পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে। আমরা এমনটাই বলি। শুধু পৃথিবী নয়, বৃহস্পতি, শনিদের ক্ষেত্রেও একই কথা বলি আমরা। তবে আসলে কিছুটা ঘাপলা আছে। কী সেই ঘাপলা? চলো জেনে নিই।
পৃথিবী হলো গ্রহ। আর সূর্য নক্ষত্র। গ্রহ ঘোরে নক্ষত্রের চারপাশে। সে জন্যই আমরা বলি, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে। আসলে দুজনই প্রদক্ষিণ করে তাদের যৌথ ভরকেন্দ্রকে। এর গালভরা নাম ব্যারিসেন্টার। মজার ব্যাপার হলো, ব্যারিসেন্টার সৌরজগতের বাইরের গ্রহ খোঁজার ব্যাপারেও দারুণ কাজে লাগে!
তো, এই ব্যারিসেন্টার বা ভরকেন্দ্র আসলে কী? প্রতিটি বস্তুর ভরের একটা কেন্দ্র আছে। এটা হলো বস্তুটার উপাদান পদার্থের একদম নিখুঁত কেন্দ্র। ভরকেন্দ্রবিন্দুতে বস্তুটাকে সঠিকভাবে ভারসাম্যে রাখা যায়।
অনেক সময় ভরকেন্দ্র থাকে বস্তুর ঠিক কেন্দ্রে। যেমন ধরো একটা রুলার। এর মাঝবরাবর এখানে-ওখানে কয়েকবার আঙুল রেখে ধরে রাখার চেষ্টা করো। পেয়ে যাবে সে জায়গা, যেখানে আঙুল রাখলে রুলার পড়ে যাবে না। এটাই রুলারের ভরকেন্দ্র। অপর নাম অভিকর্ষকেন্দ্র।
অনেক সময় ভরকেন্দ্র আর বস্তুর কেন্দ্র একই জায়গায় হয় না। কেন? ধরো ২ ও ৪ দুটি সংখ্যা। এদের গড় ৩, যা ২ ও ৪–এর ঠিক মাঝখানে বা কেন্দ্রে আছে। কিন্তু ২, ৪, ৪ সংখ্যা তিনটির গড় কত? ৩.৩৩, যা ২ ও ৪–এর ঠিক মাঝখানে নয়। সংখ্যার অসম বিন্যাসে পাল্টে গেছে কেন্দ্র। ৪–এর পরিমাণ ২–এর চেয়ে বেশি হওয়ায় গড় ৪–এর দিকে সরে এসেছে।
ভরের ক্ষেত্রেও এটাই ঘটে। ভর একেক দিকে একেক রকম হলে সরে যায় কেন্দ্র। যেমন ধরো, হাতুড়ি। এর প্রায় সবটা ভর এক প্রান্তে আছে। ফলে ভরকেন্দ্রও ভারী প্রান্তটির কাছাকাছি। বস্তুর সবচেয়ে বেশি ভর যেদিকে থাকে, ভরকেন্দ্রও তার কাছাকাছি থাকে।
সূর্য ও পৃথিবীরও একটি ভরকেন্দ্র বা ব্যারিসেন্টার আছে। তবে সূর্যের ভর পৃথিবীর তুলনায় অনেক অনেক বেশি। সৌরজগতের ৯৯.৮৬ ভাগ। সূর্য তাই হাতুড়ির ভারী মাথার মতো বা তার চেয়ে প্রভাবশালী। ফলে সূর্য ও পৃথিবীর ব্যারিসেন্টার সূর্যের কেন্দ্রের খুব কাছাকাছি। তাও ভেতরেই।
বৃহস্পতি পৃথিবীর চেয়ে অনেক বড়। ভর ৩১৮ গুণ। ফলে সূর্য ও বৃহস্পতির ব্যারিসেন্টার সূর্যের ভেতরে নয়। কিছুটা বাইরে। ফলে শুধু এই দুটি বস্তুকে আলাদা করে দেখলে ব্যাপারটাকে বাইনারি স্টার বা জোড়া তারার মতো মনে হবে। মানে বৃহস্পতি সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে না। দুজনই দুজনকে কেন্দ্র করে ঘুরছে!
পুরো সৌরজগতেরও একটি ব্যারিসেন্টার আছে। সূর্য, পৃথিবী ও সৌরজগতের গ্রহ ও অন্য সব বস্তু সেই ব্যারিসেন্টারকে প্রদক্ষিণ করে। এই ব্যারিসেন্টার সৌরজগতের সব বস্তুর সমন্বিত ভর ধারণ করে আছে। তবে এই ভরকেন্দ্র হাতুড়ির মতো নয়। নয় স্থির কোনো জায়গায়। প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। কারণ, সব বস্তু এখানে গতিশীল। ব্যারিসেন্টার হতে পারে সূর্যের কেন্দ্রের খুব কাছে। আবার হতে পারে সৌরপৃষ্ঠেরও বাইরে।
ব্যারিসেন্টার কীভাবে গ্রহ খুঁজে পেতে কাজে আসে, তা এখন বোঝা যাচ্ছে। নক্ষত্রের কোনো গ্রহ থাকলে এর ব্যারিসেন্টার দোল খেতে থাকে এদিক-সেদিক।
সৌরজগতের বাইরের গ্রহগুলোকে দেখে শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব। নক্ষত্রের আলোর ঝলকে এদের মৃদু প্রতিফলিত আলো হারিয়ে যায়। তবে নক্ষত্রের দোল খাওয়া দেখে এদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। আর এভাবে প্রচুর বহির্গ্রহ আবিষ্কারও করা হয়েছে। সংখ্যাটাও কম নয়, সব মিলিয়ে ১০৩৬। আবিষ্কৃত গ্রহের সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় সফল কৌশল এটি। সবচেয়ে কার্যকর কৌশল হলো নক্ষত্রের চারপাশে ঘোরা গ্রহের ট্রানজিট বা অতিক্রমণ। অতিক্রমণ দেখে পাওয়া গেছে প্রায় চার হাজার গ্রহ। সে গল্পের বিস্তারিত আরেক দিন শোনাব তাহলে।