গাজার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কী বলছে শিশুরা
ফিলিস্তিনি ঔপন্যাসিক ইউসরি আলঘুল শিশুদের লেখা কবিতা সংগ্রহ করেন। এই কবিতায় আছে দুঃখ ও প্রতিরোধের গল্প।
সময়টা ২০২৪ সালের ১ জুলাই। গাজা উপত্যকার উত্তরের শাতি শরণার্থী শিবিরে স্কেটিং করছে দুই শিশু। ঘর হারানো এই শিশুরা বোমায় বিধ্বস্ত ভবনের পাশ দিয়ে উঁচুনিচু রাস্তায় স্কেটিং করছিল। এমন সময় ওরা এবং ওদের কয়েকজন বন্ধু দেখল ফিলিস্তিনি ঔপন্যাসিক ইউসরি আলঘুলকে। দৌড়ে ওরা ছুটে এল আলঘুলের কাছে। আলঘুল এ শিবিরেই বাস করেন। শিশুরা এসেছে তাঁর কাছ থেকে বই নিতে। নিজেদের লেখা কিছু কবিতাও শোনাতে চেয়েছিল তারা।
লেখক আলঘুল তখন টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে বলেছিলেন, ‘যখনই আমি শিবিরের রাস্তা দিয়ে হাঁটতাম, শিশুরা আমার কাছে এসে বই চাইত। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা চাইত, আমি যেন ওদের কবিতা পড়ি বা ওদের লেখাগুলো দেখি।’
২০২২ সালে আলঘুল তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। এই লাইব্রেরিতে প্রায় ৩ হাজার বই ছিল। ২০২৩ সালের শেষ দিকে ইসরায়েলি বিমান হামলায় তাঁর ঘরের এই লাইব্রেরি ধ্বংস হয়ে যায়। তবে এতে তিনি দমে যাননি। বই সংগ্রহের জন্য তিনি গো ফান্ড মি-তে ফান্ড সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
২০২৪ সালের ১৩ জুলাই, শিশুদের কবিতা শেখানোর মাত্র দুই সপ্তাহ পর ইসরায়েলি এক বিমান হামলায় শাতি শিবিরে আলঘুলের এক বন্ধু নিহত হন। আলঘুলও এই হামলায় আহত হন। তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।
লাইব্রেরি গড়তে অনেক সময় লাগবে ভেবে তিনি উত্তর গাজার ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া স্কুল ও লাইব্রেরি থেকে বই খুঁজে বের করতে শুরু করেছিলেন। সেসব বই দিয়েই তিনি শাতি শিবিরে শিশু কবিদের নিয়ে একটি কবিতা কর্মশালা করেছেন।
আলঘুলের সংগ্রহ করা গাজার শিশুদের লেখা কবিতায় আছে গণহত্যার সাক্ষ্য। আছে তীব্র ক্ষুধা ও শিশুদের আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন। আছে হারানো ঘরবাড়ির প্রতি ব্যাকুলতা, যুদ্ধবিধ্বস্ত জীবনের অনিশ্চয়তার গল্প।
২০২৪ সালের ১৩ জুলাই, শিশুদের কবিতা শেখানোর মাত্র দুই সপ্তাহ পর ইসরায়েলি এক বিমান হামলায় শাতি শিবিরে আলঘুলের এক বন্ধু নিহত হন। আলঘুলও এই হামলায় আহত হন। তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে শিশু কবিরা সেবারে নিরাপদে ছিল। তাদের মধ্যে এখনো অনেকেই কবিতা লিখছে। গাজার যুদ্ধের সাক্ষ্য হিসেবে থাকবে এই কবিতা।
ইসরায়েলি বিমান হামলায় গাজার প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং স্কুল ধ্বংস হয়েছে। তবু শিশু কবিরা কবিতার মধ্য দিয়ে নিজেদের জীবনের গল্প লিখছে। এই যেমন ১২ বছর বয়সী রউফ ইউসরি আবদেল রউফ আল ঘুলের কবিতা–
‘আমি কে?
আমি এক ভাঙা গলার পাখি,
ধ্বংসস্তূপে আমার অস্তিত্ব।’
ইসরায়েলের আক্রমণে সহপাঠী ও কাজিনদের হারানোর পর রউফ যেন তার প্রজন্মের সাক্ষী হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে, নতুন করে হামলা শুরুর পর গাজায় প্রতিদিন ১০০ শিশু মারা যাচ্ছে।
শিশু কবিদের শুধু জীবন ও বাড়ি-ঘর ধ্বংসই হয়নি, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজার কৃষি, হাঁস-মুরগির খামার, গ্রিনহাউস ধ্বংস করে দিয়েছে। গাজায় মানবিক সহায়তা আটকে দিয়েছে। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও ক্ষুধা গাজাবাসীকে বিপর্যস্ত করেছে।
১০ বছর বয়সী মাহমুদ আল হানাউই এক বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি শিশু। শাতি শিবিরে আশ্রয় নেওয়া এই শিশুর কবিতায় ফুটেছে বেদনা ও বিভ্রান্তির সাক্ষ্য। সে লিখেছে,
‘আকাশের পাখিরা কাঁদল, আকাশের তারা নিভে গেল,
গাছের পাতাগুলো শুকিয়ে ঝরে পড়ল,
যুদ্ধের ভেতরে মায়েরা সন্তান জন্ম দিল।
কোন অপরাধে এই সন্তানদের হত্যা করা হলো?
এখনও তো ওদের নামই রাখা হয়নি।’
আমিরা ইব্রাহিম বেদুঈনের বয়স মাত্র ১২। সে নিজের কবিতায় তুলে ধরেছে যুদ্ধ আক্রান্ত স্বদেশের গল্প। যুদ্ধ ও অনিশ্চয়তার কথা শুরুতে বলেছে সে।
‘ঈদ কিসের, যখন শিশুরা এত ভয়, দুঃখ আর বিষণ্নতায় ডুবে থাকে?
ঈদ কিসের, যখন মানুষ আর শিশুদের চোখের সামনে গাজা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে,
গাজা আর আগের মতো নেই।
ঈদ কিসের, যখন মানুষের মধ্যে আনন্দ বা সুখের কোনো চিহ্নই বাকি নেই?’
এই শিশু কবিদের শুধু জীবন ও বাড়ি-ঘর ধ্বংসই হয়নি, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজার কৃষি, হাঁস-মুরগির খামার, গ্রিনহাউস ধ্বংস করে দিয়েছে। গাজায় মানবিক সহায়তা আটকে দিয়েছে। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও ক্ষুধা গাজাবাসীকে বিপর্যস্ত করেছে। গাজার পানি সংরক্ষণব্যবস্থা, পানি পরিশোধন ও সরবরাহের অবকাঠামো ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরায়েল। গত বছরের মাঝামাঝি অক্সফামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় পানির সক্ষমতা ৯৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
গাজার শিশুরা ও তাদের পরিবার বাধ্য হয়ে অপরিষ্কার, হলদে, লবণাক্ত পানি বা সমুদ্রের পানি পান করছে। গাজায় পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার ফলে পোলিও ভাইরাস ফিরে এসেছে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে জন্ডিসের মতো পানিবাহিত রোগ।
১০ বছর বয়সী মাহমুদের কবিতায় দুর্ভিক্ষের নির্মম বাস্তবতা ধরা পড়েছে।
‘আনন্দের মোমবাতি নিভে গেছে
মায়েরা বিলাপ করছে তাদের সন্তান আর ঘরের জন্য
তারা ক্ষুধার্ত, পান করেছে লবণাক্ত পানি।’
গাজার শিশুদের শত দুঃখের মধ্যেও তাদের প্রতিরোধ ও সাহসের কবিতা আমাদের অশ্রুসিক্ত করে। শাতি শরণার্থী ক্যাম্পে বাস করা ১২ বছর বয়সী তলা আল দানাফ
১১ বছর বয়সী লায়লা রমজানের একটি হৃদয়বিদারক কবিতায় পতাকা ও কাফনের চিত্রের মধ্যে শান্তির সম্ভাবনা ফুটে উঠেছে
‘কাফনে জড়ানো হচ্ছে তরুণদের।
পতাকা উড়িয়ে শান্তির প্রতীক পায়রা ওড়ানোর স্বাধীনতা থাকতেই হবে।’
গাজার শিশুদের শত দুঃখের মধ্যেও তাদের প্রতিরোধ ও সাহসের কবিতা আমাদের অশ্রুসিক্ত করে। শাতি শরণার্থী ক্যাম্পে বাস করা ১২ বছর বয়সী তলা আল দানাফ লিখেছে,
‘তারা আমাকে হাজার বার মেরেছে,
তবুও আমি বেঁচে থেকেছি মর্যাদার জন্য
আমি মরব না, আমি মরব না, আমি একজন ফিলিস্তিনি শিশু।’
ফিলিস্তিনের শিশুরা বেঁচে থাকুক।