পৃথিবী গোলাকার কিন্তু দেখে সমতল মনে হয় কেন
পৃথিবী যে গোলাকার, তা নিয়ে এখন আর কোনো দ্বিধা নেই। এখন মানুষ অহরহ নভোযানে চড়ে পৃথিবীর বাইরে যাচ্ছে, চাঁদে গিয়েছে। সেখান থেকে পৃথিবীকে দেখাচ্ছে একটা গোলাকার নীল বিন্দুর মতো। অনেক আগে অর্থাৎ সেই গ্রিক যুগ থেকেই মানুষ জানে, পৃথিবীটা গোলাকার। চাঁদটা যেমন গোল, আকারে পৃথিবীও ঠিক তেমনই। কিন্তু তুমি কি তা বুঝতে পারছ? রাস্তা ধরে যত দূরই যাও না কেন, সব তো সমান, মানে সমতল। পৃথিবী গোলাকার হলে আমরা তা বুঝতে পারি না কেন?
কারণ হলো আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। আসলে আমরা এই বিশাল পৃথিবীর তুলনায় খুবই ছোট। একটা উদাহরণ দিই। ধরো তুমি একটা সার্কাস খেলা দেখতে গেলে। সেখানে দেখলে একজন মানুষ বিশাল একটা বল নিয়ে খেলছে। ধরো বলটা প্রায় ৩ ফুট চওড়া। মানে এই বলের ওপর তুমি বসলেও আরও চারপাশে কিছু জায়গা ফাঁকা থাকবে, এত বড় বল! এই বলের ওপর যদি একজন মানুষ দাঁড়ায়, তাহলে সে বলটাকে কেমন দেখবে? নিশ্চয়ই গোলাকার দেখবে। কারণ, সে সম্পূর্ণ বলটা দেখতে পাচ্ছে। দেখ, একজন মানুষ সাধারণত ৫-৬ ফুট লম্বা হয়। বাচ্চারা অবশ্য আরও ছোট। এখন এমন একজন লম্বা মানুষ যখন বলের ওপরে দাঁড়াবে, সে খুব সহজেই বলটালে গোলাকার দেখতে পাবে।
এখন বলের ওপর মানুষটার জায়গায় একটা চোট্ট পিঁপড়া চিন্তা করো। পিপড়াটা কিন্তু একদম ছোট। ওটা যখন বলের ওপর ছেড়ে দেবে, ও কিন্তু বলের সম্পূর্ণটা একসঙ্গে দেখতে পাবে না। পিঁপড়া যতই হাঁটুক না কেন, গোল বলটা ওর কাছে সমতলই মনে হবে। মানে পিঁপড়াটা ভাববে সে সমান বা সোজা রাস্তা ধরে হাঁটছে। কিন্তু তুমি দূর থেকে দেখছ। পিপড়াটা আসলে একটা গোলাকার বলের ওপরই হাঁটছে।
শুধু তাই নয়, পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বলও কিন্তু সব জায়গায় সমান নয়। মাধ্যাকর্ষণ বল মানে যে বলের কারণে আমরা লাফ দিলে আবার নিচে নেমে আসি। ব্যাটসম্যান ছক্কা মারলে বলটা যে ওপর দিয়ে গিয়ে আবার নিচে পড়ে, তাও ওই মাধ্যাকর্ষণ বলের কারণে।
এখন তুমি যদি পিঁপড়াটা হাতে ধরে ওপরে ওঠাও, তাহলে পিপড়াটা ওপর থেকে দেখতে পাবে, বলটা আসলে গোলাকার। কিন্তু বলের গায়ে বসে কিন্তু পিঁপড়া তা কোনোভাবেই বুঝতে পারবে না। আমাদের অবস্থাও হয়েছে সেরকম। আমরা যখন পৃথিবীর ওপর থাকি, তখন পৃথিবীকে সমতল দেখি। কিন্তু নভোযানে চড়ে যদি পৃথিবীর বাইরে চলে যাই, তাহলে বুঝতে পারি যে পৃথিবীটা গোলাকার।
আমাদের পৃথিবীটা প্রায় ৪ কোটি ২০ লাখ ফুট চওড়া। আর আমরা মাত্র ৫-৬ ফুট লম্বা। মানে আমরা পৃথিবীকে সর্বোচ্চ ৬ ফুট ওপর থেকে পৃথিবীকে দেখতে পারি। এত বিশাল একটা গোলককে এত কম উচ্চতা থেকে দেখা সম্ভবই না। তুমি যদি ২৯ হাজার ৩৫ ফুট উঁচু এভারেস্টের চূড়াতেও ওঠো, তবুও পৃথিবীকে গোল মনে হবে না। পৃথিবীকে গোলাকার দেখতে হলে চাই আরও উঁচু স্থান।
তবে আমরা যে পৃথিবীকে গোলাকার বললাম, পৃথিবী কি আসলে গোলাকার? না, পৃথিবী কিন্তু একদম নিখুঁত গোলাকার নয়! মহাকাশ থেকেও দেখলে বোঝা যাবে এটা একটুখানি চ্যাপ্টা, অনেকটা কমলালেবুর মতো। বিজ্ঞানীরা এটাকে বলেন অব্লেট স্ফেরয়েড। নামটা একটু জটিল কিন্তু তুমি কমলালেবুর মতো ভাবতে পারো। ওই কঠিন শব্দটার মানে হলো, এটা মাঝখান দিয়ে একটুখানি ফোলা আর দুই পাশে একটু চাপা—কমলালেবুর মতো।
কিন্তু পৃথিবী পুরো গোলাকার না হয়ে এমন হলো কেন জানো? কারণ, পৃথিবীর ঘূর্ণন! পৃথিবী যখন ঘোরে, তখন একটা সেন্ট্রিফিউগাল ফোর্স বা কেন্দ্রবিমুখী বল তৈরি হয়। বিষয়টা একটু সহজে বলি। পার্কে ঘুরন্ত মেরিগো নামে একটা মজার জিনিস আছে। অনেকটা নাগরদোলার মতো। তবে নাগরদোলা যেমন ওপর থেকে নিচের দিকে যায়, এটা কিন্তু তেমন নয়। এটা চারদিকে ঘোরে। যখন খুব জোরে এটা চারদিকে ঘুরতে থাকে, তখন মনে হয় যেন তুমি ছিটকে বাইরে পড়ে যাবে। এই যে ছিটকে বাইরে পড়ে যাওয়ার মতো মনে হয়, এই টানটাই হলো সেন্ট্রিফিউগাল ফোর্স। এই বলের কারণেই পৃথিবীর মাঝখানের অংশটা একটুখানি ফোলা।
শুধু তাই নয়, পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বলও কিন্তু সব জায়গায় সমান নয়। মাধ্যাকর্ষণ বল মানে যে বলের কারণে আমরা লাফ দিলে আবার নিচে নেমে আসি। ব্যাটসম্যান ছক্কা মারলে বলটা যে ওপর দিয়ে গিয়ে আবার নিচে পড়ে, তাও ওই মাধ্যাকর্ষণ বলের কারণে। যাহোক, এই মাধ্যাকর্ষণ বল পৃথিবীর সব জায়গায় সমান নয়। কারণ, পৃথিবীতে যেমন উঁচু পাহাড় আছে, তেমনি আছে গভীর সমুদ্র খাত। এগুলোর কারণে মাধ্যাকর্ষণ বলে সামান্য পার্থক্য দেখা যায়।
সর্বোপরি, পৃথিবীকে আমরা গোলাকার দেখতে পাই না, কারণ তা দেখার মতো অত উঁচু আমরা নই। এমনকি পৃথিবীতে সেরকম উঁচু কোনো জায়গায়ও নেই, যেখানে দাঁড়ালে পৃথিবীর গোলাকার অবস্থা বোঝা যাবে।
সূত্র: দ্য কনভারসেশন