কিশোর মুক্তিযোদ্ধার দুঃসাহসী গল্প
নাম তার নুর মোহাম্মদ। বয়স ১২ কি ১৩ বছর। সবাই তাকে নুরু নাপিত বলে ডাকে। যদিও সে নাপিত নয়। তার বাবা নাপিত ছিলেন। কখনো সে বাবার সঙ্গে হাটে বসে লোকজনের চুল-দাড়ি কেটে দিত। সেই থেকে তার নাম হয়েছে নুরু নাপিত। আমার সঙ্গে তার পরিচয় হয় ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর শেষ বিকেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ডিফেন্স পজিশন পীরগঞ্জে। পীরগঞ্জ-রংপুর-বগুড়া মহাসড়কের ওপরে তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্ত ডিফেন্স। পীরগঞ্জ দখল করতে পারলে রংপুর-বগুড়া তথা দৌলতদিয়া ঘাট পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাদের সব ধরনের যোগাযোগ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাবে। এই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখলের জন্য ২০ মাউন্টেন ডিভিশনের ৬৬ ব্রিগেডের কমান্ডার, ব্রিগেডিয়ার শর্মার পরিকল্পনা ছিল নিম্নরূপ:
২/৫ গুর্খা রেজিমেন্ট পীরগঞ্জ আক্রমণ করবে।
ষষ্ঠ গার্ড রেজিমেন্ট ফলোআপ ব্যাটালিয়ন হবে।
এক স্কোয়াড্রন পিটি—৭৬ ট্যাংক আক্রমণে প্রত্যক্ষ সাহাঘ্য করবে।
মুক্তিবাহিনী আক্রমণে অংশ নেবে এবং জনসংযোগ রক্ষা করবে।
২/৫ গুর্খা রেজিমেন্ট ট্যাংকসহ পীরগঞ্জ আক্রমণ করল, কিছুক্ষণ লড়াইয়ের পর পাকিস্তানি হানাদাররা পশ্চাদপসরণ করল। তারপর আবার পজিশন নিল। এবার আক্রমণের পালা ষষ্ঠ গার্ড রেজিমেন্টের। ইতিমধ্যে আলো-আঁধারিতে গোটা এলাকা ছেয়ে গেছে। ২/৫ গুর্খা রেজিমেন্ট যখন দখলকৃত জায়গায় রি-অর্গানাইজ করতে ব্যস্ত, তখন ষষ্ঠ গার্ড রেজিমেন্ট শত্রুর পেছন অবস্থানে আক্রমণ করতে অগ্রসর হলো। রাস্তার দুই পাশ দিয়ে ব্যাটালিয়নের সেনারা চলছে, মাঝখান দিয়ে চলছে সাঁজোয়া বহর। মিনিট পাঁচেক চলার পরই শত্রুর পজিশন থেকে ঠা ঠা শব্দে ভারী মেশিনগানের আওয়াজ এল। বোঝা গেল, শত্রু এখন পীরগঞ্জ টাউনের ভেতরে শক্ত ডিফেন্স পজিশনে আছে। শত্রু তাদের গুলিবর্ষণ এতই বাড়িয়ে দিল যে আমরা আর সামনে অগ্রসর হতে পারছি না। আমি আর কর্নেল দত্ত একটা বাঁশঝাড়ের নিচে আশ্রয় নিলাম। আমাদের সঙ্গে ট্যাংক বাহিনীর কমান্ডার ও অন্য অফিসাররাও এসে দাঁড়াল। সবাই মিলে একমত হলো যে শত্রুর ডিফেন্সে দুই দিক থেকে ট্যাংক দিয়ে আক্রমণ করা হবে। যেই কথা সেই কাজ। দুই দিক থেকে গড় গড় করে ট্যাংক রওনা হলো। রাস্তার মাঝখানে আমি ও কর্নেল দত্ত ট্যাংকের ওপরে চড়ে রওনা দিলাম। প্রায় ৩০ মাইল স্পিডে মুহুমুর্হু গোলাবর্ষণ করতে করতে ট্যাংকগুলো শত্রুর অবস্থান লক্ষ করে ছুটে চলল। ভয়াবহ এই ট্যাংক আক্রমণের মুখে শত্রু দিশেহারা হয়ে ডিফেন্স থেকে পালিয়ে গেল। ফেলে গেল প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ।
আমরা যখন সেখানে পৌঁছালাম তখন শহরে কোনো লোক নেই, দোকানপাট সব বন্ধ, খাঁ খাঁ করছে চারদিক। দু-এক জায়গায় আগুন জ্বলছে। শুধু সৈনিকদের বুটের শব্দ, ওয়্যারলেসের কথোপকথন ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। এমনকি গাছের ডালে পাখি অথবা কাকও নেই। দু-চারটা দোকানের দরজা ভেঙে সার্চ করা শুরু হলো। একটা দোকানের আসবাবের পেছনে মনে হলো কেউ যেন লুকিয়ে আছে। পরিষ্কার বাংলায় বললাম,
: কে ওখানে, চুপচাপ বেরিয়ে এসো, না হলে গুলি করা হবে।
: ‘স্যার মুই, মোক গুলি না করো’ বলতে বলতে ১২-১৩ বছরের একটি ছেলে বেরিয়ে এল।
: এই তোর নাম কী?
: ‘নুরু স্যার’, কাঁদো কাঁদো স্বরে সে বলল।
: এই ব্যাটা, তুই এখানে কী করস।
: ‘স্যার মুই নাপিত, মানষের চুল-দাড়ি কাটি। কালকা পীরগঞ্জের হাট ছিল, চুল কাটবার আইনু, আতে এলাই দোকানে শুয়া ছিনু।’
নুরু নাপিতকে নিয়ে কর্নেল দত্তের কাছে এলাম। সবকিছু উনি শুনে বললেন, ওকে কাছে রেখে দাও, ওর কাছ থেকে শুনে নাও পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান আর কোথায় কোথায় আছে, দরকার হলে ওকে পাঠিয়ে দাও খবর সংগ্রহ করতে। গোধূলির আবছা আলোতে আমি নুরুকে পর্যবেক্ষণ করলাম। ১২-১৩ বছরের বাচ্চা ছেলে, কয়লাকালো গায়ের রং, ছিপছিপে শরীর, দেখে মনে হয় চালাকচতুর, ভারতীয় সেনাদের দেখে ও প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিল, এখন আমাকে দেখে একটু ভরসা পেয়েছে। ইতিমধ্যে আমি নুরুকে আমাদের উদ্দেশ্য বুঝিয়ে বললাম, সে ঘাড় নেড়ে বুঝিয়ে দিল সে সবকিছু বুঝতে পেরেছে। পাকিস্তান আর্মির খবর জানতে চাইলে সে জানাল, পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা এ জায়গাতেই ছিল। এখানে যে আক্রমণ হবে, তা তারা বুঝতে পারেনি। যখন ট্যাংকের আক্রমণ হলো, তখন তারা সবাই পালিয়ে যায়। কোথায় পালিয়ে গেছে তা সে বলতে পারবে না, তবে তাকে যেতে দিলে সে গ্রামের মধ্যে গিয়ে লোকজনের কাছ থেকে সংবাদ আনতে পারবে। সে আরও বলল, ‘স্যার, আমি পালামু না, খোদার কসম লাগে, দ্যাশের জন্য এ কাজ করতে পারুম ইনশা আল্লাহ। মোর ওপর বিশ্বাস রাখেন।’
আমি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার পারভেজকে আরও দু-চারজন মুক্তিসেনাকে নিয়ে নুরুর সঙ্গে যাওয়ার জন্য বললাম। পুরো ইউনিট লোকাল ডিফেন্স নিতে পরিখা খুঁড়তে ব্যস্ত। এমন সময় কর্নেল দত্ত আমাকে জানালেন যে রাত ১২টার মধ্যে যেন কোম্পানি নিয়ে প্রস্তুত থাকি, কারণ আবার অগ্রাভিযান শুরু হবে। শত্রুকে রানিং ব্যাটলে রাখতে হবে, ওদের সময় দিলেই ওরা শক্ত ডিফেন্স নেবে। আমি কোম্পানিকে আমার আদেশ শুনিয়ে দিলাম। ইতিমধ্যে নুরু ফিরে এল, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে আরও তিনজন উৎসাহী ছেলেকে। তারা আমাকে পেয়ে খুব খুশি, কারণ আমি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। সবাই একসঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল। বর্তমানে পাকিস্তানি আর্মি কোথায় আছে তা তারা জানে। তাদের সবার কথার সারাংশ হলো—
১. পুরো গাইবান্ধা মহকুমা সাদুল্যাপুর এবং পলাশবাড়ীতে রয়েছে ৩২ বালুচ রেজিমেন্ট। এই রেজিমেন্টের অধিনায়কের নাম লে. কর্নেল সুলতান মাহমুদ। সে একজন বাঙালিবিদ্বেষী এবং অত্যাচারী অফিসার। বহু বাঙালিকে সে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।
২. গোবিন্দগঞ্জ করতোয়া নদীর পাড়ে এবং গোবিন্দগঞ্জ ব্রিজের ওপর পাকিস্তানি বাহিনী ডিফেন্স পজিশনে আছে।
ছেলেরা কিছুতেই আমাকে ছাড়বে না। তাদের বাড়িতে যেতেই হবে রাতের খাবারের জন্য। এই একটু দূরেই তাদের বাড়ি। আমি যত বলি আমার পক্ষে এখন যাওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা। ইতিমধ্যে ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার শর্মা এসে হাজির। তিনি সব শুনে আমাকে বললেন, গো অ্যাহেড ইয়াং ম্যান, দিস ইজ পিপলস ওয়ার, গো উইথ দেম অ্যান্ড গ্যাদার ইনফরমেশন।
: ওকে, স্যার।
আমি আরও চারজনকে নিয়ে রওনা দিলাম, ১০ মিনিটের মধ্যে আমরা গ্রামে পৌঁছে গেলাম। আমাদের দেখে লোকজনের ঢল নামল। নুরু হাত-পা নাড়িয়ে বক্তৃতা দিয়ে চলছে। মনে হলো যুদ্ধের সেনাপতি সে নিজেই। কেমন করে ট্যাংক এল, কেমন করে ফায়ার করল, পাকিস্তানি সেনা কীভাবে পালিয়ে গেল—এগুলো সে অভিনয় করে দেখাতে লাগল। লোকজনকে আসন্ন স্বাধীনতা সম্বন্ধে বললাম। তারা খুব খুশি হলো, অনেকেই দোয়া-দরুদ পড়তে লাগল। ওদের হাজার রকমের গল্প শুনলাম। গ্রামের কে কে রাজাকার হয়েছে এবং তারা কীভাবে অত্যাচার করেছে এসব। ইতিমধ্যে আমরা গরম ভাত আর মুরগির ঝোল দিয়ে খাওয়া শেষ করলাম। নুরুকে কোথাও দেখতে পেলাম না। মনে মনে ভাবলাম, কী ব্যাপার, পালিয়ে গেল নাকি? দু-একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই বলল, এই তো এখানে ছিল, গেল কোথায়? খুঁজে দেখি।
একজন চিৎকার করে ডাকতে লাগল, ‘এই ব্যাটা ন্যাপতার পোলা গেলি কুটি। এ্যালা দিনের গতিক ভালো নয়, হারামজাদা কোন ক্যানচিত গেছে।’ ডাকাডাকির একটু পরই হন্তদন্ত হয়ে নুরু এল, সঙ্গে আরও একজন ছেলে। ছেলেটির মাথায় টুপি এবং সঙ্গে একটি সাইকেল। নুরু বলল, স্যার এর নাম বারেক আলী, এই পাড়ার ছেলে, এইমাত্র সে পলাশবাড়ী থেকে এসেছে, ওর কাছে অনেক খবর আছে। আমি বারেককে বললাম, কী ভাই, পলাশবাড়ীতে কী দেখলে?
: স্যার, ওখানে গাইবান্ধা থেকে অনেক সৈন্য এসেছে, কর্নেল সুলতান সাহেবের গাড়িও দেখলাম, লোকজন বলাবলি করছে ওরা নাকি আজ লড়াই করবে।
তাড়াতাড়ি ফিরে এসে সংবাদটুকু ব্রিগেডিয়ার শর্মা ও কর্নেল দত্তকে জানালাম। সংবাদ বিশ্লেষণ করে সবাই একমত হলো যে আজ রাতে নিশ্চয় ৩২ বালুচ পীরগঞ্জের ওপর পাল্টা আক্রমণ করবে। সুতরাং তাদের আক্রমণের আগে আমাদের আক্রমণ করতে হবে। ব্রিগেড প্ল্যান অনুযায়ী ২/৫ গুর্খা রেজিমেন্ট পলাশবাড়ীর উদ্দেশে অগ্রাভিযান করবে এবং ২০ এমএলআর ফলোআপ ব্যাটালিয়ন হিসেবে থাকবে। মুক্তিবাহিনী আক্রমণে অংশগ্রহণ করবে এবং পলাশবাড়ী পর্যন্ত গাইড করে নিয়ে যাবে। ব্রিগেড অ্যাডভান্স ব্যাটালিয়নের পয়েন্ট প্লাটুনের পয়েন্ট সেকশনের সবার আগে মুক্তিবাহিনীকে দেওয়া হলো। কিন্তু সবার আগে নুরু থাকবে গাইড হিসেবে। কেননা, এই এলাকা নুরুর পরিচিত। নুরুকে ভালোভাবে ব্রিফ করা হলো কী কী তাকে করতে হবে। নুরু সবার আগে থেকে প্রতিটি গ্রামে আগে ঢুকবে। সব দেখেশুনে এসে গুর্খা ব্যাটালিয়নের পয়েন্ট সেকশনের স্কাউটকে জানাবে যে সামনের এলাকা শত্রুমুক্ত আছে। তার কাছ থেকে সবুজসংকেত পাওয়ার পর ব্যাটালিয়ন সামনের দিকে অগ্রসর হবে। বিরাট গুরুদায়িত্ব নুরুর কাঁধে। কিশোর নুরু হাসিমুখে রাজি হলো দেশের জন্য নিজ প্রাণ বাজি রাখা এই গুরুদায়িত্বে। রাত ১০টার সময় যাত্রা শুরু হলো। এখন যে অংশটুকু লিখব সেটা নুরুর মুখ থেকে শোনা, যা পরের দিন ভোরে নুরু আমাকে বলেছিল।
শীতের রাত। শিশিরভেজা মাঠ। কুয়াশার চাদরে কিছু কিছু স্থান ঢাকা। যেখানে এক হাত দূরেও কিছু দেখা যায় না। এই রাস্তা ধরে নুরু বহুবার গিয়েছে। এখানকার প্রতিটি গ্রাম তার চেনা। প্রতিটি গ্রামের হাটেই সে তার বাবার সঙ্গে গিয়েছে এবং চুল কেটেছে। নুরু প্রথমে গ্রামে ঢুকল, সব দেখেশুনে এসে জানাল সামনে সবকিছু ঠিক আছে, এখন যাওয়া যাবে। এভাবেই গাইড করে নিয়ে চলল নুরু পুরো অ্যাডভান্স গ্রুপকে। ঘণ্টা খানেক চলার পর হঠাৎ নুরুর খেয়াল হলো সামনের গ্রামে কুকুরগুলো খুব বেশি চিৎকার করছে। নুরু দাঁড়িয়ে পড়ল। গ্রামবাংলার ছেলে সে। কুকুরের ডাকের বিশ্লেষণ সে ভালো জানে। গ্রামের কুকুর ভিন্ন ভিন্ন ডাক ডাকে। যেমন যদি শেয়াল দেখে তবে রাতে শেয়াল ডাকবে ঘেউ ঘেউ করে দুবার, তারপর কুই কুই করে দৌড় দেবে শেয়ালের দিকে, গ্রামের অন্য কুকুরগুলো তার ডাক শুনে সেদিকে ছুটে আসবে এবং তখন গ্রামের ভেতরে সড়সড় শব্দ হবে। যদি গভীর রাতে নিজ গ্রামের লোক যায় তবে সে ঘেউ করে একবার ডাকবে, কারণ সে নিজ গ্রামের প্রতিটি লোকের শরীরের গন্ধ জানে। যেহেতু লোকটা এই গ্রামের, তাই স্বভাব অনুযায়ী সে-ও বলবে, এই চোপ চোপ বলে চলে যাবে। কুকুরও বুঝবে এটা নিজ গ্রামের লোক। যদি ভিন গ্রামের কোনো লোক অথবা চোর আসে তবে কুকুরের ডাক হবে ভিন্ন রকম। কুকুর ডেকে উঠবে এক-দুবার, কুকুরের ডাক শুনে লোক অথবা চোরটি কুকুরটিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। কুকুরটিও অপরিচিত লোকের গায়ের গন্ধ পেয়ে এবং লোকটির ব্যবহারে বুঝতে পারবে, এ লোক নিজ গ্রামের লোক নয়। আর তখনই ডাকের সুর উচ্চগ্রামে তুলবে এবং ঘনঘন ডাকবে। এই ডাক শুনে গ্রামের অন্য কুকুরগুলো তার সঙ্গে সমস্বরে ডাকতে থাকবে এবং নিজ গ্রামের লোকদের ঘুম থেকে জাগিয়ে দেবে। আজকের পরিস্থিতি কিছুটা এ রকমের। নুরু দাঁড়িয়ে পড়ল। বুঝতে চেষ্টা করল ব্যাপারটা কী? কুকুরগুলো একযোগে চিৎকার করছে কেন, তার মানে গ্রামে অচেনা-অজানা লোকের আনাগোনা হয়েছে। হঠাৎ নুরুর খেয়াল হলো সন্ধ্যার সময় শুনেছিল পাকিস্তানি সেনারা পীরগঞ্জ আক্রমণ করবে, ওরা নয় তো? ভালো করে পরখ করার জন্য খুব সাবধানে একটু সামনে এগিয়ে গেল এবং দেখল আবছা ছায়ার মতো কিছু লোকের চলাচল। সে বুঝতে পারল ওরা পাকিস্তানি সেনা ছাড়া আর কেউ নয়। দম বন্ধ করে এক দৌড়ে পিছিয়ে এসে সে পয়েন্ট সেকশনে খবর দিল। সঙ্গে সঙ্গে খবর ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে শত্রুর আগমনের খবর সবখানে পৌঁছে গেল। ত্বরিত গতিতে পুরো ব্যাটালিয়ন আসন্ন যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত হয়ে পজিশনে চলে গেল। ১০ মিনিটের মধ্যেই শত্রুর ছায়া দেখা গেল রাস্তার ওপর। রাতের নিস্তব্ধতা ছিন্ন করে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে একসঙ্গে ২/৫ গুর্খা রেজিমেন্টর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো গর্জে উঠল। মরণচিৎকার করে অনেক পাকিস্তানি সেনা রাস্তার ওপর পড়ে গেল। বাকিরা ত্বরিত পজিশন নিয়ে পাল্টা ফায়ার করতে লাগল। শুরু হলো মধ্যরাতে ভয়ানক লড়াই। দুই পক্ষেই গুলি চলছে পুরোদমে। ঘণ্টা দুয়েক প্রচণ্ড গোলাগুলির পর ধীরে ধীরে পাকিস্তানি বাহিনীর তরফ থেকে ফায়ারের গতি কমে এল। মাঝে মাঝে দু-একটা জিথ্রি রাইফেলের টাক, ডুম শব্দ ভেসে এল। শেষ রাতের দিকে পাকিস্তানি বাহিনী রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে গেল। ভোরের প্রথম আলো ফুটতেই দেখা গেল রাস্তায় বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনার মৃতদেহ। প্রথম যে মৃতদেহ পড়ে ছিল সেটা হলো ৩২ বালুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক লে. কর্নেল সুলতান মাহমুদের। এভাবেই মৃত্যুবরণ করল একজন অত্যাচারী পাকিস্তানি নায়ক। সবাই নুরুকে ধন্যবাদ দিল। ওর জন্যই এবং ওর উপস্থিত বুদ্ধির জন্য আজ মিত্রবাহিনীর এত বড় সাফল্য। আমাদের আবার এগিয়ে যাওয়ার পালা এল।
পিটি-৭৬ ট্যাংকে বসে চললাম সম্মুখে, আমার পাশে বসা কিশোর মুক্তিযোদ্ধা নুরু মিয়া।
১০ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। চারদিকে প্রকম্পিত করে পাকিস্তানি আর্মি গোবিন্দগঞ্জ ব্রিজটা উড়িয়ে দিল। ব্রিজটা ভেঙে যাওয়ায় পুরো ব্রিগেডের অ্যাডভান্স টিম বগুড়ায় পুরোপুরি থেমে গেল। এদিকে পাকিস্তানি আর্মি করতোয়া নদীর ওপারে শক্ত ডিফেন্স নিয়ে বসে রইল। আমরা যখন ব্রিজটার কাছে পৌঁছালাম তখন ব্রিজের ধ্বংসপ্রাপ্ত অংশ থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশে উঠছে। আমাদের দেখেই পাকিস্তানি সেনারা ফায়ার শুরু করল। চাই চুই করে গুলি আমাদের মাথার ওপর দিয়ে গাছপালার পাতা ঝরিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। বোঝা গেল, শক্ত ডিফেন্স নিয়েছে শত্রু। এখন সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্য একটাই অ্যাকশন প্রয়োজন, মিলিটারি পরিভাষায় যাকে বলে, ‘অ্যাসল্ট রিভার ক্রসিং’।
কিন্তু তার জন্য সময় ও নিপুণ পরিকল্পনা দরকার। ব্রিগেড কমান্ড পোস্টে তখন সব উচ্চপদস্থ অফিসার মিটিংয়ে বসে আসন্ন অপারেশন নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। হঠাৎ করে আমার ডাক পড়ল সেখানে। ব্রিগেডিয়ার শর্মা আমাকে বোঝালেন যে ব্রিজের ওপারে পাকিস্তানি ডিফেন্সের ওপর সম্মুখ আক্রমণ সম্ভব নয়, সুতরাং বিকল্প কোনো পথ বেছে নিতে হবে। এর মানে অন্য কোনো ঘুরপথে গিয়ে আক্রমণ করতে হবে। অন্য কোনো পথ আছে কি না, এটা জানা দরকার। এর জন্য গ্রামের লোকের সাহাঘ্যের প্রয়োজন। ওদের কাছ থেকে জানতে হবে অন্য কোনো পথ আছে কি না? আমি বললাম, স্যার, আমরা নুরুর সাহাঘ্য নিতে পারি। আপনি জানেন সে আগে একবার আমাদের সাহাঘ্য করেছে স্যার।
: ওয়েল, ওয়েল, দ্যাটস এ গুড আইডিয়া। কল হিম।
নুরু এসে হাজির হলো, তাকে সব বুঝিয়ে বলতেই সে বলল, ‘স্যার, হামাক একটু সময় দেন, হামি গায়োত থেকে ঘুরা জানা আসি।’
: ঠিক আছে যাও, কিন্তু বেশি সময় পাবে না, তাড়াতাড়ি জেনে এসো।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাংলার জনগণের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা। পাকিস্তানিদের প্রতি জনগণের কোনো সহযোগিতা ছিল না। যার ফলে তাদের চলাচল, তাদের অবস্থান এবং তাদের সব খবরাখবর জনগণের মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছে যেত খুব সহজেই। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই নুরু মিয়া ফিরে এল, সঙ্গে আরও দুজন উৎসাহী যুবক। তারা জানাল যে গোবিন্দগঞ্জ বাঁয়ে রেখে পাঁচ-সাত মাইল যাওয়ার পর কাজলা নামক গ্রামে একটা ফেরি আছে। নাম কাজলা ফেরিঘাট। ফেরি পার হয়ে তিন-চার মাইল ডান দিকে এলেই একেবারে ব্রিজের পেছনের গ্রামে ওঠা যাবে। এই সংবাদ পাওয়ার পর মিত্রবাহিনী অফিসাররা খুশিতে লাফিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ম্যাপ খুলে বের করে দেখল কোথায় কাজলা ফেরিঘাট। তাড়াহুড়া পড়ে গেল কমান্ড পোস্টে। আমার ওপর আদেশ এল ফেরিঘাট পাহারা দেওয়ার জন্য এই মুহূর্তে একদল মুক্তিসেনা পাঠিয়ে দিতে। মেজর জেনারেল লসমন সিংয়ের লেখা দি ইন্ডিয়ান সোর্ড স্ট্রাইক ইন ইস্ট পাকিস্তান বইয়ে নুরুর বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। নুরু ২০ জন মুক্তিসেনা নিয়ে চলে গেল কাজলা ফেরিঘাটের উদ্দেশে। প্রায় চার ঘণ্টা পর রাতের আঁধারে গুর্খা রেজিমেন্ট ও আমরা মুক্তিসেনারা রওনা হয়ে গেলাম কাজলা ঘাটের দিকে। আমরা যখন ফেরিঘাটে পৌঁছালাম, তখন রাতের দুই প্রহর। ফেরিঘাট পার হয়ে আক্রমণ করা হলো পেছন থেকে পাকিস্তানি পজিশনে। রাতভর লড়াই চলল, অবশেষে ভোর রাতে শত্রু পশ্চাদপসরণ করল। আর ফেলে গেল প্রচুর গোলাবারুদ, অস্ত্র, এমনকি একটা ট্যাংক। মিত্রবাহিনী ও আমাদের জন্য এটা অসাধারণ সাফল্য, একটি অভূতপূর্ব জয় এবং এর সবই সম্ভব হয়েছিল নুরু মিয়ার সংগ্রহ করা খবরের জন্য। আজ নুরু কোথায় আছে জানি না। যুদ্ধের পর দুবার খোঁজ নিয়েছিলাম, কিন্তু কেউ বলতে পারে না তার কথা। তাই আজ এই লেখার মাধ্যমে আমি তোমাদের জানিয়ে গেলাম কিশোর মুক্তিযোদ্ধা নুরুর কথা।