কেমন হবে ভবিষ্যতের বইপত্র

বই আমাদের চোখের সামনেই বদলে যেতে শুরু করেছেঅলংকরণ: এআই আর্ট

লেখাটি পড়ার পাশাপাশি শোনা যাবে নিচের ভিডিও থেকে

সৃষ্টিকর্তা মানুষের উদ্দেশে প্রথম যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, তা ছিল ‘পড়ো’। সেটা ৬১০ খ্রিষ্টাব্দ। বইয়ের জন্ম হয়েছে এরও বেশ কয়েক শ বছর পরে। আজকের জমানায় আমরা ‘পড়া’ থেকে বইকে প্রায় আলাদাই করতে পারি না। পাঠ মানেই যেন বইপাঠ। পড়ুয়া মানে বইপড়ুয়া। পাঠক মানে বইয়ের পাঠক। অথচ মানুষের পঠনের সুদীর্ঘ ইতিহাসে বইয়ের আগমন অতি সাম্প্রতিক ঘটনা।

আমরা যখন অতীতের কোনো বিদ্বান লোকের ছবি কল্পনা করি, তখন প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে আমরা বই পাঠরত চশমা চোখের গম্ভীর একটা লোকের কথা ভাবি। কিন্তু লোকটা যদি একটু পুরোনো আমলের হন? তিনি যদি, ধরা যাক, হাজার দুয়েক বছর আগের দার্শনিক অ্যারিস্টটল হন, যিনি অনেক ভারী ভারী বইপত্র লিখেছেন?

আমরা ঘরভর্তি স্তূপ করা বইপত্রের মধ্যে ডুবে থাকা অ্যারিস্টটলের ছবি চিন্তা করলে কিন্তু ভুল করব। গ্রিস দেশে সে আমলে আমরা যদি অ্যারিস্টটলের ঘরের ভেতরে উঁকি দিতে পারতাম, তাহলে এ দার্শনিকের টেবিলে (টেবিলও সে যুগে ছিল কি না, সন্দেহ আছে) বা তক্তপোশে যে জিনিসগুলো ছড়িয়ে থাকতে দেখতাম, সেগুলো মোটেই বই নয়। আমরা দেখতে পেতাম তাঁর চারপাশে কতকগুলো কাঠের বেলনে গোটানো কাপড়ের দলা। তা–ও অনেক নয়, সামান্য কয়েকটি। এগুলোকে বলে ‘স্ক্রোল’। এগুলো বইয়ের আদি রূপ। লম্বা কাপড়ের ফালিতে কালি দিয়ে হাতে লেখা গোটানো বই। সেগুলোর সঙ্গে এ যুগের বইপুস্তকের চেহারার কোনো মিল নেই। সে যুগের লাইব্রেরি মানে ছিল এ রকম বেলনের মতো স্ক্রোলের সারি, ছাতার দোকানে যেভাবে গোটানো ছাতা রাখা থাকে।

বই নামে যে কাগজের বস্তুর সঙ্গে আমরা এখন পরিচিত, সেটি নানা বিবর্তনের ভেতর দিয়ে আজকের চেহারা পেয়েছে। বইয়ের এখন যে চেহারা, হাতের তালুর চেয়ে সামান্য বড়, কম ওজনের চারকোনা ছাপানো কাগজের সজ্জা—এটা যতই চিরায়ত মনে হোক না কেন, এই চেহারা এসেছে ছাপখানা বা প্রিন্টিং প্রেস নামে একটি চৌকস, জটিল যন্ত্র আবিষ্কারের কল্যাণে। বই মানেই এখন ছাপানো বই।

ছাপখানা আসার আগে বই হাতে লেখা হতো—কখনো কাপড়ে, কখনো গাছের পাতায়, কখনো তুলোট কাগজে। আমাদের দেশে তা লেখা হতো তালপাতায়। আমরা তাকে বলতাম পুঁথি। আর এগুলো ছিল বিরল। একটা বইয়ের একটা কপি তৈরি করতেই অনেক দিন লেগে যেত। সমাজের গুটিকয় লোকের হাতে সেগুলো ঘুরত। আর হাতে গোনা কয়েকজনই মাত্র সেগুলো পড়তে পারত। কারণ, আজকের মতো চারদিকে এত পড়তে জানা মানুষ আগে কোথায় ছিল? এমনকি মোগল বাদশাহ আকবরও নাকি পড়তে পারতেন না। যদিও বিদ্যাবুদ্ধিতে তিনি কারও চেয়ে কম ছিলেন না। বিদ্যালাভ আর পড়তে পারা তখন সমার্থক ছিল না। বিদ্বান ব্যক্তিদের অনেকেই নিরক্ষর ছিলেন। ‘পড়তে পারা’ সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি কৌশল রপ্ত করা মাত্র।

কথা হলো, বই বা কিতাব বা বুক—যে নামেই আমরা ডাকি না কেন, এটা যেহেতু চেহারাসুরতে চিরকাল একরকম ছিল না, তাই অনুমান করা অমূলক নয় যে সেটির এই বদলে যাওয়ার প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যায়নি। ভবিষ্যতেও বই বদলে যাবে, যেমন করে আমাদের লেখার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে বদলে গেছে। আমরা এখন প্রায় কেউই আর কলমে লিখি না। কম্পিউটারে লিখি, কি-বোর্ড চেপে। কিছুদিন পরে সম্ভবত আর কি–বোর্ডও চাপতে হবে না। আমরা ডিকটেশন দেব। লেখা হয়ে যাবে। কিংবা আমরা শুধু সাবজেক্ট বলে দেব, কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের হয়ে লিখে দেবে।

বই আমাদের চোখের সামনেই বদলে যেতে শুরু করেছে। আমরা সেটা লক্ষ করতে পারছি। ভবিষ্যতে সেটা কী রকম চেহারা নেবে, তা কল্পনা করার চেষ্টা করা যাক।

শুরুতেই একটা জিনিস আমাদের মাথায় রাখতে হবে। কাগজের বইও একটা প্রযুক্তিমাত্রই। গাছ কেটে, তা গুঁড়া গুঁড়া করে মণ্ড বানিয়ে, তা থেকে কাগজ তৈরি করে তার মধ্যে ছাপা কালিতে যে সংকেতলিপি লেখা হয়, সেটা অ্যানালগ প্রযুক্তির শেষ দুর্গ। ডিজিটাল যুগেও তা বহাল তবিয়তে টিকে আছে, ঠিক যেমন কম্বিনেশন লকের যুগেও টিকে আছে টিপ তালা। তবে কাগজের বই হয়তো বেশি দিন টিকে থাকবে না। কিন্ডল নামের ই-বুক রিডার যন্ত্রের উত্থানের কারণে কাগজের বইয়ের সমাধি ঘটবে, এমনটা আমি মনে করি না। আমার মতে, বইয়ের প্রধান রূপান্তর ঘটবে অডিও বুক বা শ্রুতিপুস্তকের আগমনের কারণে। শ্রুতিপুস্তক বইয়ের অন্তর্গত স্বভাব বদলে দেবে। আমি এটাকে দেখি বইয়ের পূর্বজন্ম বা উৎসে ফেরা হিসেবে। কেননা আদিতে বইয়ের জন্ম হয়েছিল শ্রুতিযন্ত্র হিসেবেই।

বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করা যাক।

আজকের জমানায় আমরা দেখি বইয়ের সঙ্গে দ্বিতীয় আরেকটা জিনিস অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত—নীরবতা। গণপাঠাগার বা লাইব্রেরি কক্ষে গেলে দেখা যায়, টেবিলে কাঠের ফলকের মধ্যে লেখা—‘নীরবতা বজায় রাখুন।’ অসংখ্য পাঠক সারিবদ্ধভাবে পড়ছে। নীরবে। বইয়ের আদর্শ পাঠক বলতে আমাদের চোখে ভাসে কোনো অলস দুপুরে জানালার ধারে বিছানায় আধশোয়া এক তন্ময় কিশোরের চেহারা। সেই কিশোর হয়তো তখন কোনো জলদস্যুর জাহাজে চেপে এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সাগর পাড়ি দিয়ে চলেছে বা কোনো যুদ্ধের ময়দানে অজস্র হ্রেষাধ্বনি আর ঢাল-তলোয়ারের তুমুল ঝনঝনের মধ্যে দিগ্‌বিদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। কিন্তু বাইরে থেকে তা বোঝার কোনো উপায় নেই। বাইরে তা চারপাশে এক ঝিঁঝিডাকা স্তব্ধতা।

সেন্ট অগাস্টিনের বর্ণনা পড়লে মনে হবে পাদরি অ্যামব্রোস যেন ধ্যানবলে বিশেষ কোনো ক্ষমতা আয়ত্ত করেছেন। হ্যাঁ, নিঃশব্দে বই পড়া একটা বিশেষ জাদুকরি ক্ষমতাই বটে, যা আমাদের অর্জন করতে হয়েছে।

আমরা নীরবে বই পড়ি। কারণ, আমরা নীরবে বই পড়তে শিখেছি। আর এটা ঘটেছে বেশি দিন হয়নি। অতীতকালে আমরা নীরবে পড়তে পারতাম না। আমাদের শব্দ করে বই পড়তে হতো। কারণ, বইয়ের জন্মই হয়েছিল একত্রে জমায়েত হয়ে, সমবেতভাবে পাঠ করার জন্য। বইপাঠ আদিতে ছিল একটি কমিউনিটি কর্ম বা সম্প্রদায়ের যৌথ কাজ। একজন পড়বে, বাকিরা শুনবে। বই যেন গানের ক্যাসেট বা সিডি বা লং প্লে, যার মধ্যে সংকেতের আকারে আওয়াজ বা শব্দ জমিয়ে রাখা হয়েছে। কেউ তা পাঠ করা মানে তার কণ্ঠের ভেতর দিয়ে সেসব নীরব শব্দের সরব হয়ে বেরিয়ে আসা।

নিঃশব্দ বইপাঠ মানুষ কবে থেকে শিখেছে? হিসাব কষে বলা মুশকিল। চতুর্থ শতকে ইউরোপের বিখ্যাত দার্শনিক সেন্ট অগাস্টিনের লেখায় প্রথম এ জিনিসের উল্লেখ দেখা যায়। কনফেশনস নামে তাঁর আত্মজীবনীর এক জায়গায় তিনি এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। অগাস্টিন পাদরি ছিলেন। ইতালির মিলানে থাকার সময় চার্চের আরেক বয়োজ্যেষ্ঠ পাদরি সেন্ট অ্যামব্রোসের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। এই অ্যামব্রোসের এক ‘বিস্ময়কর’ ক্ষমতা ছিল। তিনি ‘শব্দ না করে’ বই পড়তে পারতেন। কনফেশনস-এ অগাস্টিন লিখেছেন: ‘উনি যখন পড়তেন, তাঁর দৃষ্টি বইয়ের পাতার ওপর দিয়ে গড়িয়ে যেত, আর তাঁর হৃদয় সেগুলোর অর্থ বুঝতে পারত। অথচ তাঁর কণ্ঠ তখন নীরব, জিব নড়ছে না। যে কেউ অনায়াসে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারত, অতিথিদের আগমন ঘোষণা করা হতো না এবং এ কারণে আমরা যখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম, আমরা তাঁকে এ রকম নিঃশব্দে পাঠে নিমগ্ন দেখতাম। তিনি শব্দ না করে পড়তে পারতেন।’

সেন্ট অগাস্টিনের বর্ণনা পড়লে মনে হবে পাদরি অ্যামব্রোস যেন ধ্যানবলে বিশেষ কোনো ক্ষমতা আয়ত্ত করেছেন। হ্যাঁ, নিঃশব্দে বই পড়া একটা বিশেষ জাদুকরি ক্ষমতাই বটে, যা আমাদের অর্জন করতে হয়েছে। আর তা করতে গিয়ে আমরা বই জিনিসটাকেই বদলে ফেলেছি। বই ক্রমেই তার ধ্বনিময়তা হারিয়ে নীরব, স্তব্ধ ছবিসুলভতার দিকে যাত্রা করেছে। আমি মনে করি, সশব্দ থেকে নিঃশব্দ হয়ে পড়াই হলো বইয়ের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি। এ কারণে বইয়ের অন্তর্গত রূপের বদল ঘটেছে। বইয়ের অধ্যায়বিন্যাস, বাক্যের গঠন এবং শব্দচয়ন নিঃশব্দ পাঠের উপযোগী হয়ে গড়ে উঠেছে। আমরা এখন কালেভদ্রে মার্কেসের শতবর্ষের নিঃসঙ্গতার মতো গ্রন্থ পাই, যার প্রথম বাক্যটি আমাদের সশব্দ পড়ে উঠতে প্রলুব্ধ করে।

আজকের ডিজিটাল যুগে অডিওবুকের প্রচলন বইয়ের এই ধ্বনিমূলক চরিত্রটিকে ফিরিয়ে আনার সুযোগ এনে দিয়েছে। অতি সম্প্রতি সংগীতের সবচেয়ে বড় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘স্পটিফাই’ গানের পাশাপাশি অডিওবুক প্রকাশ করতে শুরু করেছে। তুমি গানের মতো করে এখন বই শুনতে পারবে। গানের রয়্যালটি যেভাবে হিসাব করা হয়, স্পটিফাই সেভাবে অডিওবুকের লেখককে রয়্যালটি বুঝিয়ে দেবে। অর্থাৎ কতজন শ্রোতা কতবার, কতক্ষণ ট্র্যাকটি শুনেছেন, তার ওপর ভিত্তি করে লেখক পয়সা পাবেন।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, ডিজিটাল যুগে বই যেসব ‘অবতার’ লাভ করবে, সেগুলোর একটি হতে যাচ্ছে অডিও ট্র্যাক। এটি পুরোপুরি অডিওবুক নয়। একটু ভিন্ন রকম। এখানে লেখকের সম্মানী যেহেতু আসবে কোন শ্রোতা কতক্ষণ এটি শুনেছেন তার ওপর ভিত্তি করে, কাজেই লেখকের সব মনোযোগ ও কৌশল নিবদ্ধ হবে তাঁর লেখায় শ্রুতিময়তা বা ধ্বনিময়তা তৈরির দিকে। লেখক তাঁর লেখাকে সেভাবেই ঢেলে সাজাবেন। অধ্যায়গুলোও শ্রোতার কানের কথা মাথায় রেখে বিন্যস্ত হবে। এভাবে সাত শ কি আট শ বছর ধরে বই যে পথে বিবর্তিত হয়েছে, সেই পথ বেয়ে এবার হয়তো তার উজানযাত্রা শুরু হবে।

সেটি বইয়ের জন্য কোনো দুঃসংবাদ হবে না। অন্তত আমার মতে।

আরও পড়ুন