টেলিস্কোপের চোখে মনোমুগ্ধকর ৭ গ্যালাক্সি

বিজ্ঞানীরা প্রতিদিনই মহাবিশ্ব সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কার করছেন। মহাবিশ্বে আছে অসংখ্য গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ, ধূমকেতু এবং কৃষ্ণগহ্বর। হাবল ও জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের মতো আধুনিক যন্ত্রপাতি মহাবিশ্বের এই রহস্য উন্মোচনে বিজ্ঞানীদের সাহায্য করছে। বিভিন্ন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র এই অসাধারণ মহাজাগতিক দৃশ্যগুলোকে আমাদের সামনে তুলে ধরার জন্য নানা ধরনের ছবি প্রকাশ করে। সেখান থেকে বাছাই করা সাতটি ছবি কিশোর আলোর পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো।

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি
ছবি: নাসা

আমাদের গ্যালাক্সির নাম মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। বাংলায় যাকে বলে আকাশগঙ্গা। এই সর্পিলাকার গ্যালাক্সিটি প্রায় ১৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন বছর ধরে মহাবিশ্বে বিচরণ করছে। আকাশগঙ্গা দেখতে অনেকটা চ্যাপ্টা চাকতির মতো। এই চাকতির মধ্যে অসংখ্য নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ, ধূমকেতু, ধূলিকণাসহ আরও অনেক বস্তু ঘুরছে। এই চাকতিটি প্রায় এক লাখ আলোকবর্ষজুড়ে বিস্তৃত। আমাদের সৌরজগৎ এই চাকতির একটি বাহুতে অবস্থিত। সৌরজগৎসহ এই বাহুটি মিল্কিওয়ের কেন্দ্রকে প্রতি সেকেন্ডে ৮ লাখ ২৮ হাজার কিলোমিটার বেগে প্রদক্ষিণ করে। এই একবার প্রদক্ষিণ করতে আমাদের সৌরজগতের প্রায় ২৫০ মিলিয়ন বছর সময় লাগে।

আরও পড়ুন

মেসিয়ার ৮২

মেসিয়ার ৮২
ছবি: নাসা

মেসিয়ার ৮২ বা এম৮২ সিগার গ্যালাক্সি নামে পরিচিত। এই গ্যালাক্সিতে নক্ষত্র তৈরি হওয়ার হার অন্যান্য গ্যালাক্সির তুলনায় ১০ গুণ বেশি। এখানে নক্ষত্র বিস্ফোরণের হারও বেশি। ১৭৭৪ সালে জার্মান বিজ্ঞানী জোহান এলার্ট বোর্ড প্রথম এই গ্যালাক্সিটি আবিষ্কার করেন। পৃথিবী থেকে প্রায় ১২ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এটি। নতুন নক্ষত্রের অবিরাম জন্মের কারণে গ্যালাক্সিটি এখনো এর আকার ধারণ করছে। মেসিয়ার ৮২ এর আপাত–উজ্জ্বলতা ৮ দশমিক ৪ মাত্রা। একটি মাঝারি আকারের টেলিস্কোপ দিয়ে এপ্রিল মাসে এই গ্যালাক্সিটি স্পষ্টভাবে দেখা যায়।

ইউজিসি ১০২১৪

ইউজিসি ১০২১৪
ছবি: অস্ট্রোফোটোগ্রাফিলেন্স

ইউজিসি ১০২১৪ নামের গ্যালাক্সিটি ট্যাডপোল গ্যালাক্সি নামে পরিচিত। এই গ্যালাক্সিটি এর অদ্ভুত আকৃতির জন্য বিখ্যাত। অন্য একটি গ্যালাক্সির সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে এই গ্যালাক্সির আকৃতি বিকৃত হয়ে গেছে। পৃথিবী থেকে প্রায় ৪২০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এই গ্যালাক্সি। এর মূল অংশের কেন্দ্রে একটি বিশালাকার কৃষ্ণগহ্বর রয়েছে। এর পাশাপাশি সংঘর্ষের ফলে গ্যালাক্সির মূল অংশ থেকে একটি দীর্ঘ লেজ তৈরি হয়েছে। এই লেজ প্রায় ২ লাখ ৮০ হাজার আলোকবর্ষজুড়ে বিস্তৃত এবং এতে অসংখ্য নক্ষত্র ও গ্যাস রয়েছে। এর লেজের অংশের উজ্জ্বল নীল নক্ষত্রগুলো সংঘর্ষের ফলে খুব সাম্প্রতিককালে তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন

সোমব্রেরো গ্যালাক্সি

সোমব্রেরো গ্যালাক্সি
ছবি:মেসিয়ার অব্জেক্টস

সোমব্রেরো গ্যালাক্সি যা মেসিয়ার ১০৪ নামে পরিচিত। হাবল স্পেস টেলিস্কোপের তোলা সবচেয়ে বিস্তৃত ছবিতে দেখা যায়, এর কেন্দ্রে একটি উজ্জ্বল সাদা উজ্জ্বল কোর রয়েছে। এর চারপাশ ধূলিকণার একটি পুরু স্তরে আবৃত। বিজ্ঞানীদের মতে, এই গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল অবস্থিত। যদিও এখনো এটি নিশ্চিত করা যায়নি। তবে সব ধরনের প্রমাণই ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্বের দিকে ইঙ্গিত করে। পৃথিবী থেকে প্রায় ২৮ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এই গ্যালাক্সিটি প্রায় ৫০ হাজার আলোকবর্ষজুড়ে বিস্তৃত। এতে ৮০০ বিলিয়নের বেশি নক্ষত্র রয়েছে। মে মাসের আকাশে এটি একটি উজ্জ্বল ছায়াপথ হিসেবে দেখা যায় এবং একটি সাধারণ টেলিস্কোপ দিয়েও এটি দেখা সম্ভব। ১৭৮১ সালে ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী পিয়ের মেক্যাইন প্রথম এই গ্যালাক্সিটি আবিষ্কার করেন।

এনজিসি ৩৩১৪

এনজিসি ৩৩১৪
ছবি: নাসা

দুটি গ্যালাক্সি মিলে তৈরি হয়েছে এই জোড়া গ্যালাক্সি এনজিসি ৩৩১৪। এই জোড়া গ্যালাক্সি দক্ষিণ গোলার্ধের নক্ষত্রমণ্ডল হাইড্রার মধ্যে অবস্থিত। পৃথিবী থেকে প্রায় ১৪০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এই গ্যালাক্সির সুন্দর একটি ছবি নাসার হাবল স্পেস টেলিস্কোপের ওয়াইড ফিল্ড প্ল্যানেটারি ক্যামেরা-২–এর সাহায্যে তোলা হয়েছে। ছবিতে দুটি গ্যালাক্সি একসঙ্গে মিশে যাওয়ার মতো দেখালেও আসলে একটি গ্যালাক্সি অন্যটি থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। অর্থাৎ এনজিসি ৩৩১৪ আসলে সম্পূর্ণ আলাদা দুটি গ্যালাক্সি। একটি গ্যালাক্সি অন্যটির চেয়ে অনেক সামনে রয়েছে। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলো একে অপরের সঙ্গে ছেদ করেছে বলে মনে হয়। এই গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যে একটির কেন্দ্রে একটি পিনহুইল আকারের উজ্জ্বল নীল নক্ষত্র রয়েছে। যা এই গ্যালাক্সিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এনজিসি ৩৩১৪ গ্যালাক্সিটি প্রায় ৭০ হাজার আলোকবর্ষজুড়ে বিস্তৃত।

আরও পড়ুন

মেসিয়ার ১০৬

মেসিয়ার ১০৬
ছবি: নাসা

মেসিয়ার ১০৬, যা এনজিসি ৪২৫৮ নামেও পরিচিত। এই গ্যালাক্সিটি ক্যানেস ভেনেটিকি নক্ষত্রপুঞ্জে অবস্থিত। এই গ্যালাক্সিটির গঠন সুন্দর সর্পিলাকার। ১৭৮১ সালে ফরাসি জ্যোতির্বিদ চার্লস মেসিয়ারের সহকারী পিয়ের মেক্যাইন এই গ্যালাক্সিটি আবিষ্কার করেন। চার্লস মেসিয়ারের নামানুসারে এই গ্যালাক্সিকে মেসিয়ার ক্যাটালগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পৃথিবী থেকে প্রায় ২৪ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এই গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটি বিশালাকার কৃষ্ণগহ্বর রয়েছে। রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে এই কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে। এই গ্যালাক্সির নীল রঙের নক্ষত্রগুলো নতুন সৃষ্টি হওয়া উজ্জ্বল নক্ষত্র। অন্যদিকে লাল নক্ষত্রগুলো অনেক পুরোনো। এরা মহাবিশ্বের শুরুতেই তৈরি হয়েছিল এবং এখনো জ্বলজ্বল করছে।

এআরপি ২৭৩

এআরপি ২৭৩
ছবি: নাসা

এআরপি ২৭৩ বা ইউজিসি ১৮১০ নামে পরিচিত এই গ্যালাক্সিটি মহাকাশের সবচেয়ে সুন্দর গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি পৃথিবী থেকে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অ্যান্ড্রোমিডা নক্ষত্রমণ্ডলে অবস্থিত। এই সর্পিলাকার গ্যালাক্সি আসলে দুটি গ্যালাক্সি। একটা বড় অন্যটি ছোট। ছোটটির নাম ইউজিসি ১৮১৩। এই দুটি গ্যালাক্সির মধ্যে একটি অন্যটির চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বড়। এই দুটি গ্যালাক্সি বর্তমানে পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষের মধ্যে রয়েছে। এই সংঘর্ষের ফলে ধুলো, গ্যাস এবং নক্ষত্র মিলে একটি অনিন্দ্যসুন্দর নকশা তৈরি হয়েছে। অনেকে এই নকশাকে গোলাপ ফুলের সঙ্গেও তুলনা করে থাকেন। হাবল স্পেস টেলিস্কোপ ২০১০ সালে এই গ্যালাক্সির অত্যন্ত সুন্দর একটি ছবি তোলে।

সূত্র: নাসা, উইকিপিডিয়া, স্পেস ডটকম, হাবল সাইট ডট অর্গ

আরও পড়ুন