লস অ্যাঞ্জেলেসের দাবানল নিয়ে এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে
লস অ্যাঞ্জেলেসে দাবানল ঠিক কীভাবে শুরু হয়েছে, এখন পর্যন্ত কেউ জানে না। তবে আগুন জ্বালানোর জন্য সন্দেহভাজন একজনকে নিরাপত্তা হেফাজতে নিয়েছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দাবানলটি প্রথমে পালিসেডস অঞ্চল থেকে শুরু করে হলিউড হিলস পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। যার মধ্যে আছে সানসেট এলাকা, ইটন, হার্স্ট, ও লিডিয়া অঞ্চল।
এমন দ্রুত গতিতে এত বড় আগুন কীভাবে ছড়িয়ে পড়ল, তা দেখে বিশেষজ্ঞরাও বিস্মিত। গত ৭ জানুয়ারি মঙ্গলবার রাতে নর্থ লস অ্যাঞ্জেলেসে ব্যাপক আকারে আগুন জ্বলে ওঠে। বুধবারে এই আগুন দাবানল আকারে ছড়িয়ে পড়ে।
শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পালিসেডস ফায়ারে প্রায় ৫ হাজার এবং ইটন ফায়ারে প্রায় ৭ হাজার অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। দাবানল সম্পর্কিত কারণে মারা গেছেন অন্তত ১১ জন। পালিসেডস ফায়ারে ৫ জন এবং ইটন ফায়ারে ৬ জন মারা গেছেন। লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টি শেরিফ রবার্ট লুনা বলেছেন, মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
পালিসেডস দাবানল: যেভাবে ছড়াল
পালিসেডস দাবানল গত মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকাল ১০:৩০ এ শুরু হয়। আগুন শুরু হওয়ার মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে তোলা একটি ছবিতে এর তীব্রতা স্পষ্ট দেখা যায়। দুপুরের মধ্যেই আগুনটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সান্তা মনিকা ও মালাবু উপকূলীয় শহরের মধ্যবর্তী অঞ্চল পুড়িয়ে ফেলে। মধ্যরাতের মধ্যে পুড়ে যায় প্রায় ৩ হাজার একর এলাকা। অসংখ্য ভবন ও বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যায়। এত বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, কর্মকর্তারা এখনো পুরো ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করতে পারেননি।
দাবানলের কারণ ও প্রতিকূল পরিস্থিতি
দাবানলের সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো চিহ্নিত করা যায়নি। তবে জানা গেছে, দাবানলটি উত্তর-পূর্ব দিক থেকে আসা প্রবল শুষ্ক বাতাসের কারণে আরও তীব্র হয়েছে। এই বাতাস সান্তা আনা বাতাস নামে পরিচিত। লস অ্যাঞ্জেলেসের পার্বত্য অঞ্চলে বাতাস প্রবেশ করে গতি বেড়ে যায়। এই ঝোড়ো বাতাস দাবনল দ্রুত ছড়ানোর ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে।
সান্তা আনা বাতাস এই অঞ্চলে আর্দ্রতা কমিয়ে দেয়। আদ্রতা কমে গেলে ভূমি আরও শুষ্ক ও দাহ্য হয় বলে। এই বাতাসের গতি ঘণ্টায় ৬০ মাইল পর্যন্ত পৌঁছেছে বলে পরিস্থিতি এমন চরম অবস্থায় পৌঁছেছে। অবস্থা এমন হয়েছে, তীব্র বাতাসের কারণে কিছু এলাকায় অগ্নিনির্বাপক বিমান পর্যন্ত ওড়ানো সম্ভব হয়নি। দমকল কর্মকর্তারা বলেছেন, ‘কম আর্দ্রতা, শুষ্ক মাটি ও প্রবল বাতাস মিলে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না।’
দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় সম্প্রতি খুব উষ্ণ গ্রীষ্মকাল শেষ হয়েছে। এই অঞ্চলে খুব সামান্য বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফলে ভূমি পুরো শুকিয়ে আছে। এই এলাকার বৃষ্টিপাতের মানচিত্রে দেখা গেছে, লস অ্যাঞ্জেলেসের আশপাশের এলাকাগুলোতে গত ৬০ দিনে প্রায় কোনো বৃষ্টিপাত হয়নি। ভূমিকে আরও দাহ্য করে তুলেছে এই না হওয়া।
এই দাবানলে প্রশান্ত মহাসাগরের তীর বরাবর প্যাসিফিক কোস্ট হাইওয়ে সংলগ্ন পালিসেডস ফায়ার আকারে সবচেয়ে বড়। ২১ হাজার একরেরও বেশি এলাকা পুড়ে গেছে। শুক্রবার বিকেল নাগাদ এর মাত্র ৮ শতাংশ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে।
দাবানলের দ্বিতীয় বৃহত্তম আগুন জ্বলছে ইটন শহরে। পাসাডেনার উত্তরে সান গ্যাব্রিয়েল পর্বতমালায় এর অবস্থান। এটি ১৪ হাজার একরের বেশি এলাকা পুড়িয়ে দিয়েছে। ধ্বংস করেছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি। শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত মাত্র ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে।
সিলমার এলাকায় শুরু হওয়া আগুন প্রায় ৮০০ একর এলাকা জ্বালিয়ে ধীরে ধীরে কমে এসেছে অ্যাঞ্জেলস ন্যাশনাল ফরেস্টে লিডিয়া ফায়ার, ৪০০ একর এলাকা পুড়িয়ে দিয়েছে। লিডিয়ার ৭৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
অন্যান্য দাবানলের পরিস্থিতি
ইটন দাবানল: মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬:৩০ থেকে শুরু হয়ে এটি প্রথম ৬ ঘণ্টায় ১ হাজার একর এলাকা জ্বালিয়ে দিয়েছে। বুধবার রাতের মধ্যে এটি প্রায় ১০ হাজার একরে পৌঁছায় এবং ৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
হার্স্ট দাবানল: সান ফার্নান্দোর উত্তরে রাত ১০:১০ নাগাদ শুরু হয়ে এটি দ্রুত ৮৫০ একর এলাকা পুড়িয়ে ফেলে। সান্তা ক্লারিটা থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
উডলি দাবানল: বুধবার সকাল ৬:১৫ নাগাদ উডলি পার্কে শুরু হলেও এটি এখন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে।
সানসেট দাবানল: হলিউড হিলসের একটি আবাসিক এলাকায় সন্ধ্যা ৬টার দিকে শুরু হয়ে এটি এখনো ৫০ একর এলাকায় (১০ জানুয়ারি পর্যন্ত) বিস্তৃত হয়েছে এবং কোনো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি।
যেভাবে চলছে আগুন নেভানোর কার্যক্রম
বর্তমানে আগুন নেভানোর কাজ করছেন সারে সাত হাজারের বেশি অগ্নিনির্বাপন কর্মী। ব্যবহার করা হচ্ছে ১ হাজার ১৬২টি ফায়ার ইঞ্জিন। এগুলো কৌশলগত জায়গাগুলো থেকে আগুনের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করছে। এছাড়া ৩১টি হেলিকপ্টার আকাশে উড়ে উড়ে পানি ফেলছে। এগুলোকে সহায়তা দেওয়ার জন্য আছে ৬টি বড় ওয়াটার ট্যাঙ্কার বিমান। দূরের এবং কৌশলগত জটিল এলাকাগুলোয় আগুন নেভানোর কাজ করছে।
এই প্লেনের বড় সুবিধা হলো এটি দূরের কোনো এয়ারপোর্টে অবতরণ করার প্রয়োজন নেই। সরাসরি জলাশয় থেকে পানি সংগ্রহ করতে পারে। প্লেনটি একটি জলাশয়ের কাছে পৌঁছে সাবধানে নিচের বিশেষ স্কুপ নামিয়ে দিয়ে পানির ওপর দিয়ে সামনে এগোলে দ্রুত পানির ট্যাঙ্ক ভরে যায়। ট্যাঙ্ক ভরে গেলে প্লেনটি দ্রুত ওপরে ওঠে। দ্রুত নির্ধারিত এলাকার দিকে রওনা হতে পারে। আগুনের ওপর পৌঁছে পানি ফেলে আগুন নেভাতে সাহায্য করে।
সূত্র: সিএনএন এবং ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক