ভেলার মতো তৈরি এক পাটাতন আর তার ওপর এক ছোট্ট কুঁড়েঘর। তা নিয়ে প্রতি রাতে সমুদ্রে ভেসে বেড়াত আলদি নোভেল আদিলাং। মাছদের ফাঁদে ফেলতে রাতের সমুদ্রে আলো জ্বালিয়ে সারা রাত সেই কুঁড়েঘর ভেলায় কাটিয়ে দিত আদিলাং। ঘুম ও খাওয়াটাও সেরে নিত সেখানে। কুঁড়েঘর ভেলার এক নামও আছে—রমপং (Rompong)। রমপংয়ে বাতি জ্বালিয়ে সাধারণত রাতের বেলা সমুদ্রে ভাসিয়ে রাখা হয়, যাতে মাছেরা তা দেখে রমপংয়ের আশপাশে ঘোরে। গভীর সমুদ্র পর্যন্ত গেলেও বিশাল দড়ি দিয়ে সমুদ্রের তলদেশে নোঙর ফেলে রমপংকে স্থির করে রাখা হয়। তবে গভীর সমুদ্রে মাছের সন্ধানে সারা রাত রমপংয়ে কাটাতে গিয়ে এক রাতে ঘটল দুর্ঘটনা! বাতাসের তোড়ে রমপংয়ের দড়ি গেল ছিঁড়ে! ব্যস! সমুদ্র থেকে ১২৫ কিলোমিটার দূরেই ছিল আদিলাং আর রমপং তো বাঁধন ছাড়া পেয়ে ঢেউয়ের তোড়ে চলতে লাগল নিজের মতো। এদিকে রমপংয়ে থাকে না কোনো বইঠা, তাই বইঠা বেয়ে তীরে ফেরারও উপায় নেই। আদিলাং তার রমপং তথা কুঁড়েঘর ভেলায় দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল যে সে হারিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের অজানায়, ক্রমে দূরে চলে যাচ্ছে তার চিরকালের চেনা সমুদ্রতীর ছেড়ে, চারদিকের আলো ছাড়িয়ে সমুদ্রের অন্ধকারে রইল শুধু আদিলাং আর তার রমপং। কী হবে এবার আদিলাংয়ের?
১৯ বছর বয়সী ইন্দোনেশিয়ান কিশোর আদিলাং। ১৬ বছর বয়স থেকে তার রাত কাটছিল রমপংয়ে ঘুমিয়ে। কিন্তু ২০১৮ সালের সেই রাতে ঘটে এমন আকস্মিক ঘটনা। রমপংয়ে সাধারণত সব সময় কিছু খাবার মজুত থাকে। তাই সমুদ্রের মাঝে হারিয়ে গিয়েও আদিলাং রমপংয়ে থাকা ভাত, পরিষ্কার পানি, মরিচ, রান্না করার গ্যাস, ইত্যাদি দিয়ে দিব্যি চালিয়ে নিচ্ছিল। কিন্তু সাত দিন যেতেই তার মজুত গেল শেষ হয়ে। কিন্তু দমে যায়নি আদিলাং। বরং জীবন বাঁচাতে মাছ ধরে, কাঠের বেড়া দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে, তা রান্না করে খেয়ে নিয়েছে। কখনো কখনো তো খিদে মেটাতে খেয়ে নিয়েছে কাঁচা মাছ। কিন্তু সমুদ্রে হারিয়ে গেলে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে পরিষ্কার পানি খুঁজে পাওয়া। যেখানে তীরের দেখা পাওয়াটা মরুভূমিতে পুকুর খুঁজে পাওয়ার মতো, সেখানে পরিষ্কার পানির খোঁজ পাওয়াটা তো অসম্ভবই বটে। তাই বুদ্ধি করে আদিলাং সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে জামা ডুবিয়ে এরপর তা চিপে পানি খেত, যাতে লবণের স্বাদ কম পাওয়া যায়।
কিন্তু দিনের পর দিন চলে যায়, আদিলাং তো উদ্ধার পায় না, তাকে তো কেউ বাঁচাতে আসে না! এভাবেই কেটে যায় আদিলাংয়ের ৪৯টি দিন! এই ৪৯ দিনে ১০টি জাহাজ পার হয়ে যায় আদিলাংয়ের আশপাশ দিয়ে, কিন্তু একটিবারের জন্যও কারও নজর যায়নি তার দিকে। বিশাল সমুদ্রে নিঃসঙ্গ আদিলাং গেয়েছে খ্রিষ্টীয় গান, পাঠ করেছে তার সঙ্গে থাকা বাইবেল, সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রতিনিয়ত প্রার্থনা করেছে উদ্ধার পাওয়ার উদ্দেশ্যে। এমনকি একটা সময় আদিলাং একাকী বিষণ্নতায় সমুদ্রের অতলে ডুব দিয়ে চিরদিনের জন্য হারিয়েও যেতে চেয়েছিল।
তবে ৪৯ নম্বর দিন তথা ৩১ আগস্ট সে দেখতে পায় এক কয়লা বহনকারী জাহাজ। নিজের অজান্তে ইন্দোনেশিয়া থেকে ভাসতে ভাসতে প্রশান্ত মহাসাগরের গুয়ামে পৌঁছে যাওয়া আদিলাং সেই জাহাজ দেখেই নিজের সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে বলতে থাকে ‘হেল্প হেল্প’, আর হাত উঠিয়ে ঘোরাতে থাকে তার জামা। কিন্তু এবারও যে তারা তাকে দেখতে পাচ্ছে না! কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পেরে আদিলাং ইমার্জেন্সি রেডিও সিগন্যাল পাঠায়। এবার ভাগ্য ফেরে আদিলাংয়ের। তাকে অতিসত্বর উদ্ধার করে সেই জাহাজ আর জাহাজের ক্যাপ্টেন যোগাযোগ করেন গুয়াম কোস্টগার্ডের সঙ্গে। যেহেতু সেই জাহাজের গন্তব্য ছিল জাপান, তাই ঠিক হয় জাপান পৌঁছে আদিলাংকে দূতাবাসে হস্তান্তর করা হবে। শেষমেশ ৬ সেপ্টেম্বর জাপানে পৌঁছায় ও ৮ সেপ্টেম্বর আদিলাং প্লেনে চড়ে পৌঁছায় নিজের বাড়িতে।
সমুদ্রের অজানায় হারিয়ে যাওয়ার ঘটনার পর আদিলাং আর এ পেশায় ফেরত যায়নি। আদিলাংয়ের এমন নিরুপায় ও অসহায়ভাবে সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা কিন্তু এটিই প্রথম নয়। একবার নয়, দুবার নয়, তিন–তিনবার সে দড়ি ছিঁড়ে রমপংয়ে ভেসে সমুদ্রে হারিয়ে গিয়েছিল। প্রথমবার যদিও তাকে উদ্ধার করা হয়েছিল এক সপ্তাহের মধ্যে আর দ্বিতীয়বার দুই দিনের মাঝে, কিন্তু তৃতীয়বারের অভিজ্ঞতা তাকে বাধ্য করেছে এ পেশা ছেড়ে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে।