চীনে ২৫০ কিলোমিটার ম্যারাথনে যখন দৌড়ানো শুরু করি, আমার বয়স তখন ৪১। প্রথমবারের মতো ম্যারাথনে অংশ নিয়েছিলাম আরও ৩ বছর আগে, ৩৮ বছর বয়সে। তবে এবারের দৌড়ের রাস্তাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে দৌড়াতে হবে। বরফ থেকে শুরু করে গোবি মরুভূমির ভয়ংকর গরম—কী নেই ট্রেইলটিতে! তাই ম্যারাথনটার খবর পেয়ে আর দেরি করিনি, তল্পিতল্পা গুটিয়ে যুক্তরাজ্য থেকে সরাসরি চলে আসি চীনে।
এসব দৌড়ঝাঁপ কখনোই খুব একটা আগ্রহী করতে পারেনি আমাকে। আমি ছিলাম আরামপ্রিয়। অবসর পেলেই বসে যেতাম টিভির সামনে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি ওজন হয়ে গেল ১০৮ কেজি। যদিও এ নিয়ে একটুও চিন্তিত ছিলাম না আমি। ‘১০৮ এমন কীই–বা ওজন?’ আমার ভাবনা ছিল এ রকম।
এমন সময়ে আমার স্ত্রী লুজার (Lucja) নতুন কয়েকজন বন্ধু হলো, যারা খুবই স্বাস্থ্য সচেতন। ওদের সঙ্গ পেয়ে লুজাও দেখলাম আস্তে আস্তে ফিটনেসের দিকে নজর দেওয়া শুরু করছে, নিয়ম করে দৌড়াচ্ছে প্রতিদিন। ফল মিলল খুব দ্রুতই, অল্প কিছুদিনের মধ্যে লুজাকে হুট করে দেখে আমি চিনতেই পারলাম না! ওকে এত ফিট দেখে কিঞ্চিৎ হিংসা হলো কি না, কে জানে, সিদ্ধান্ত নিলাম আমিও দৌড়ানো শুরু করব। তখন থেকেই আমার ম্যারাথনে আসা।
প্রথম দিকে খুব একটা সুবিধা করতে পারতাম না। ম্যারাথন শেষে দেখা যেত শেষের দিকেই থাকতাম আমি। ফলে কেউ খেয়ালও করত না। সবার আগ্রহ থাকত প্রথম চার–পাঁচজনকে ঘিরেই। একটা জায়গায় নিয়মিত যাচ্ছি, কিন্তু কেউ আমাকে খেয়াল করছে না বা পাত্তা দিচ্ছে না—বিষয়টা আমার জন্য মেনে নেওয়া খুব কঠিন। তাই দৌড়ের পেছনে আরও সময় দেওয়া শুরু করলাম। অংশ নিলাম দেশি-বিদেশি ম্যারাথনে। খুব বেশি পরিচিতি মিলল না, তবে একদম অপরিচিতও রইলাম না।
গোবি ম্যারাথনে দৌড় শুরু করার ঠিক আগমুহূর্তে এত সব কথা মনে পড়ে যাওয়ার মানে কী, কে জানে। হয়তো আমি একটু নার্ভাস। আশপাশে যাদের দেখছি, সবাইকেই মনে হচ্ছে আমার চেয়ে অনেক ফিট। এতজনের মধ্যে আমি জিততে পারব কি না, ভাবনাটা আবার মাথাচাড়া দিতে লাগল। ভাগ্যিস, তখনই শুরু হয়ে গেল ম্যারাথন। সবকিছু ঝেড়ে ফেলে দৌড় শুরু করলাম আমি।
বেশ ভালোই করলাম প্রথম দিন। শেষ করলাম প্রথম তিনের মধ্যে থেকে। ক্যাম্পে পৌঁছে খাওয়াদাওয়া করে ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নিলাম। ঘুম ভাঙল অনেক মানুষের হইচই শুনে। সবাই ততক্ষণে চলে এসেছে ক্যাম্পে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা বেজে গেছে। আস্তে আস্তে আমি রাতের খাবার তৈরির দিকে মনোযোগ দিলাম। ঠিক তখনই আমার চোখে পড়ল কুকুরটা।
কুকুরটার গায়ের রং বেশ সাদা, আর মুখে খুব হাস্যকর একটা গোঁফ। লেজ নেড়ে নেড়ে ঘুরছে অন্য মানুষদের পেছনে, অন্যগুলো মজা পেয়ে খাবার দিচ্ছে ওকে।
‘খুব চালাক তো কুকুরটা’, ভাবলাম আমি।
শীতে কাঁপতে কাঁপতে পরদিন সকাল আটটায় আবার দৌড়ের লাইনে দাঁড়ালাম সবাই। কে যেন ওই সময় বলল, ‘দেখো দেখো, ওই কুকুরটাও এসে গেছে!’ আমি তাকিয়ে দেখি, গতকাল যে সাদা কুকুরটাকে দেখেছিলাম, কোত্থেকে যেন লেজ নাড়তে নাড়তে হাজির সে। আর এসে দাঁড়াল একদমই আমার পাশে। অবাক হয়ে আমি এদিক–সেদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এর মালিক কে? কেউ জানেন?’
জবাব পেলাম না কারও কাছ থেকেই।
দৌড় শুরুর কাউন্টডাউন শুরু হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে ঘটল অদ্ভুত এক ব্যাপার। নিচে তাকিয়ে দেখি, একদৃষ্টে কুকুরটা তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অনেক চেষ্টা করেও চোখ ফিরিয়ে নেওয়া গেল না। কুকুরটা বেশ সুন্দর, স্বীকার না করে পারলাম না। নরম সুরে কুকুরটাকে বলে উঠলাম, ‘পায়ের নিচে চাপা পড়তে না চাইলে কিন্তু দৌড়াতে হবে দ্রুত।’
দৌড় শুরু হয়ে গেল ঠিক তখনই। বার কয়েক খেয়াল করলাম, খুব আনন্দ নিয়ে কুকুরটা ছুটছে আমার পেছন পেছন। দৌড়ে পিছিয়ে পড়ার পরে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলাম কুকুরটাকে, মনোযোগ দিলাম রাস্তার দিকে। উঁচু–নিচু রাস্তা, একটু এদিক–সেদিক পা ফেললে মচকে যেতে পারে গোড়ালি। তবে অবচেতন মনে কুকুরটাকে নিয়ে সামান্য একটু চিন্তা হয়তো রয়ে গিয়েছিল। তাই পরেরবার নিচে তাকিয়ে কুকুরটাকে দেখতে পেলাম না যখন, স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম আপনা–আপনিই।
আমরা যত সামনে এগোচ্ছিলাম, আশপাশের পরিবেশ বদলে যাচ্ছিল। বনের পাশ দিয়ে দৌড় শুরু করেছিলাম আমরা। দৌড়াতে দৌড়াতে সেই বন বদলে গেল পাহাড়ে, রাস্তা হয়ে গেল রুক্ষ। ঠিক তখনই চোখের কোণে কী যেন একটা নড়তে দেখলাম। তাকিয়ে দেখি, কোত্থেকে যেন আবার ফিরে এসেছে কুকুরটা! আমার সঙ্গে দৌড়াতে পেরে যেন মহাখুশি।
কুকুর পছন্দ করতাম সব সময়ই। লুজা আর আমার একটা কুকুরও ছিল। সেন্ট বার্নার্ড জাতের একটা কুকুর, নাম দিয়েছিলাম কার্টলি। কার্টলি মারা যাওয়ার পর আর কুকুর পুষিনি আমরা। পোষা প্রাণী মরে গেলে খুবই কষ্ট লাগে, ওই কষ্টটা আবার পেতে চাইনি আমরা। এই কুকুরটাকেও অপছন্দ করার কোনো কারণ ছিল না। শুধু সব সময় একটা ভয়ে ছিলাম, হয়তো আমার মনোযোগ ছুটে যাবে অথবা ভুলে হয়তো মাড়িয়ে দেব কুকুরটাকে।
মনে হয় একসঙ্গে অনন্তকাল দৌড়ানোর পর সেদিনের জন্য যাত্রাবিরতি হলো। দূর থেকে আমাকে দেখে হুল্লোড় করে উঠল চেক পয়েন্টের স্বেচ্ছাসেবকেরা। আরেকটু সামনে আসতেই বুঝতে পারলাম, ওরা আসলে উল্লাস প্রকাশ করেছে গোবিকে দেখে (ট্রেইলের নামের সঙ্গে মিল রেখে কুকুরটার নাম রেখেছি গোবি)। একজন বলে উঠল, ‘কুকুরটা তাহলে তোমার সঙ্গে সারা দিন দৌড়াল! অসাধারণ!’ একজন দেখলাম গোবিকে পাত্রে করে পানি দিল। আমি ভিড় থেকে সরে তাঁবুর দিকে চলে এলাম, হইচই ভালো লাগছিল না।
হাত-মুখ ধুয়ে বসতে না বসতেই গোবি হাজির। রাতের খাবার আসতে আরও প্রায় দুই ঘণ্টা, ফলে কিছু বাদাম আর শুকনা মাংস বের করলাম। খাওয়া শুরু করতেই মনে পড়ল, সারা দিন কিছু খায়নি গোবিও। এক টুকরা মাংস ছুড়ে দিলাম ওর দিকে। বেশ আগ্রহ নিয়ে খাবার শেষ করল গোবি, আর খাওয়ামাত্র তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।
কুকুরটার ঘুমন্ত চেহারা থেকে চোখ সরাতে পারলাম না আমি। ঠিক জানি না কেন, ঘুমন্ত গোবি আমাকে নিয়ে গেল আমার ছেলেবেলায়।
১৯৮৪ সালের এক সকাল। আগের দিনই ছিল আমার নবম জন্মদিন। মা–বাবার সঙ্গে আমি থাকতাম কুইন্সল্যান্ডে। দুপুরের খাবার খেয়ে বাবার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম ব্যাট–বল নিয়ে। প্রথমবারের মতো ব্যাট হাতে নিলাম, বাবা শেখালেন কীভাবে ব্যাট করতে হয়। মনে আছে, একটা শট এত জোরে মারলাম যে বলটা চলে গিয়েছিল পাশের বাড়িতে!
সন্ধ্যায় মা বেরিয়ে যান অ্যারোবিকস ক্লাসের জন্য। বাবাকে দেখলাম টিভিতে ক্রিকেট ছেড়ে বসেছেন। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমটা ভেঙে গেল অল্প কিছুক্ষণ পরই। শুনতে পেলাম, বাবা ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকছেন, ‘ডিওন।’
ডাক শুনে ছুটে গেলাম। দেখে মনে হলো নিশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। অনেক চেষ্টা করে বললেন, ‘তোমার দাদিকে ডেকে আনো।’
দাদি পাশেই থাকতেন। বাবাকে দেখে বলে উঠলেন, ‘গ্যারি, তোমার হাঁপানির অ্যাটাক হচ্ছে।’ দাদির কণ্ঠে এমন কিছু একটা ছিল, যেটা আগে কখনো শুনিনি আমি। ‘শান্ত হও গ্যারি, আমাদের সঙ্গেই থাকো!’ প্যারামেডিকরা যখন বাবাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলছে, তখনো তিনি নিশ্বাস নিতে পারছিলেন না, মাথা ঝাঁকাচ্ছিলেন অনিয়ন্ত্রিতভাবে।
ওই শেষ, এরপর বাবার সঙ্গে আর দেখা হয়নি আমার।
বাবা মারা যাওয়ার পর মা একদমই ভেঙে পড়েন। সারা দিন কাঁদতেন। আমার আর আমার ছোট বোনের দেখাশোনা করতেন দাদি। এক সন্ধ্যায় হুট করেই মা বলে বসলেন, ‘গ্যারি তোমার আসল বাবা নয়।’
এর কী জবাব দিয়েছিলাম, ঠিক মনে নেই আমার। খবরটায় আমি খুব চমকে যাই, এ জন্য হয়তো। বাবাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেওয়ার সময়টায় বদলে যায় আমার জীবন, আর মায়ের ওই কথায় ভেঙে যায় হৃদয়।
গ্যারি আমার আসল বাবা নন—কথাটা ভেবেই আমি লজ্জায় কুঁকড়ে যেতাম। খুব ছোট একটা শহরে থাকতাম। মনে হতো, আমার সব বন্ধুর পরিবার একদম ঠিকঠাক, শুধু আমারটা বাদে। আশপাশের মানুষও আমাকে ভিন্ন চোখে দেখা শুরু করল। এক শনিবারে এক বন্ধুর বাসায় গেলাম, ওকে ডাকতে। বন্ধু তো বের হলোই না, উল্টো ওর মা বলে উঠল, ‘ডিওন, আমরা চাই না তুমি আর এখানে আসো।’ প্রচণ্ড মন খারাপ করে বাড়ি ফিরলাম সেদিন।
স্কুলে কখনো জোরে কথা বলিনি। বেশ শান্তশিষ্ট আর ভদ্র হয়ে থাকতাম সব সময়। কিন্তু আস্তে আস্তে আমার মধ্যে পরিবর্তন আসতে লাগল। মা সারা দিন ঘরেই পড়ে থাকতেন। আমরা খুব ছোট ছিলাম। ফলে ঘর গোছানো কিংবা বাগান পরিষ্কার করা—ঠিকমতো কোনো কাজ করতে পারতাম না। মা কেন যেন এগুলো বুঝতেন না। একটু এদিক–সেদিক হলেই বকাঝকা শুরু করতেন। প্রথম দিকে সহ্য করলেও একসময় পাল্টা জবাব দেওয়া শুরু করি আমিও। ক্রমেই এই কথা–কাটাকাটি রূপ নিত ঝগড়ায়। কিন্তু মা বা আমি, কেউই দিন শেষে কারও কাছে ক্ষমা চাইতাম না।
১৫ বছর হওয়ার পরপরই বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমি। একটা পেট্রলপাম্পে কাজ করতাম, যেন নিজের চলার খরচটা জোগাড় করতে পারি। পড়ালেখাও চালিয়ে যাচ্ছিলাম, তবে স্কুলে পরিচিতি পেয়ে যাই বদমেজাজি আর রগচটা হিসেবে। শিক্ষকেরাও এড়িয়ে চলা শুরু করলেন আমাকে। মাঝেমধ্যে বের করে দিতেন ক্লাস থেকেও। সারা জীবন হয়তো এমনই থাকতাম, যদি লুজার সঙ্গে পরিচয় না হতো। ওর জন্যই আস্তে আস্তে পরিবর্তন আসে আমার মধ্যে। ধীরে ধীরে আবারও ধীরস্থির আর শান্ত হই আমি।
নিজ দেশ থেকে বহুদূর চীনে বসে, একটা কুকুরের দিকে তাকিয়ে আমার এসব মনে পড়ার কোনো কারণ নেই। হয়তো নিঃসঙ্গ কুকুরটি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল আমার একাকিত্বের দিনগুলোতে। কী জানি!
ম্যারাথনটা আমি শেষ করি দ্বিতীয় স্থানে থেকে। শুধু আমি না, দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে গোবিও! সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে একজন হুট করে আমাকে বলে বসে, ‘এই মিস্টারকে নিয়ে কী করবে? মনে হচ্ছে ও তো তোমার সঙ্গ ছাড়বেই না।’ বুঝলাম ও গোবির কথা বলছে। আমি ভাবতে লাগলাম, একে নিয়ে কী করা যায়। গোবির প্রতি তত দিনে মায়া জন্মে গেছে। আবার ক্যাম্পের অনেক মানুষের ভিড়ে গোবি ছুটে এসেছে আমার কাছে, এই ব্যাপারটাও আমাকে নাড়া দিয়েছিল প্রবলভাবে। কিন্তু যেহেতু নিশ্চিত ছিলাম না, কুকুরটার কোনো মালিক আছে কি না, তাই ওকে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে কি না, বুঝতে পারছিলাম না আমি। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে আমি ফোন দিলাম লুজাকে। আমাকে অবাক করে দিয়ে লুজা প্রথমেই বলে উঠল, ‘গোবি কেমন আছে? ওকে নিয়ে আসছ তো?’
জানতে পারলাম, ম্যারাথনে আসা কয়েকজন প্রতিযোগী নিয়মিত ব্লগে লেখে। ওরাই আমার আর গোবির কথা লিখেছে, সেখান থেকে জেনেছে লুজা।
শেষ পর্যন্ত সেবার গোবিকে নিয়ে আসতে পারিনি আমি। ম্যারাথনের এক স্বেচ্ছাসেবকের জিম্মায় ওকে রেখে স্কটল্যান্ডে চলে আসি। ফেরার পর থেকেই আমি আর লুজা খোঁজখবর করতে থাকি, কীভাবে অন্য দেশ থেকে একটা কুকুরকে দেশে নিয়ে আসা যায়। সব তথ্য সংগ্রহ করে একটু দমে গেলাম। বিদেশ থেকে একটা কুকুরকে নিয়ে আসতে যে এত বিশাল টাকা খরচ হতে পারে, সেটা আমরা কল্পনাও করিনি। সিদ্ধান্ত নিলাম, গোবিকে নিয়ে আসার জন্য আমরা ক্রাউড-ফান্ডিং করব। আর আমাদের এই খবর ছেপে দিল ডেইলি মিরর। ব্যস, দুইয়ে মিলে আমরা পেয়ে গেলাম গোবির জন্য পর্যাপ্ত ফান্ড।
সবকিছু ঠিকমতো এগোচ্ছিল। এমন সময় সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এক সমস্যা দেখা দিল। চীন থেকে হঠাৎ খবর এল, গোবিকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! কিকি নামের যে স্বেচ্ছাসেবকের জিম্মায় গোবিকে রেখে এসেছিলাম, সে জানাল, আগের দিন সকালে সবার অগোচরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে গোবি। আর ফিরে আসেনি।
আমি আর লুজা বুঝতে পারলাম, গোবিকে খুঁজে বের করতে হলে চীনে যেতে হবে আমাকে। সমর্থন পেলাম অফিস থেকেও। কিছুদিন পরই প্লেনে চেপে বসলাম চীনের উদ্দেশে। ম্যারাথন নয়, এবারের মিশন—ফাইন্ডিং গোবি!
চীনে নেমে সবার আগে যোগাযোগ করলাম কিকির সঙ্গে। গোবিকে খুঁজে বের করার জন্য একটা দল বানিয়েছে ও, পরিচিত হলাম ওদের সঙ্গে। সবাই মিলে আমরা পোস্টার লাগালাম, মানুষের বাসায় বাসায় গিয়ে জিজ্ঞেস করা শুরু করলাম। ওই এলাকার মানুষ যে রকম স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমার মতো অপরিচিত এক ব্যক্তিকে সাহায্য করছিল, তা দেখে আমি অভিভূত। তবু গোবিকে খুঁজে পাওয়া বেশ অসম্ভবই মনে হচ্ছিল। কারণ, উরুমকি নামের যে শহরে ও হারিয়েছে, সেখানে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ বাস করে। একমাত্র ভাগ্যের সহায়তা ছাড়া গোবিকে খুঁজে পাওয়া ছিল অনেকটা অবাস্তব কল্পনা।
বেশ কয়েক দিন খুঁজেও গোবির কোনো হদিস না পেয়ে আমরা স্থানীয় টিভি আর পত্রপত্রিকার সাহায্য নিলাম। টিভি রিপোর্টার প্রথমে খুব অবাক হলো। সে কোনোভাবেই বুঝতে পারছিল না, স্কটল্যান্ডের একটা লোক কেন চীনে এসে এত ব্যস্ত হয়ে একটা রাস্তার কুকুরকে খুঁজে বেড়াচ্ছে! তবে তার রিপোর্ট কাজে দিল। পরদিন গোবিকে খুঁজতে আমাদের দলে যোগ দিলেন আরও অনেক স্থানীয় মানুষ।
গোবি হারিয়ে যাওয়ার ১৪ দিনের মাথায় আমরা একটা ফোন পাই। গোবির মতো দেখতে একটা কুকুরকে উদ্ধার করে বাসায় নিয়ে এসেছে বলে জানায় লোকটি। ফোনে ছবিও পাঠায় সে, তবে সেটি ঘোলা হওয়ায় ঠিক নিশ্চিত হওয়া গেল না, কুকুরটা গোবি কি না। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি লোকটার ঠিকানায় ছুটে গেলাম। সামান্য কোনো সম্ভাবনাও আর ফেলে দেওয়ার মতো অবস্থায় ছিলাম না আমি।
ওই বাড়িতে পা রাখতেই দূর থেকে খুব পরিচিত একটা ডাক শুনতে পাই। আর মুহূর্তের মধ্যেই ভেতর থেকে কী যেন একটা দৌড়ে এসে লাফাতে থাকে আমার পায়ের কাছে। ‘গোবি, এটা গোবি!’ বলে চিৎকার করে ওকে কোলে তুলে নিই আমি। তখনো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, আসলেই আমি খুঁজে পেয়েছি ওকে! সঙ্গে সঙ্গেই লুজাকে ফোন দিয়ে বললাম, ‘আমরা গোবিকে খুঁজে পেয়েছি!’
এর বেশি কিছু আর বলতে পারিনি ওকে। কখন যে দুজনেই কাঁদতে শুরু করি, তা বুঝতেই পারিনি!
গোবিকে খুঁজে পেলেও তখনই আমরা দেশে ফিরতে পারিনি। প্রথমেই গোবির একটা অপারেশন করাতে হয়। গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে ওর hip dislocated হয়ে গিয়েছিল। এরপর আরও বেশ কিছু প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আমরা স্কটল্যান্ডে ফিরি প্রায় চার মাস পর।
আগে ছুটির দিনে আমি আর লুজা মিলে পাহাড়ে দৌড়াতে যেতাম। এখন যুক্ত হয়েছে গোবি। আমরা দুজনেই একমত, গোবিই আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো পাহাড় চড়তে পারে। কিছুক্ষণ দৌড়ে যখন হাঁপিয়ে যাই, গোবি পেছন ফিরে ডাকতে থাকে আমাদের। আমি আর লুজা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠে আবার দৌড় শুরু করি।
আর আমাদের সামনে ছুটতে থাকে গোবি।
মূল লেখক: ডিওন লিওনার্দ
(রিডার্স ডাইজেস্ট থেকে)