা এখনো জানি না, এ ধরনের মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কি না। আদৌ কোনো ক্ষতি করে কি না, এখনো জানা যায়নি।

সব টি–ব্যাগে কি মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকে?

টি–ব্যাগ বিভিন্ন ধরনের উপাদান দিয়ে তৈরি হয়। অনেক ব্যাগ কাগজ দিয়ে তৈরি। কাগজ উদ্ভিদতন্তু দিয়ে তৈরি হয়। যেমন সেলুলোজ, কাঠ এবং শণ দিয়ে তৈরি হয় এখনকার টি–ব্যাগ। কিছু নমনীয় প্লাস্টিক যেমন নাইলন এবং পলিপ্রোপিলিন দিয়েও তৈরি হয়। কিছু চায়ের ব্যাগ আবার পলিল্যাকটিক অ্যাসিডের মতো নতুন ধরনের বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি হয়।

কাগজের টি–ব্যাগ প্লাস্টিকের টি–ব্যাগের তুলনায় তুলনামূলক কম মাইক্রোপ্লাস্টিক ছাড়ে বলে মনে করেন দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে গবেষণা করা পোস্টডক্টরাল ফেলো হেইলি ই হ্যাম্পসন। তবে আমাদের চায়ের ব্যাগটি কোন উপাদানে তৈরি, তা খুঁজে বের করা সব সময় সহজ কাজ নয়।

সাধারণত সব চায়ের কোম্পানি দাবি করে, তাদের চায়ের ব্যাগ মাইক্রোপ্লাস্টিকমুক্ত। কারণ, সেগুলো মূলত কাগজ বা অন্যান্য উদ্ভিদভিত্তিক উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কাগজের চায়ের ব্যাগও প্লাস্টিকমুক্ত নয়। কিছু ব্যাগ নমনীয় প্লাস্টিক, যেমন পলিপ্রোপিলিন দিয়ে সিল করা থাকতে পারে। আবার কোনো ব্যাগের সুতার ওপর একটি প্লাস্টিকের প্রলেপ থাকতে পারে।

২০২১ সালের একটি গবেষণায় ইউরোপের গবেষকেরা আয়ারল্যান্ড থেকে কেনা ছয়টি ব্র্যান্ডের চায়ের ব্যাগের মধ্যে পাঁচটিতে প্লাস্টিক পেয়েছেন, যার মধ্যে চারটি কাগজ দিয়ে তৈরি বলে মনে হয়েছে। আসলে টি–ব্যাগে প্লাস্টিক প্রবেশের অনেক গোপন পথ আছে, বলছেন গবেষকেরা।

আরও পড়ুন

মাইক্রোপ্লাস্টিক কি স্বাস্থ্যের ক্ষতি করবে?

মাইক্রোপ্লাস্টিক খাবার এবং শ্বাসের মাধ্যমে আমাদের রক্ত ও টিস্যুতে প্রবেশ করতে পারে। এগুলো স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে কি না, তা নির্ধারণ করা কঠিন। বিজ্ঞানীরা মাইক্রোপ্লাস্টিকের কারণে প্রদাহজনিত লিভারের রোগ, হৃদ্‌রোগ এবং ক্যানসারের মতো স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে সম্ভাব্য সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন।

তবে এসব গবেষণার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ঠিক মাইক্রোপ্লাস্টিকের কারণেই এই স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। এটি নিশ্চিত করতে এমন পরীক্ষার প্রয়োজন, যেখানে একদল মানুষ মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ করবেন এবং অন্য দল করবেন না; কিন্তু কাউকে এমন একটি পদার্থ খাওয়ার জন্য বলা অনৈতিক। এটি তাদের ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই গবেষকদের গবেষণার অন্য পদ্ধতির ওপর নির্ভর করতে হবে।

আরও পড়ুন

ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডোর মেডিসিন ও সংক্রামক রোগ বিভাগের সহযোগী গবেষণা অধ্যাপক সুঝাও লি নিজের গবেষণাগারে দেখেছেন, যখন কারও শরীর মাইক্রোপ্লাস্টিককে অপরিচিত কণা হিসেবে ধরে নেয়, তখন শরীরের প্রতিরোধকোষগুলো কণাকে আক্রমণ করে। যার ফলে প্রদাহ হয়। এই পর্যবেক্ষণ প্রদাহজনিত অন্ত্রের রোগ বা হৃদ্‌রোগের সম্ভাব্য সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে পারে বলে মনে করেন ড. লি। তবে তাঁর গবেষণা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

অধ্যাপক সুঝাও লি বলেন, ‘মাইক্রোপ্লাস্টিকের বিজ্ঞান এত নতুন যে আমরা এখনো এর তেমন কিছু জানি না।’

যেভাবে কম প্লাস্টিক কণাযুক্ত চা পান করা যাবে

যদি চায়ের ব্যাগে থাকা মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে তুমি চিন্তিত হও, তবে বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি উপায় বলেছেন, যা মাইক্রোপ্লাস্টিক এড়াতে সাহায্য করবে।

উপযুক্ত চা বেছে নাও। টি–ব্যাগ ব্যবহার না করে খোলা চায়ের পাতা ব্যবহার করাই সম্ভবত মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ কমানোর সবচেয়ে ভালো উপায়। যদিও কাগজের চায়ের ব্যাগ হলে প্লাস্টিকমুক্ত এমন বলা যায় না, তবে এটি প্লাস্টিকের টি–ব্যাগের চেয়ে নিরাপদ বিকল্প হতে পারে।

কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, চায়ের ব্যাগ সাধারণ তাপমাত্রার পানিতে অল্পক্ষণ ভিজিয়ে তুলে ফেলতে হবে। এরপর পানিটুকু ফেলে দিতে হবে। তারপর টি–ব্যাগটি দিয়ে চা তৈরি করলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ কমতে পারে। চায়ের ব্যাগটি প্রবাহিত পানিতে ধুয়ে নিলেও কিছু প্লাস্টিক অপসারণ হতে পারে। অবশ্য এতে চায়ের স্বাদ কিছুটা কমে যেতে পারে।

খেতে খেতে চা ঠান্ডা হয়ে গেলে চা অনেকেই আবার গরম করে। অনেকেই চায়ের মগ মাইক্রোওয়েভে গরম করে। কেউ কেউ চায়ে আরও গরম পানি যোগ করে। তবে চায়ের ব্যাগসহ এই কাজ করলে আরও বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক ছাড়ার আশঙ্কা থাকতে পারে। যদি চা আবারও গরম করতে হয়, তবে চায়ের ব্যাগ তুলে ফেলে দিয়ে আবার গরম করতে পারো।

চায়ে মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তার কিছু নেই। যদি তোমার খাবারে মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তা হয়, তাহলে সহজ উপায়ে মাইক্রোপ্লাস্টিক এড়াতে পারো। প্লাস্টিকের পাত্রের খাবার সংরক্ষণের বদলে কাচের পাত্র ব্যবহার করতে পারো।

গবেষকেরা চায়ে মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে অভয় দিয়েছেন। তুমি কত পরিমাণ প্লাস্টিক চায়ের সঙ্গে গ্রহণ করছ, তা নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করবে না। এতে চা পানের আনন্দ মাটি হয়ে যেতে পারে। ড. লির পরামর্শ এমনই।

সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস

আরও পড়ুন