চশমার পাওয়ার কত

কোরবানির ঈদে গরু কিনে ফেরার পথে সবাই যেমন জিজ্ঞাসা করে, ‘ভাই কত নিল?’, তেমনি ছোটবেলায় লোকে আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞাসা করত, ‘পাওয়ার কত?’ আমি ভালো গল্পকার হলে বানিয়ে বানিয়ে বলতাম, ‘শুনে আমি ভাবতাম, আমার আবার কিসের পাওয়ার! আমি কি সুপারম্যান?’ আমি যেহেতু ভালো গল্পকার নই, তাই সে পথে আর না যাই।

সেকালে সবার চোখে চশমা ছিল না। ২০০৫ বা ২০০৬ সালের কথা। তা ছাড়া আমি তখন মাসে দু-চারটা করে চশমা ভাঙি। আব্বু-আম্মু বকাঝকা করে, তারপর আবার চশমা কিনে দেয়। আমি মহানন্দে সেই চশমা আবার ভেঙে ফেলি। ফলে আবার নতুন চশমা বানাতে হয়। এই করতে করতে পাওয়ারের ব্যাপারে একটা ধারণা হয়ে গেল। কারণ, প্রতিবার চশমা বানাতে দিলেই পাওয়ারের কথা আসে।

তখন পাওয়ার নিয়ে আমি শুধু দুটো বিষয় জানতাম। এক. আমি দূরে দেখতে পাই না, তাই আমার চশমার পাওয়ার মাইনাস। আর দুই. আমার চশমার বাঁ কাচে তখন -১.২৫ পাওয়ার দেওয়া। এই পাওয়ারের মান বাড়া মানে চোখ আরও খারাপ হওয়া। চিকিৎসক পইপই করে বলে দিয়েছেন, মাইনাস পাওয়ারের চশমা নিয়মিত পরতে হয়। তোমরা যারা চশমা পরো, এই বিষয়গুলো সম্ভবত প্রায় সবাই জানো। যারা চশমা পরো না, এটুকু বোধ হয় তাদেরও জানা। কিন্তু চশমার এই ‘পাওয়ার’ জিনিসটা কী? চিকিৎসকেরা যখন প্রেসক্রিপশনের পাওয়ার কার্ড লিখে দেন, ওতে আসলে ঠিক কী লেখা থাকে? এই বিষয়গুলো নিয়ে যদি তোমার আগ্রহ বা প্রশ্ন থাকে, তাহলে এই লেখাটা ঠিক তোমার জন্যই।

আমাদের দেখার পুরো প্রক্রিয়াটা বেশ জটিল। এর অনেক খুঁটিনাটি বিষয় আছে। আমরা খুব একটা জটিলতায় যাব না। এ লেখায় বিষয়গুলো সহজভাবে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করব। প্রয়োজনে খানিকটা অতিসরলীকরণও করব। পরে কখনো বিষয়গুলোর বিস্তারিত জেনে নিতে পারবে তোমরা চাইলে।

এই আলোচনার শুরুতে আমরা কথা বলব ‘চোখ’ ও ‘কাচ’ নিয়ে। জানব, আমরা কীভাবে দেখি।

দুই

তোমরা হয়তো দেখেছ, সাধারণ বিজ্ঞান বা পদার্থবিজ্ঞান বইতে ‘আলো’ নামে একটি অধ্যায় থাকে। এ অধ্যায়ে আলোকবিজ্ঞানের নানা দিক পড়ানো হয়। আমরা চোখ দিয়ে দেখি। কোনো কিছু থেকে আলো এসে আমাদের চোখে পড়লে, সে জিনিসটা আমরা দেখতে পাই। এই দেখার প্রক্রিয়াটা সহজভাবে বোঝার জন্য আলোকবিজ্ঞানের দু–একটি বিষয় একটু জানতে হবে।

কোনো বস্তুর ওপর আলো পড়লে তিনটা ঘটনা ঘটে। এক. প্রতিফলন। আয়না বা এ ধরনের প্রতিফলক তলে পড়লে আলো প্রতিফলিত হয়। প্রতিফলন মানে, আলোটা সেই তলে পড়ে ধাক্কা খেয়ে আবার ফিরে আসে। ফিরে এসে সেটা কোন দিকে যাবে, তা বোঝার জন্য জানতে হবে, আলোটা প্রতিফলক তলে (পড়, আয়নায়) কত ডিগ্রি কোণে পড়েছে, সেটা। আমরা আগেই বলেছি, জটিলতায় যাব না। আপাতত তাই এটুকু জানলেই হবে, আমাদের চোখ আয়নার মতো কাজ করে না।

