সব গ্রহের চাঁদ নেই কেন

নীলাকাশে নিজের রূপ মেলে ধরে উঠেছে পূর্ণিমার চাঁদ। প্রতীকীছবি: হাসান মাহমুদ

পৃথিবী থেকে রাতের আকাশে তাকালে দেখা মেলে চাঁদের। চাঁদ সবাই একভাবে দেখে না। মানুষের চাঁদ দেখার চোখ আলাদা। মা তাঁর সন্তানকে ঘুম পড়াতে চাঁদ দেখান, কবি-সাহিত্যিকেরা গল্প–কবিতা লেখেন চাঁদ দেখে। বিজ্ঞানীরা চাঁদ দেখেন এর রহস্য খুঁজে বের করতে। তবে সবাই এই একটা চাঁদই দেখে।

এটাই পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ, এ বিষয়টি একটু পরে বলছি। তার আগে বলি, তুমি যদি পৃথিবীতে না থেকে শুক্র গ্রহে থাকতে, তাহলে কিন্তু মোটেই চাঁদ দেখতে পেতে না। আবার মঙ্গল গ্রহে থাকলে প্রতি রাতে দুটি করে চাঁদ দেখতে পেতে। কেন কোনো গ্রহের একটা চাঁদও নেই, আবার অনেক গ্রহের একাধিক চাঁদ রয়েছে? পৃথিবীরই বা কেন শুধু একটা চাঁদ? চলো, সহজ করে বোঝার চেষ্টা করি।

খানিক আগেই আমরা চাঁদকে পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ বলেছি। এখানে প্রাকৃতিক শব্দটা একটু আলোচনা করা দরকার। শৈশবে তোমরা নিশ্চয়ই পড়েছ, কৃত্রিম আর প্রাকৃতিক বস্তু কী। আবার একটু মনে করিয়ে দিই। যা মানুষ নিজে তৈরি করতে পারে, তা–ই কৃত্রিম আর যা মানুষ তৈরি করেনি, তা–ই হলো প্রাকৃতিক। চাঁদ তেমন একটা প্রাকৃতিক বস্তু। অর্থাৎ চাঁদকে মানুষ তৈরি করে পৃথিবীর বাইরে পাঠিয়ে দেয়নি। মহাবিশ্বের নিয়ম মেনে চাঁদ তৈরি হয়েছে। কীভাবে তৈরি হয়েছে, সেটা আবার অনেক বড় আলোচনা। অন্য কোনো দিন সে প্রশ্নের উত্তর দেব।

যাহোক, প্রাকৃতিক চাঁদ বোঝা গেল। তাহলে তোমাদের মাথায় প্রশ্ন আসতে পারে, কৃত্রিম কোনো চাঁদ কি আছে পৃথিবীর। সে প্রশ্নের উত্তর হলো, ভূরি ভূরি। মানে মানুষের তৈরি আট হাজারের বেশি কৃত্রিম চাঁদ রয়েছে পৃথিবীর বাইরে যেগুলোকে আমরা স্যাটেলাইট বলি। এমনকি এর মধ্যে একটা বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট রয়েছে। নাম বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। এগুলো সবই পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘোরে। জানো নিশ্চয়ই, পৃথিবীর চারপাশে কোনো কিছু নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরলে সেটাকে চাঁদ বলা যায়।

এবার মূল আলোচনায় ফিরি। কেন সব গ্রহের চাঁদ নেই? তার আগে জানা দরকার, কোন কোন গ্রহের চাঁদ নেই। সৌরজগতে স্বীকৃত মোট আটটি গ্রহ আছে। এর মধ্যে শুধু দুটি গ্রহের চাঁদ নেই। বুধ ও শুক্র গ্রহ। কেন এই অভাগা গ্রহ দুটির চাঁদ নেই?

আরও পড়ুন

এটা বুঝতে হলে একটু বিজ্ঞান শিখতে হবে। মহাবিশ্বের সব বস্তু একে অন্যকে আকর্ষণ করে। একে বলে মহাকর্ষ বল। এই বলের কারণেই আমরা ভেসে যাই না, পৃথিবীতে স্থির থাকি। যে বস্তু যত বড়, সে বস্তুর আকর্ষণ বলও তত বেশি। একটা উদাহরণ দিই। ধরা যাক, তোমার ওজন ৩০ কেজি। কিন্তু তোমার একজন বন্ধু আছে, যার স্বাস্থ্য একটু বেশি ভালো। তার ওজন ৬০ কেজি। এখন একটা দড়ির দুই মাথা ধরে যদি তুমি আর তোমার বন্ধু টানাটানি করো, তাহলে কে জিতবে? তোমার বন্ধুর জেতার কথা। কারণ, ও তোমার চেয়ে আকারে বড় এবং ওর ওজন বেশি। ফলে ওর শক্তিও বেশি হওয়ার কথা।

আমাদের সৌরজগতে সবচেয়ে শক্তিশালী হলো সূর্য। সূর্যের এই আকর্ষণ বলে অনেক বেশি। তাই সূর্য বাকি সব গ্রহসহ অন্যান্য গ্রহাণু বা মহাকাশীয় বস্তুকে ঘুরতে বাধ্য করে। তবে সবচেয়ে বেশি শক্তি থাকলেও সূর্য এসব গ্রহকে টেনে একদম নিজের কাছে নিয়ে যেতে পারে না। আবার তোমার বন্ধুর ওই উদাহরণে যাই। তোমার বন্ধু হয়তো দড়ির মাথা ধরে টান দিলে তুমি তার কাছে চলে যাবে, কারণ তোমার চেয়ে ওর শক্তি অনেক বেশি। কিন্তু তোমার ওজন যদি ৩০ কেজি না হয়ে ৫০ কেজি হতো, তাহলে কি ও তোমাকে টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে যেতে পারত? পারত না। হয়তো তোমাকে জায়গা থেকে একটু সরিয়ে দিত। তবে একেবারে নিজের কাছে নিয়ে যেতে পারত না। সূর্যের অবস্থাও তোমার ওই কাল্পনিক বন্ধুটির মতো। আর বাকি সব গ্রহের অবস্থা তোমার মতো। সূর্য গ্রহগুলোকে নিজের পেটের মধ্যেও নিতে পারছে না, আবার গ্রহগুলোও সূর্যকে ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে পারে না। খুব সহজ করে এটা বললাম ঠিকই, কিন্তু বিষয়টা এত সহজ নয়। আরও বড় হলে নিশ্চয়ই বিস্তারিত জানতে পারবে তোমরা।

পৃথিবী, চাঁদ ও সূর্যের তুলনামূলক দূরত্ব থেকে তিনি ধরে নেন, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে।

গ্রহ ও নক্ষত্রের এই মহাকর্ষ বল যদি তুমি বুঝতে পারো, তাহলে বাকি প্রশ্নের উত্তরও সহজেই বুঝতে পারবে। বুধ গ্রহ সূর্যের সবচেয়ে কাছে এবং সবচেয়ে ছোট গ্রহ। ধরো, বুধ গ্রহের একটা উপগ্রহ ছিল। কল্পনা করছি শুধু। সেই উপগ্রহটা বুধের চারপাশে ঘুরবে। ঘুরতে ঘুরতে একসময় কিন্তু সূর্যের পাশ দিয়ে যেতে হবে। তখন সূর্যের আকর্ষণে ওই উপগ্রহের আর ফিরে আসতে হবে না বুধ গ্রহের কাছে। একদম সোজা সূর্যের পেটের ভেতরে ঢুকে যাবে। বুধ গ্রহকে পেটের মধ্যে ঢুকানোর ক্ষমতা এখন সূর্যের নেই ঠিকই, কিন্তু বুধের চেয়ে ছোট উপগ্রহকে তো নিজের কাছে টানতে পারবে। তাহলে বলতে পারি, সূর্যের কারণে বুধের কোনো উপগ্রহ নেই। একই কথা খাটে শুক্রের ক্ষেত্রেও। বুধের চেয়ে গ্রহটি সামান্য বড় হলেও সূর্যের কাছে থাকায় এ গ্রহেরও কোনো উপগ্রহ বা চাঁদ নেই। তবে অনেক বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন, একসময় শুক্র গ্রহের একটা চাঁদ ছিল। কিন্তু সূর্য তা টেনে নিয়েছে নিজের পেটে।

আরও পড়ুন

এরপর পৃথিবীর কথা ভাবো। শুক্র গ্রহের পরেই আছে পৃথিবী। আর পৃথিবীর উপগ্রহ মাত্র একটা। শুক্র গ্রহ থেকে পৃথিবী সামান্য বড়। কিন্তু সূর্য থেকে আরও দূরে থাকায় পৃথিবীর উপগ্রহটা টিকে আছে। পৃথিবীর পরে অবস্থান মঙ্গল গ্রহের। প্রায় পৃথিবীর সমান গ্রহটি। কিন্তু সূর্য থেকে আরও দূরে থাকায় এর চাঁদ দুটি। ফেবোস ও ডিমোস। তারপরে আছে গ্রহরাজ বৃহস্পতি। এর উপগ্রহ ৯৫টি। ভাবতে পারো, দুটি গ্রহের পরে একবারে ৯৫টি উপগ্রহতে চলে গেল কীভাবে? আসলে গ্রহরাজ বললাম কারণ, গ্রহদের মধ্যে সবচেয়ে বড় বৃহস্পতি। তাই এর উপগ্রহের সংখ্যাও বেশি। কারণ, এর আকর্ষণক্ষমতা যে অনেক বেশি।

কিন্তু অবাক হবে শনি গ্রহের চাঁদের সংখ্যা শুনলে। বৃহস্পতির পরে শনির অবস্থান, তবে আকারে ছোট। কিন্তু এর চাঁদ আছে ১৪৬টি। কী করে গ্রহরাজের চেয়ে এর চাঁদ বেশি হলো? কারণ, মানুষ শনির উপগ্রহগুলো আবিষ্কার করতে পেরেছে, বৃহস্পতিরগুলো এখনো স্পষ্ট করে দেখা যায়নি। কিন্তু দুটি গ্রহের উপগ্রহই আরও বাড়বে। ভবিষ্যতে এসব গ্রহে হাজারের বেশি চাঁদ দেখা যেতে পারে। একইভাবে ইউরেনাস ও নেপচুনেরও ২০-এর বেশি উপগ্রহ আছে। বেশি দূরের গ্রহ বলে ওগুলোতে তেমন খোঁজখবর নিতে পারেনি পৃথিবীবাসী। আমাদের প্রযুক্তি যত উন্নত হবে, ভবিষ্যতে এসব গ্রহে চাঁদের সংখ্যাও তত বাড়বে।

আরও পড়ুন