লস অ্যাঞ্জেলেসের দাবানল নিয়ন্ত্রণ কেন অসম্ভব
সামরিক শক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের তুলনা হয় না। এই দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনন্য। তবে এমন শক্তিধর রাষ্ট্রটি গত বুধবার থেকে অসহায়ের মত ভুগছে। আগুনের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে একটি অঞ্চলের বাসিন্দারা। যুদ্ধের সময় যেমন সর্বশক্তি দিয়ে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা চলে, ক্যালিফোর্নিয়া ঠিক সেভাবে দাবানলের প্রতিরোধের চেষ্টা করছে। কিন্তু এই যুদ্ধে জয় আসেনি। পুরে গেছে হাজার হাজার একর জমি, বসতবাড়ি আর পাহাড়।
এই দাবানলকে তুলনা করা হয়েছে হারিকেনের সঙ্গে। শক্তিশালী হারিকেন যেমন সবকিছু ধ্বংস করে দেয়, এই দাবানলকে বলা হচ্ছে আগুনের হারিকেন। ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে মিশে আছে আগুন। তীব্র বাতাসের সাথে ভয়ংকর আগুনের দেয়াল লস অ্যাঞ্জেলেসের উপত্যকাকে গ্রাস করছে। গোটা এলাকা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আগুন নেভাতে দমকল বাহিনী হিমশিম খেয়েছে। পানি ঢালতে ঢালতে পানি ফুরিয়ে যাচ্ছে, আগুন নিভছে না। দমকলকর্মীদের হোসপাইপে পানির চাপ কমে গেছে। ছাই উড়ে উড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। হাজার হাজার মানুষ ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। সবার মুখে মাস্ক। ধোঁয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে সবাই।
যারা লস অ্যাঞ্জেলেসের এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখছে, তাদের কাছে এমন পরিস্থিতি একেবারেই নতুন। এটি ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দাবানল বিপর্যয়। এই অঞ্চলের বাসিন্দারা মনে করছেন, হয়তো এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দাবানল বিপর্যয়।
এই বিপর্যয়ের মাত্রা কতটা ভয়ংকর, তা অনুমান করা যায় ক্যালিফোর্নিয়া দাবানল প্রতিরোধে কতটা প্রস্তুত ছিল। এই রাজ্যের বন ও অগ্নি সুরক্ষা বিভাগ ক্যাল ফায়ার নামে পরিচিত। প্রতিবছর আগুন প্রতিরোধ ও মোকাবিলায় ৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে এই বিভাগ। গত এক দশকে এই বিপুল অর্থ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে ১২ হাজার কর্মীর বিশাল বাহিনী। আছে একটি বিমান বাহিনী। এই বিমান বাহিনী অনেক দেশের বিমান বাহিনীর চেয়েও বড়।
তবু এমন ভয়াবহ আগুন প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। প্রায় ৯ হাজার দমকলকর্মী এই দাবানল নিয়ন্ত্রণে কাজ করলেও প্রতি মিনিটে শত শত গজ এগিয়ে আসা আগুনের সামনে তাঁরা অসহায়। তাঁরা বলেছেন, ‘আমাদের এখানে যত অগ্নিনির্বাপক কর্মী আছে, তা এই পরিস্থিতি সামলানোর জন্য যথেষ্ট নয়।’
মানুষের সংখ্যা কম থাকা আগুন নেভাতে ব্যর্থতার কারণ না। আবহাওয়া এর জন্য দায়ী। বৃষ্টি না হওয়ায় সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে ঝোপঝাড়। আবার ১০০ মাইল প্রতি ঘণ্টার গতিতে বাতাস ছুটছে। সর্বোচ্চ চেষ্টাও এই বাতাসে উড়ে যাওয়া বিচিত্র না। যখন বাতাস এত জোরে বয়, তখন আসলে আগুন থামানোর কিছু নেই। তখন কেবল সরে যাওয়াই সঠিক কাজ।
ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানলের ঘটনা নতুন না। প্রতি বছরই ঘটে। তবে এর একটি নির্দিষ্ট ধরণ আছে। শীতকালে দাবানলের ঝুঁকি কম থাকে। কারণ তখন বেশি বৃষ্টি হয়। এরপর গ্রীষ্ম এলেই দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া শুকিয়ে যায়, তাপমাত্রা বাড়ে। ফলে বাড়ে দাবানলের সংখ্যা। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি থাকে শরৎকালে। শরতে এখানে সান্তা আনা (বাতাসের স্রোত) বাতাস আসে। এই বাতাস মরুভূমি থেকে আসে। উপত্যকার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় আরও গরম ও শুষ্ক হয়ে যায়।
এই অঞ্চলের ইতিহাস অনুযায়ী শীতকালের বৃষ্টির আগমনের সঙ্গে দাবানলের ঝুঁকি কমে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই ধারা বদলে গেছে। জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘ক্যালিফোর্নিয়ায় বৃষ্টির মৌসুম গড়ে এক মাস দেরিতে শুরু হচ্ছে, যা দাবানলের ঋতু লম্বা এবং আরও বিপজ্জনক করে তুলছে।’
এ ঘটনা শুধু দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় নয়, সারা বিশ্বেই দেখা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া এবং আবহাওয়া শুষ্ক হয়ে যাওয়ায় দাবানলের সংখ্যা বাড়ছে। বেড়ে গেছে তীব্রতা। এমনকি রাশিয়ার আর্কটিক অঞ্চলেও ব্যাপক দাবানলের ঘটনা ঘটছে। দক্ষিণ-পূর্ব অস্ট্রেলিয়ায় আগুনের তীব্রতা বেড়েছে। ইউরোপেও দাবানলের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।
দাবানল প্রতিরোধে ক্যালিফোর্নিয়ায় শত শত সেন্সর দিয়ে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা পর্যবেক্ষণ করা হয়। ক্যামেরাগুলো পাহাড়ের চূড়া থেকে নজরদারি করে এবং স্যাটেলাইট থেকে ডেটা সংগ্রহ করে। এরপর তথ্যগুলো সুপারকম্পিউটারে বিশ্লেষণ করে আগুনের ঝুঁকির মডেল তৈরি করে।
তবে এমন আধুনিক কৌশল থাকা সত্ত্বেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সামনে অনেক সময় কিছুই করার থাকে না। যেমন এবার আবহাওয়ার এই চরম পরিস্থিতিতে বিমানও ওড়াতে অসুবিধা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দাবানলের এই প্রবণতা কেবল বাড়তেই থাকবে।