ছবি ১: উত্তল কাচে আলো পড়লে সেটা ভেতরের দিকে বেঁকে যায়। এ সময় মূল বস্তুর উল্টো ছবি তৈরি হয় কাচের পেছনে

দ্বিতীয় ঘটনাটির নাম প্রতিসরণ। একধরনের ঘনত্ববিশিষ্ট মাধ্যম থেকে অন্য ধরনের মাধ্যমে যাওয়ার সময় আলো প্রতিসরিত হয়। যেমন হালকা মাধ্যম (যেমন বাতাস) থেকে ভারী বা ঘন মাধ্যমে (যেমন কাচ বা পানিতে) আলো পড়লে প্রতিসরিত হয়। প্রতিসরণ মানে আলোর চলার পথ খানিকটা বেঁকে যায়। তবে শর্ত হলো, সে জন্য আলোটাকে একটু বাঁকা বা তির্যকভাবে পড়তে হবে দ্বিতীয় মাধ্যমটির ওপর। আগের বাক্যটাকে তাহলে এভাবে বলা যায়, হালকা মাধ্যম থেকে ঘন মাধ্যমে তির্যকভাবে যাওয়ার সময় আলোর চলার পথ খানিকটা বেঁকে যায়। (এর উল্টোটাও সত্যি। ঘন মাধ্যম থেকে হালকা মাধ্যমে যাওয়ার সময়ও আলোর চলার পথ খানিকটা বেঁকে যায়।) আমাদের চোখে মূলত এই ঘটনাই ঘটে। মানে, আলোর প্রতিসরণ ঘটে। (তৃতীয় ঘটনাটির নাম বিক্ষেপণ বা বিচ্ছুরণ। এটা আমাদের আলোচনা বোঝার জন্য দরকার নেই। তাই আপাতত এ আলোচনা থাকুক।)

প্রতিসরণের বিষয়টা তোমরা যদি হাতে-কলমে বুঝতে চাও, তাহলে একটা লাল বা সবুজ লেজার লাইট নিতে পারো। তারপর একটা স্বচ্ছ পানি বা কোকের বোতলের গায়ে পাশ থেকে একটু বাঁকা করে আলো ফেলে দেখতে পারো। দেখবে, পানির ভেতরে আলোটা বেঁকে যাচ্ছে।

ছবি ২: অবতল কাচে আলো পড়লে বাইরের দিকে বেঁকে যায়। সেটার ছবিটা সোজাই তৈরি হয়। তবে ছবিটা তৈরি হয় কাচের সামনে!

এই প্রতিসরণ বা আলোর বেঁকে যাওয়ার বিষয়টা কেমন হবে, তা নির্ভর করে প্রতিসরক তলের ওপর। মানে, দ্বিতীয় যে মাধ্যমে আলোটা গিয়ে পড়ছে, সেটার ওপর। আমরা ধরে নিই, আলোটা বাতাস থেকে এসে কাচের ওপর পড়ছে। ধরো, চশমার কাচেই পড়ছে। ঘটনা হলো, এই কাচের আবার বিভিন্ন ধরন আছে। যেমন সমতল কাচ। তোমার বাসার জানালার কাচগুলো এরকম। আরেক ধরনের কাচ আছে, যেটার মাঝের অংশটা মোটা, দুপাশে চিকন। এটাকে বলে উত্তল কাচ। আবার একধরনের কাচ আছে, যেটার দুপাশে পুরু, মাঝের অংশটা চিকন। এটাকে বলে অবতল কাচ। ছবি ১ ও ছবি ২-তে উত্তল ও অবতল কাচ দেখানো হয়েছে।

উত্তল কাচে আলো পড়লে সেটা ভেতরের দিকে বেঁকে যায়। এ সময় মূল বস্তুর উল্টো ছবি তৈরি হয় কাচের পেছনে। আর অবতল কাচে আলো পড়লে সেটা বাইরের দিকে বেঁকে যায়। এ সময় মূল বস্তুর সোজা ছবিই তৈরি হয়, তবে সেটা তৈরি হয় কাচের সামনে! (আমি জানি, বিষয়টা একটু অদ্ভুত শোনাচ্ছে। তবে এ লেখায় আমরা কাচের বিস্তারিত আলোচনায় যাব না। পরে কখনো এ নিয়ে বিস্তারিত লেখা যাবে। আপাতত জেনে রাখো, ভুল বলছি না।) ছবি ১ ও ছবি ২ দেখে এটুকু যদি বুঝতে পারো, তাহলে চশমার পাওয়ারের একটা মূল বিষয় তুমি বুঝে ফেলেছ।

ছবি ৩: যেভাবে চোখের রেটিনায় কোনো বস্তুর উল্টো ছবি তৈরি হয়

এবার একটু চোখের গঠনটা দেখে নিই, চলো। (ছবি ৩) চোখের সামনে একটা সাদা অঞ্চল। এই সাদা অঞ্চলের বাইরের দিকে বাঁকানো অংশটার ইংরেজি নাম কর্নিয়া। এটার একটা কাজ আলোটাকে বাঁকিয়ে চোখের লেন্সের ওপরে ফেলা।

এই কর্নিয়ার বাঁকানো অংশটার নিচে একটা গোলাকার কালো ছিদ্রমতো থাকে। এই কালো ছিদ্রটা, যেটাকে আমরা বাংলায় মণি বলি, এর ইংরেজি নাম পিউপিল। আর পিউপিলকে ঘিরে থাকে একটা অস্বচ্ছ পর্দা। আমরা কারও চোখের মণির রং কালো বা নীল বলতে যে অংশটার কথা বলি, আসলে সেটাই এই পর্দা। এর নাম আইরিস। এটার কাজ, চোখে কতটা আলো ঢুকতে পারবে, তার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা।

আইরিসের ঠিক পেছনেই থাকে লেন্স। এই লেন্সটাকে তুমি চাইলে ঠিক চশমার কাচের মতো ভাবতে পারো। এটা চোখের মধ্যে আলোর প্রতিসরণের মূল বিষয়টা নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ লেন্সে পড়ার পর আলোর চলার পথ বেঁকে যায়। প্রশ্ন হলো, কোনদিকে বেঁকে যায়? আমাদের চোখের লেন্সটা একধরনের উত্তল লেন্স। অর্থাৎ আলোটা ভেতরের দিকে বেঁকে যায়। বেঁকে গিয়ে এই আলোটা পড়ে চোখের একদম পেছনের একটা অংশে। এই অংশটার নাম রেটিনা। রেটিনায় আলো পড়ার পর চোখে ছবি তৈরি হয়। সেই ছবিটা তারপর সিগন্যালে রূপান্তরিত হয়ে স্নায়ু দিয়ে চলে আমাদের মস্তিষ্কে। মস্তিষ্কে এই সিগন্যালটা গেলে যে ছবিটা তৈরি হয়, সেটাই মূলত আমরা দেখি।

এবারে কিছু খুঁটিনাটি জিনিস। আমাদের চোখে কিন্তু একটা নির্দিষ্ট মুহূর্তে শুধু একটা আলোকরশ্মি এসে পড়ে না। অনেকগুলো আলোকরশ্মি এসে পড়ে। বিষয়টা বোঝার জন্য ছবি ৩ আবার দেখো।

একটা আপেলের গায়ের অসংখ্য বিন্দু থেকে আলো এসে পড়ছে আমাদের চোখে। আমরা এই সবগুলোকে নিয়ে না ভেবে শুধু আপেলের একদম ওপরের আর নিচের বিন্দুটা থেকে আসা আলোকরশ্মির দিকে তাকাব। এই দুটো রশ্মি আপেলের সীমানা বোঝাচ্ছে। রশ্মি দুটো যখন চোখের কর্নিয়ায় পড়ে, তখন সেটা খানিকটা বেঁকে যায় (কারণ, বাতাস নামের হালকা মাধ্যম থেকে সেটা কর্নিয়া নামে ভারী মাধ্যমে এসে পড়েছে)।

পরের ধাপে কর্নিয়া থেকে আইরিস হয়ে সেটা এসে পড়ে লেন্সে। তখন অনেকটা ভেতরের দিকে বেঁকে গিয়ে আলোকরশ্মি দুটি গিয়ে পড়ে রেটিনার ওপরে। যে অংশটুকুতে এই দুটি আলোকরশ্মি গিয়ে পড়ে, তার মাঝের সবগুলো বিন্দুতে কিন্তু আপেলের গায়ে থেকে আসা অন্য রশ্মিগুলো পড়ছে (যেহেতু এই রশ্মি দুটি আপেলের সীমানা বোঝাচ্ছে)। এভাবে একটা ছবি তৈরি হয় রেটিনায়। বুঝতেই পারছ, চোখের লেন্স যেহেতু উত্তল কাচের মতো কাজ করে, তাই ছবিটা তৈরি হয় উল্টো। এটা হলো একটা বিষয়। আরেকটা বিষয় হলো, ছবি যে অংশটায় তৈরি হচ্ছে, অর্থাৎ আপেল থেকে আসা সব আলোকরশ্মি রেটিনার যেখানে এসে পড়ছে, সে জায়গাটাকে বলে ফোকাস। আমরা যখনই ফোকাস বলব, তখন বুঝব, যেকোনো বস্তু থেকে আসা সব আলোকরশ্মি এখানে এসে মিলিত হচ্ছে।

ছবি ৪: অবতল কাচ ব্যবহার করে ক্ষীণদৃষ্টি সমস্যা সমাধান করা যায়

এবারে ‘উল্টো ছবি’র প্রসঙ্গে ফিরি। রেটিনায় যে ছবিটা উল্টো তৈরি হয়, সেটাকে আমরা সোজা দেখি কীভাবে? রেটিনা থেকে সিগন্যাল বা অপটিক্যাল ইম্‌পালস ছবিটার তথ্য মস্তিষ্কে নিয়ে যায়। মস্তিষ্ক আবার এই ইম্‌পালস থেকে উল্টো করে ছবি তৈরি করে। ফলে রেটিনায় তৈরি ‘উল্টো ছবি’টা আবার উল্টে যায়, মানে সোজা হয়ে যায়।

আমরা কীভাবে দেখি, তা তো বোঝা গেল। এবারে একটু দেখি, চোখে চশমা পরতে হয় কেন, আর চশমা কী করে।

তিন

সাধারণত চোখের সমস্যা দুই ধরনের। আরও নানা ধরনের সমস্যা আছে। তবে আমরা এই দুটি নিয়েই কথা বলব আপাতত।

একটি হলো ক্ষীণ দৃষ্টি। অর্থাৎ চোখ কাছে ভালো দেখতে পায়, দূরের বস্তু ঝাপসা দেখে। ইংরেজিতে একে নিয়ারসাইটেডনেস বলে। বিজ্ঞানের ভাষায় বলে মায়োপিয়া। এ ক্ষেত্রে কী হয়, দূরের বস্তু থেকে আসা আলোকরশ্মিকে চোখের লেন্স খুব বেশি বাঁকিয়ে ফেলে। ফলে ফোকাস হয় রেটিনার কিছুটা আগে। অর্থাৎ ছবিটা রেটিনায় গঠিত হয় না, কিছুটা সামনে গঠিত হয়। রেটিনা তাই মস্তিষ্ককে এ ধরনের ফোকাস থেকে তৈরি যে ছবিটা পাঠায়, সেটা হয় খানিকটা অস্পষ্ট। কনকেভ লেন্স বা অবতল কাচের চশমা দিয়ে এ সমস্যা সমাধান করা যায়।

অবতল কাচে আলো পড়লে সেটা ছড়িয়ে যায়। আপেলের দুটো সীমানা-রশ্মির কথা ভাবলে, রশ্মি দুটো এই অবতল কাচে পড়লে নিজেদের থেকে আরও দূরে সরে যাবে। অর্থাৎ এদের মাঝের দূরত্ব কিছুটা বেড়ে যাবে। এরপর সেটা কর্নিয়ায় পড়ে, বেঁকে গিয়ে কিছুটা কাছে আসবে। কিন্তু অবতল কাচ ছাড়া এটা যতটা কাছে চলে আসত, এ ক্ষেত্রে ততটা কাছে আসবে না। সে জন্য চোখের লেন্স এটাকে বাঁকিয়ে ফেলে আগের মতো রেটিনার সামনে ফোকাস করতে পারবে না, ফোকাস হবে রেটিনায়। ফলে স্পষ্ট দেখা যাবে।

দূরে দেখার এ সমস্যা নানা কারণে হতে পারে। দীর্ঘ সময় স্ক্রিন বা বইয়ের পাতায় তাকিয়ে থাকার ফলে যেমন হতে পারে, তেমনি চোখের অভ্যন্তরীণ গঠন লম্বা হলেও এমনটা হয়। ফোকাসটা রেটিনার সামনে হয়ে যায়। চশমা ছাড়াও ‘লেন্স’ পরে বা ল্যাসিক সার্জারির মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।

দ্বিতীয় ধরনের সমস্যাটির নাম, দূরদৃষ্টি। মানে দূরে দেখা যায়, কিন্তু চোখ কাছে দেখতে পায় না স্পষ্টভাবে। ইংরেজিতে যাকে বলে, ফারসাইটেডনেস। সমস্যাটির বৈজ্ঞানিক নাম Hyperopia। এ ক্ষেত্রে সমস্যাটা কী হয়, তা তো বুঝতেই পারছ। ফোকাস হয় রেটিনার কিছুটা পেছনে। উত্তল কাচের চশমা পরে এ সমস্যা সমাধান করা যায়। তখন ফোকাসটা সামনে এগিয়ে এসে রেটিনার ওপরে গঠিত হয়।

আর যাদের একই সঙ্গে দুই ধরনের সমস্যাই থাকে, তাদের পরতে হয় বাই-ফোকাল লেন্স। এর একদম নিচের অংশে থাকে উত্তল কাচ। ফলে কাছে তাকালে এর মাধ্যমে কাছে অস্পষ্ট দেখার সমস্যা সমাধান হয়। আর বাকিটা জুড়ে থাকে অবতল কাচ। ফলে দূরে না দেখা বা ক্ষীণ দৃষ্টি সমস্যার সমাধানও মেলে।

চার

চোখের সমস্যার বিষয়টা তো আমরা বুঝলাম। এবারে চশমার পাওয়ারের বিষয়টা বুঝে নেব। সে জন্য আগে দেখি, চিকিৎসকেরা আমাদের প্রেসক্রিপশনের সঙ্গে যে পাওয়ার কার্ডটা দেন, তাতে কী থাকে। (ছবি ৫)

কার্ডে থাকে বেশ কিছু কলাম। প্রথম কলামের শিরোনামের জায়গায় লেখা থাকে ‘Eye’, মানে চোখ। এর নিচে লেখা থাকে ওডি (O.D.) এবং ওএস (O.S.)। ওডি মানে ওকুলাস ডেক্সটার (Oculus Dexter)। লাতিন এই কথার অর্থ ডান চোখ। আর ওএস মানে ওকুলাস সিনিসটার (Oculus Sinister)। এটিও লাতিন কথা, মানে বাঁ চোখ। (কেন ইংরেজি না লিখে লাতিন লেখা হয়, সে প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই।)

এর পরের কলামগুলোর শিরোনামে থাকে যথাক্রমে স্ফেরিক্যাল (Spherical), সিলিন্ড্রিক্যাল (CYL), অ্যাক্সিস (AXIS), অ্যাড (ADD) এবং প্রিজম (PRISM)। স্ফেরিক্যালকে ইংরেজিতে সংক্ষেপে SPH লেখা হয়।

তোমরা নিশ্চয়ই দেখেছ, চিকিৎসক এই কার্ডে একটা স্ফেরিক্যাল পাওয়ার লিখে দেন, আরেকটা সিলিন্ড্রিক্যাল পাওয়ার লিখে দেন। সবার অবশ্য সিলিন্ড্রিক্যাল পাওয়ার লাগে না, শুধু স্ফেরিক্যাল পাওয়ার হলেই চলে। স্ফেরিক্যাল পাওয়ার মানে, তোমার চোখের পাওয়ার কতটা কম আছে। -৩.০০ স্ফেরিক্যাল পাওয়ার মানে, তোমার চোখের পাওয়ার ৩ডি কম আছে। এই ডি (D) দিয়ে বোঝায় ডাইঅপ্টার। এটা লেন্সের ক্ষমতা পরিমাপের একক। একটা লেন্স আলোকে কত দূরে নিয়ে ফোকাস করবে, সেটা বোঝাতে এই একক ব্যবহৃত হয়। এই দূরত্বকে বলে ফোকাস দূরত্ব। ১ডি মানে, ১ মিটার-১। অর্থাৎ লেন্সটার ওপর লম্বভাবে যে আলোকরশ্মিগুলো পড়বে, লেন্সটা সেগুলোকে ১ মিটার দূরে নিয়ে একবিন্দুতে মিলিত করবে। কথাটা এভাবেও বলা যায়, লেন্সটার ফোকাস দূরত্ব ১ মিটার। ৩.০০ স্ফেরিক্যাল পাওয়ার মানে, এই লেন্সের ফোকাস দূরত্ব ৩ মিটার।

লেন্সের পাওয়ার যত বেশি হয়, কাচ তত মোটা হয়। আর পাওয়ার প্লাস (+) মানে তুমি ঠিকভাবে কাছে দেখতে পাও না, অর্থাৎ তোমার সমস্যাটির নাম দূরদৃষ্টি। আর মাইনাস (-) মানে তুমি ঠিকভাবে দূরের জিনিস দেখতে পাও না। মানে তোমার রয়েছে ক্ষীণ দৃষ্টি। তাহলে -৩.০০ স্ফেরিক্যাল পাওয়ার মানে, এই লেন্সের ফোকাস দূরত্ব ৩ মিটার এবং এটা ক্ষীণ দৃষ্টি সমস্যা সমাধান করবে; অর্থাৎ অবলাল কাচ ব্যবহার করে তোমার চোখের লেন্সের ফোকাসকে ৩ মিটার পেছনে নিয়ে গিয়ে রেটিনায় ফেলবে। তখন ছবিটা তৈরি হবে রেটিনায়। এ নিয়ে আমরা আগেই আলোচনা করেছি।

ছবি ৫: পাওয়ার কার্ড

এবার সিলিন্ড্রিক্যাল পাওয়ারের কথা বলি। এটা বোঝায়, তোমার চোখের কর্নিয়া বা লেন্সের আকৃতিতে সামান্য সমস্যা আছে। সে জন্য আলো সোজাসুজি চোখের রেটিনায় গিয়ে পড়তে পারছে না। সিলিন্ড্রিক্যাল পাওয়ারের পাশেই একটা অ্যাক্সিস বা কোণ বলা থাকে। ১৮০ ডিগ্রির মধ্যে কত ডিগ্রি কোণে চশমার লেন্সটা ঘুরিয়ে দিলে তোমার কর্নিয়া ও লেন্স হয়ে আলোটা সঠিকভাবে রেটিনায় গিয়ে পড়তে পারবে, এটাই সিলিন্ড্রিক্যাল পাওয়ারের কাজ। কোণের হিসাব বোঝার জন্য ছবি ৬ দেখতে পারো।

আরেকটা কলাম থাকে ‘অ্যাড’ নামে। এটা মূলত কাছে দেখার সমস্যার জন্য। ওই যে বাইফোকাল লেন্সের নিচের দিকে উত্তল কাচের কথা বললাম, এই অ্যাড অংশটা মূলত সেটার পাওয়ার বোঝায়।

প্রিজম নামে আরেকটা অংশ থাকে। এই বিষয়টা একটু জটিল, আলোচনাটাও দীর্ঘ। আবার, খুব বেশি মানুষের এই পাওয়ারের দরকারও পড়ে না। তাই এ বিষয়টা আপাতত এ আলোচনার বাইরে থাকুক।

শেষ করার আগে একটা ছোট্ট জিনিস না বললেই নয়। এত ধরনের পাওয়ার, তাহলে তোমার চোখের মোট পাওয়ার কত, সেটা হিসাব করবে কীভাবে? বিষয় খুবই সহজ। স্ফেরিক্যাল পাওয়ারের সঙ্গে সিলিন্ড্রিক্যাল পাওয়ার বীজগাণিতিকভাবে যোগ করে দিলেই হয়। যেমন তোমার বাঁ চোখে স্ফেরিক্যাল পাওয়ার -১.২৫ আর সিলিন্ড্রিক্যাল পাওয়ার .৫০। তাহলে তোমার চশমার বাঁ কাচের পাওয়ার হবে, -১.২৫ + .৫০ = -.৭৫ D। অর্থাৎ তোমার ক্ষীণদৃষ্টি সমস্যা আছে। আর এই অবতল কাচটা .৭৫ মিটার পেছনে নিয়ে আলোগুলোকে ফোকাস করলে ছবিটা তোমার চোখের রেটিনায় তৈরি হবে। ব্যস!

শেষে এসে আবারও বলি, অবশ্যই এখানে বিষয়গুলো অতিসরলীকরণ করে বলা হয়েছে। চোখের চিকিৎসকেরা এত সহজ ব্যাখ্যা দেখে রাগ করতে পারেন। আবার, পদার্থবিজ্ঞানীরাও হয়তো আলোকবিজ্ঞানের বিষয়গুলোর অতিসরলীকরণ ঠিক মেনে নিতে পারবেন না। তবে আমার ধারণা, তোমরা পাওয়ারের খুঁটিনাটি মূল বিষয়গুলো বুঝে ফেলেছ। এখন নিশ্চয়ই চিকিৎসক পাওয়ার লিখে দিলে সেটা দেখে চট করে বুঝে ফেলতে পারবে।