১৯২৯ সালে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে পরলোকচর্চা বা প্ল্যানচেটের একটি আসর বসেছিল। আসরের মধ্যমণি ৬৮ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এ রকম আসর মাঝেমধ্যেই বসত। রবীন্দ্রনাথ তাঁর মৃত আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের আত্মাকে নামিয়ে আনতেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলতেন।
১৯২৯ সালের ৬ নভেম্বরের ওই আসরে ছায়া ছায়া অন্ধকার ঘরে যাঁর আত্মাকে ডেকে আনা হয়েছিল, তিনি সত্যজিৎ রায়ের বাবা সুকুমার রায়। বছর সাতেক আগে ৩৬ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। সুকুমার রায়ের আত্মার সঙ্গে অনেক বিষয়ে কথা হয় রবীন্দ্রনাথের। সত্যজিৎ রায়কে নিয়েও কিছু আলাপ হয়। যেমন সুকুমার রায় অনুরোধ করেন, সত্যজিৎ রায়কে যেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিশ্বভারতীতে স্থান দেন ছাত্র হিসেবে। এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ একটা অদ্ভুত বিষয়ে জানতে চান সুকুমার রায়ের কাছে। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, ‘আর্থার কোনান ডয়েল শুনলুম পরলোক থেকে বার্তা পাচ্ছেন, কথা সত্যি?’ সুকুমার রায় জবাব দেন, ‘সত্যি। তবে বিস্তর কল্পনার মিশেলও আছে।’
পরলোকচর্চাকারী রবীন্দ্রনাথ যে কোনান ডয়েলের পরলোকচর্চা বিষয়ে জানতে আগ্রহী হবেন, এটা তেমন আশ্চর্যের বিষয় নয়। দুই মহাদেশে বসবাসকারী প্রায় সমবয়সী এ দুই লেখকের মধ্যে পরলোকচর্চা নিয়ে যোগাযোগ যে হয়েছিল, তার আরও কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন কোনান ডয়েলের একটি চিঠি পাওয়া যায়, যেখানে দেখা যায়, তিনি তাঁর এক বন্ধুকে অনুরোধ করছেন ভারতে ‘টেগোর’ নামের এক ব্যক্তির কাছে একজন নির্ভরযোগ্য ‘মিডিয়ামকে’ পৌঁছে দিতে। ‘মিডিয়াম’ কী জিনিস? মিডিয়াম হচ্ছে আত্মাকে নামিয়ে আনার মাধ্যম হিসেব ব্যবহৃত ব্যক্তি। মৃত ব্যক্তির আত্মা এসে ভর করেন এই মিডিয়ামদের ওপর। যার তার ওপর তাঁরা ভর করেন না, আত্মাদের রুচিবোধ বড় তীক্ষ্ম। এ জন্য সব পরলোকচর্চাকারীদের মধ্যেই ভালো মিডিয়ামের খোঁজ নিয়ে তথ্য আদান-প্রদান ঘটে।
এটা খুবই অদ্ভুত ব্যাপার যে শার্লক হোমসের মতো এমন যুক্তিনির্ভর, বিজ্ঞানমনস্ক একটি চরিত্রের স্রষ্টা কোনান ডয়েল পরলোকচর্চায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। কিন্তু ডয়েল শুধু এর চর্চাকারীই ছিলেন না, তিনি ইউরোপজুড়ে এ আন্দোলনের রীতিমতো নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। এ নিয়ে বিস্তর বইপত্র, প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন, আসরে আসরে বক্তৃতা দিয়ে বেরিয়েছেন। আর এসব করে তিনি তাঁর সুনাম যথেষ্ট পরিমাণে খুইয়েছেন। লোকে অবাক হয়েছে। বলেছে, এ কী যন্ত্রণা!
মৃত ব্যক্তিদের আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করার এ চর্চাকে বলে স্পিরিচুয়ালিজম। সেটির জন্ম হয়েছিল ১৮৫৯ সালে, ডয়েলের জন্মের ১১ বছর আগে ১৮৪৮ সালে, আমেরিকায়। ওই বছর নিউইয়র্কের হাইডসভিলে বসবাসকারী দুই বোন ম্যাগি ও ক্যাটি ফক্স দাবি করতে শুরু করেন, তাঁরা তাঁদেরই বাসায় বসবাসকারী এক আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন। ওই আত্মা এমন এক মৃত ব্যক্তির, যাকে ওই বাসাতেই হত্যা করে মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয়েছে।
সেই থেকে মৃত ব্যক্তির আত্মার সঙ্গে যোগাযোগের চর্চা শুরু। বেশ কিছু প্রথা-পদ্ধতিও দাঁড়িয়ে যায় এ চর্চার। কীভাবে আত্মাকে ডাকা হবে, তাদের সঙ্গে কী আদব-কেতায় কথা বলা হবে—এসব প্রথা। তবে ডয়েল যখন শার্লক হোমস লিখে বিখ্যাত হয়ে উঠছেন, তত দিনে স্পিরিচুয়ালিজম নিয়ে মাতামাতির দিন ফুরিয়ে গেছে মূলত অনেক ভুয়া ঘটনা ধরা পড়ে যাওয়ার কারণে। কিন্তু এ রকম অচল বিদ্যা কী করে কোনান ডয়েলের ওপর ভর করল, সেটি এক আশ্চর্যের ব্যাপার বটে। আরও বিদঘুটে ব্যাপার হলো বিজ্ঞানমনস্ক গোয়েন্দা শার্লক হোমস মানুষের কুসংস্কারের জগৎকে যুক্তির আলো ফেলে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছেন, ওই একই সময়ে তাঁর স্রষ্টা আর্থার কোনান ডয়েল ব্রিটেনজুড়ে বিভিন্ন ছায়াছন্ন আসরে বসে মিডিয়াম ব্যবহার করে আত্মা নামানোর কাজে ব্যস্ত। লেখক ও পরলোকচর্চাকারী আর্থার কোনান ডয়েল যেন দুই ভিন্ন ব্যক্তি। একই দেহে দুই ভিন্ন সত্তা। ড. জেকিল আর মিস্টার হাইড।
এক হিসাবে দেখা যায়, বাস্তবজীবনে নিজের সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্রের থেকে কোনান ডয়েল এমনই যোজন দূরত্বে ছিলেন যে তিনি শার্লক হোমসকে রীতিমতো অপছন্দই করতেন। ১৮৯১ সালে নিজের মা ম্যারিকে লেখা এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার ইচ্ছা করে হোমসকে মেরে ফেলি…। ও ভালো ভালো জিনিস থেকে আমার মনোযোগ অন্যত্র নিয়ে যায়।’
‘ভালো জিনিস’ মানে এখানে স্পিরিচুয়ালিটির চর্চা। স্পিরিচুয়ালিটিকে ভুয়া বলে উড়িয়ে দেওয়ার কারণে তিনি ওই সময়কার বিখ্যাত বিজ্ঞানী, লেখক ও দার্শনিকদের অনেকের ওপরই খাপ্পা ছিলেন। যেমন চার্লস ডারউইন, হাক্সলি ও হার্বার্ট স্পেনসারকে তিনি দুই চোখে দেখতে পেতেন না। দ্য নিউ রিভিলেশন বইয়ে তিনি সে আক্ষেপের কথা লিখেছেন। আবার এ–ও জানিয়ে দিয়েছেন যে ডারউইনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস বা তখনকার সবচেয়ে নামকরা জ্যোতির্বিদ ফ্ল্যামারিয়নের মতো মহীরুহরা স্বীকার করে নিয়েছেন, মৃত্যুর পরও আত্মা টিকে থাকে।
স্পিরিচুয়ালিজমের চর্চার ব্যাপারে ডয়েল এতই সিরিয়াস ছিলেন যে এ নিয়ে একপর্যায়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিখ্যাত জাদুশিল্পী হ্যারি হুডিনির সঙ্গে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। হুডিনিকে স্পিরিচুয়ালিজমের চর্চায় ডয়েলেই টেনে এনেছিলেন। কিন্তু একপর্যায়ে হুডিনি এ চর্চাকারীদের বিপক্ষে চলে যান এবং ‘মিডিয়াম’ নামক ব্যক্তিদের ভণ্ড বলে আখ্যায়িত করে প্রচারে নেমে পড়েন।
১৮৯৩ সালে ডয়েল ‘ব্রিটিশ সোসাইটি ফর সাইকিক্যাল রিসার্চ’ নামের একটি সমিতিতে যোগ দেন। এ সমিতির অন্য সদস্যদের মধ্যে পরবর্তীকালের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী আর্থার ব্যালফোর যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস। ১৮৯৪ সালে কর্নেল এলমোর নামের এক ব্যক্তি এ সমিতির কাছে একটি অদ্ভুত অনুরোধ নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, ডর্সেট এলাকায় তাঁর গ্রামের বাড়িতে রাতের বেলা ভুতুড়ে সব আওয়াজ ভেসে আসছে। সমিতির লোকজনের উচিত গিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা, বাড়িটা সত্যি ‘হন্টেড’ বা ভূতের আছড়যুক্ত কি না।
অনুসন্ধানে নামলেন কোনান ডয়েলসহ সমিতির আরও দুই সভ্য। তাঁরা বেশ কয়েক দিন গিয়ে রাত কাটালেন পরিত্যক্ত সেই বাড়িতে। অপর দুই সদস্য ফিরে এসে জানালেন, কই কিছুই তো শুনতে পাননি তাঁরা। কিন্তু ডয়েল ফিরে এসে বললেন, তিনি শুনেছেন। অন্ধকারের বুক চিরে উঠে আসা পিলে চমকানো আওয়াজ তিনি শুনতে পেয়েছেন।
পরবর্তীকালে ওই বাড়ির বাগান থেকে ১০ বছর বয়সী এক শিশুর পুঁতে রাখা লাশ উদ্ধার হয়েছিল।