ইউএফও–রহস্য

নভেম্বর, ২০০৪। যুক্তরাষ্ট্রের স্যান ডিয়েগোর তীরবর্তী এলাকা।

একটি নেভি ক্যারিয়ারের বৈমানিকেরা দেখতে পেলেন, অদ্ভুত এক উড়োযান ছুটছে প্রচণ্ড বেগে। রাতের বেলা। উপকূল এলাকা, তাই বাতাস দিচ্ছে বেশ। বাতাসের গতিবেগ ১২০ নটের মতো। অথচ অদ্ভুত উড়োযানটি ছুটছে বাতাসের বিপরীতে। বৈমানিকেরা যানটির পিছু নেওয়ার চেষ্টায় ছুটলেন প্রাণপণে। কিন্তু ধরতে পারলেন না।

ঘাঁটিতে ফিরে তাঁরা এ ঘটনার কথা কর্তৃপক্ষকে জানালেন। প্রমাণ হিসেবে দেখালেন ইনফ্রারেড বা অবলাল তরঙ্গের ক্যামেরায় তোলা অদ্ভুত দেখতে ছুটন্ত উড়োযানের ফুটেজ। সেই উড়োযানের নাম তাঁরা দিলেন ফ্লার ১ (Flir1)।

এ রকম ঘটনা একবার নয়, অন্তত তিনবার ঘটেছে। পরের ঘটনা দুটো ২০১৫ সালের ১৫ জুনের। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার উপকূলের এ ঘটনা দুটির ছবি তোলেন থিওডোর রুজভেল্ট নামের একটি নেভি ক্যারিয়ারের বৈমানিকেরা। উড়ন্ত যান দুটোর নাম দেওয়া হয় ‘গিম্বল’ (Gimbal) এবং ‘গো ফাস্ট’ (Go Fast)।

২০০৪ সালের ফ্লার ১–এর ছবি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে, ঘটনার তিন বছর পর। পরে, ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস এটা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ঘটনাগুলোর কথা। মিডিয়ায় ঝড় ওঠে—ইউএফও বাস্তব!

বাধ্য হয়ে ২০২০ সালে মার্কিন সামরিক দপ্তর-পেন্টাগন আনুষ্ঠানিকভাবে ভিডিওগুলো উন্মুক্ত করে দেয়। এখন এই ভিডিওগুলো ইউটিউবেও আছে। কিন্তু বিষয়টা কী দাঁড়াল তাহলে? ইউএফও কি আসলেই আছে? জিনিসগুলো আসলে কী?

দুই

এই লেখা পড়ার আগেও তোমরা নিশ্চয়ই ইউএফওর কথা অনেক শুনেছ। গোল গোল উড়ন্ত চাকতি। এলিয়েনরা এসব উড়োযানে করে ছুটে বেড়ায়, ইত্যাদি।

আসলে ‘ইউএফও’-এর পূর্ণাঙ্গ রূপ ‘আনআইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবজেক্টস’। বাংলা করলে দাঁড়ায়, শনাক্ত করা যায় না, এমন উড়ন্ত বস্তু। অর্থাৎ ইংরেজি ‘ইউএফও’ কথাটির সঙ্গে এলিয়েনদের সম্পর্ক নেই। এই কথাটি দিয়ে শুধু বোঝানো হয়, এসব উড়োযানের ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু আমরা জানি না। তুমি নিশ্চয়ই এখন পাল্টা প্রশ্ন করবে, আমরা যদি না-ই জানি, তাহলে এর ভেতরে তো এলিয়েন থাকতেই পারে, নাকি? আসো, আমরা বিষয়টা বিজ্ঞানের চোখে একটু খতিয়ে দেখি।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ইউএফও দেখার দাবি অনেক পুরোনো। প্রাচীন মিসর ও রোমের লিখিত ইতিহাসে এ রকম দাবি দেখা যায়। সে সময় থেকে আজ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ইউএফও দেখার কথা বলে আসছেন অনেকেই। বিষয়টাকে তাই একদম ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় ছিল না। সে জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের সরকার এ নিয়ে তদন্ত করেছে।

১৯৫২ সালে মার্কিন বিমানবাহিনী একটি প্রজেক্ট হাতে নেয়, প্রজেক্ট ব্লু বুক। উদ্দেশ্য, ইউএফও দেখার বিষয়টা আসলে কী, তা খতিয়ে দেখা। এত বড় পরিসরে ইউএফও নিয়ে কাজ খুব কমই হয়েছে। মোট ১২ হাজার ৬১৮টি ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখেন এ প্রজেক্টের বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদেরা। বেশির ভাগ ঘটনাকেই তাঁরা প্রাকৃতিক বিভিন্ন ঘটনাকে ভুলভাবে দেখা, বিমান ও বেলুনের মতো কৃত্রিম কিছু নিয়ে চোখের ধাঁধা ও ধাপ্পাবাজি হিসেবে চিহ্নিত করেন। কিন্তু ৬ শতাংশ ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা তাঁরা দিতে পারেননি। কারণ, এসব ঘটনার বর্ণনা বা প্রমাণ ঠিক স্পষ্ট নয়। যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য ছিল না এসব নিয়ে। তবে তাঁরা নিশ্চিত হন, এসব ঘটনার সঙ্গে বহির্জাগতিক প্রাণের কোনো সম্পর্ক নেই। (কীভাবে, সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি।) এ গবেষণা প্রতিবেদনের উপসংহারে তাঁরা বলেন, এ ধরনের গবেষণা চালিয়ে আসলে লাভ নেই। মার্কিন জনগণ বা বিমানবাহিনীর জন্য এগুলো কোনো হুমকি নয়। ফলে ১৯৬৯ সালে বন্ধ হয়ে যায় প্রজেক্ট ব্লু বুক। আরেকটু ছোট পরিসরে প্রজেক্ট সাইন ও প্রজেক্ট গ্রাজ নামের আরও কিছু প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিল মার্কিন বিমানবাহিনী, সেগুলোও বন্ধ হয়ে যায় কিছুদিন পরেই। কারণ, যেসব ঘটনা ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না, তা যতটা না রহস্যময়, তার চেয়ে উপস্থাপিত বর্ণনা ও প্রমাণগুলো অনেক অস্পষ্ট। তথ্যের অভাবই এসব ঘটনা ব্যাখ্যা করতে না পারার মূল কারণ।

বেষণাবিষয়ক প্রচুর নথিপত্র ফ্রান্সের ন্যাশনাল সেন্টার ফর স্পেস স্টাডিজ ইন্টারনেটে উন্মুক্ত করে দেয়। ৫০ বছরে ১ হাজার ৬০০ ইউএফও দেখার ঘটনা নিয়ে এ নথিপত্রে আছে এক লাখ পৃষ্ঠার বিবরণ, ফিল্ম ও অডিও টেপ। এর প্রায় ৪৫ শতাংশ ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে পেরেছে তারা। বাকিগুলোতে একই সমস্যা, যথেষ্ট তথ্যের অভাব এবং অস্পষ্ট বর্ণনা বা প্রমাণ।

এখান থেকে ইউএফও নিয়ে আমরা একটা ধারণা পাই। ইউএফও নিয়ে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে মূলত এসব অস্পষ্ট বর্ণনা ও তথ্যের অভাব থেকে। মানুষ অজানাকে ভয় পায়। ইউএফও নিয়ে এত হেঁয়ালি ও ভয়ের পেছনে এটা একটা বড় কারণ।

বিষয়টা বোঝার জন্য যুক্তিবিদ্যার একটা পারিভাষিক শব্দের সঙ্গে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিই। ‘প্রুভিং আ নেগেটিভ’ বলে একটা বিষয় আছে। এর মানে, ঋণাত্মক কোনো দাবি প্রমাণ করা। অর্থাৎ কিছু নেই, তা যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা। এটা অসম্ভব। বার্ডেন অব প্রুফ, বা কোনো কিছু প্রমাণের দায় আসলে ধনাত্মক দাবি যিনি করছেন, তাঁর। মানে, যিনি কোনো কিছু আছে বলে দাবি করছেন, তাঁকে প্রমাণ করতে হবে, সেটা আছে। কিন্তু সেটা যে নেই, এটা প্রমাণ করা আসলে সম্ভব নয়।

একটা উদাহরণ দিলে তোমরা বিষয়টা ভালোভাবে বুঝতে পারবে। ধরো, কেউ দাবি করল, পৃথিবীতে গোলাপি রঙের হাতি আছে। বিজ্ঞানীরা পুরো পৃথিবী চষে ফেললেন। স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে পৃথিবীর বিভিন্ন কোনার গুহা বা বনাঞ্চলের সবকিছু তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো। পাওয়া গেল না গোলাপি হাতি। তাতে কী প্রমাণিত হয়, পৃথিবীতে গোলাপি হাতি নেই? নিশ্চিতভাবে কি এ কথা বলা সম্ভব? যুক্তি বলে, ১০০ ভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে এ দাবি করা সম্ভব নয়। হতেই পারে অনাবিষ্কৃত কোনো গহিন অরণ্যে আছে অল্প কিছু গোলাপি হাতি। কাজেই ১০০ ভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে কোনো কিছু নেই, এমন দাবি করা যায় না। তবে যৌক্তিকভাবে বলা যায়, আমাদের জানা সবটুকু জ্ঞান, তথ্য ও প্রযুক্তি বলছে, এ রকম কিছু নেই। ইউএফওর বিষয়টিও ঠিক সে রকম।

এখন তুমি বলতেই পারো, উঁহু, ইউএফওর বিষয়টি তো ঠিক এ রকম নয়। মার্কিন সরকার নিজেই তিন–তিনটি ইউএফওর ফুটেজ উন্মুক্ত করে দিয়েছে সবার জন্য। তার মানে, বিষয়টা তো বাস্তব! হ্যাঁ, ফুটেজ তারা প্রকাশ করেছে সত্যি। কিন্তু ফুটেজে দেখা যাওয়া জিনিসগুলো ইউএফও বা আনআইডেনটিফাইড ফ্লাইং অবজেক্ট—অর্থাৎ উড়োযানগুলো আসলে কী, তা ফুটেজ দেখে পুরোপুরি বোঝা যাচ্ছে না। মার্কিন সরকার ফুটেজগুলো উন্মুক্ত করে দিয়েছে সে জন্যই। পুরো পৃথিবীর বড় বড় বৈজ্ঞানিক, গবেষক, ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষক, গেম ডিজাইনার ইত্যাদি বিভিন্ন পেশার বিশেষজ্ঞরা যেন এসব ফুটেজ পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। তাহলে বিশেষজ্ঞরা ফুটেজগুলো পরীক্ষা করে কী পেলেন?

ইনফ্রারেড আলোয় তোলা ফ্লার ১–এর ছবি দেখে মনে হয়, ডিম্বাকৃতির (উপবৃত্তাকার) কোনো উড়োযান। যাতে কোনো ইঞ্জিন বা কোনো ধরনের চালিকা শক্তি দেখা যাচ্ছে না। খুব অস্পষ্ট একটা ছবি, ভিডিওতে দেখে মনে হচ্ছে উপবৃত্তাকার একটি দাগ। গিম্বলের ছবিটাও প্রায় একই রকম। গো ফাস্টের ছবিটি কল্পনার সসারের মতো, অস্পষ্ট আকৃতিতে অন্তত তেমনটাই মনে হয়। অনেক দূর থেকে কোনো উত্তপ্ত বস্তুর ছবি তুললে তার উজ্জ্বলতা অবলোহিত ক্যামেরায় এমনটাই দেখানোর কথা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভিডিওগুলো মোটেই রহস্যময় কিছু নয়। প্রচণ্ড গতিতে চলমান একটি বিমানের ক্যামেরার নড়াচড়া ও গতির কারণে ভিডিওগুলোতে একধরনের অপটিক্যাল ইলিউশন বা দৃষ্টিবিভ্রম তৈরি হয়েছে। বারবার বিভিন্ন কোণ থেকে ভিডিওর চেষ্টা করতে গিয়ে দ্রুতগতিতে চলমান বিমানের চালক নিজেই এই হেঁয়ালি তৈরি করেছেন। ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরাগুলো বারবার ফোকাস হারিয়ে ফেলছে, বাঁ থেকে চলে যাচ্ছে ডান দিকে। এ ধরনের নড়াচড়া ও প্যারালাক্স প্রভাব মিলে তৈরি হয়েছে এই বিভ্রম।

‘প্যারালাক্স প্রভাব’ কী? দূরের কোনো বস্তুর দূরত্ব পরিমাপের বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি প্যারালাক্স। তোমার বাঁ চোখ বন্ধ করে, ডান চোখের সামনে ডান হাতের একটি আঙুল তুলে ধরো। তারপর বাঁ চোখ খুলে, ডান চোখ বন্ধ করে আঙুলটির দিকে তাকাও। দেখবে, আঙুলটা খানিকটা ডানে সরে গেছে বলে মনে হচ্ছে। একই রকম বিভ্রম তৈরি হতে পারে প্রচণ্ড গতিশীল বিমানের ক্যামেরা বাঁ থেকে ডান দিকে সরে যাওয়ার সময়।

গো ফাস্টের ভিডিওটিতে সৃষ্ট হেঁয়ালির পেছনেও আছে প্যারালাক্স প্রভাব। আর আছে ত্রিমাত্রিক ছবিকে দ্বিমাত্রিকভাবে দেখার ফলে সৃষ্ট হেঁয়ালি। গো ফাস্ট নামের উড়ন্ত বস্তুটি দেখে মনে হয়, জিনিসটা ৬০ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে ১ সেকেন্ডে ৫০ ফুট উচ্চতায় নেমে এসেছে। কিন্তু ত্রিকোণমিতি আর একটুখানি বিজ্ঞান ব্যবহার করে বোঝা যায়, বিষয়টা অন্য রকম হতে পারে।

চলন্ত জেটবিমানের ক্যামেরা যখন কোনো বস্তুর ছবি তোলে, স্ক্রিনে সেটা দেখে মনে হয়, ওই বস্তুটা ছুটছে। কিন্তু ক্যামেরাটাও যে ছুটছে, স্থির নয়, তা কিন্তু বোঝা যায় না। বাস্তবতা হলো, যে জেটবিমানটি ছবি তুলেছে, তার বেগ ছিল ৩৬৯ নট। মানে, ঘণ্টায় প্রায় ৬৮৩ কিলোমিটার। আর জেটবিমানটি ছিল ২৫ হাজার ফুট উচ্চতায়। বিমানের অবস্থান ও এই বেগ হিসেবে নিয়ে ত্রিকোণমিতির সূত্রে বসালে বোঝা যায়, যে অদ্ভুত বস্তুটির ছবি তোলা হয়েছে, অর্থাৎ গো ফাস্ট, সেটা অন্তত ১৩ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়ছিল। এ হিসাবে যানটির বেগ হতে পারে সর্বোচ্চ ২৮ থেকে ১০০ নটের মতো। অর্থাৎ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৮৫ কিলোমিটারের মতো। সমুদ্রপৃষ্ঠ ও জেটবিমানটির মাঝামাঝি উচ্চতায় উড়ছিল উড়োযানটি, সে জন্যই সৃষ্টি হয়েছে এই হেঁয়ালি। ভিডিওতে তা–ই মনে হচ্ছে, উড়োযানটি সমুদ্রপৃষ্ঠের একদম কাছাকাছি উড়ছে। (এই ছোট্ট লেখায় বিস্তারিত হিসাবটি আর যুক্ত করব না। আগ্রহীরা চাইলে বিস্তারিত পড়ে নিতে পারবে তথ্যসূত্র থেকে।)

এখন আসল প্রশ্ন, গো ফাস্ট বস্তুটা আসলে কী? উত্তর, এই বেগ ও অবস্থান এবং সম্ভাব্য আকৃতি দেখে মনে হয়, জিনিসটি একটি বেলুন হতে পারে। শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে কি বলা যায়? না। যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত না থাকায় তা বলা সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের জানা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জ্ঞান ব্যবহার করে, অনেক বিশ্লেষকের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ এবং ভিডিওগুলো নিয়ে প্রচুর কাটাছেঁড়ার পর প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বেলুনই হওয়ার কথা। তবে বেলুন যদি না-ও হয়, জিনিসটা যে বহির্জাগতিক কোনো প্রযুক্তি নয়, তা মোটামুটি নিশ্চয়তা দিয়েই বলা যায়। (কীভাবে, সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি।)

তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াল? যথেষ্ট তথ্য-উপাত্তের অভাবে আমরা অনেক ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি না। দৃষ্টিভ্রম বা মানবিক তাড়না ও অজানার ভয় আমাদের মনে বিচিত্র সব কল্পনার সৃষ্টি করে। একটা ঘটনাকে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাখ্যা করা না গেলেও অবাস্তব বা অসম্ভব কিছু ভেবে নেওয়ার আগে তা নিয়ে আমাদের বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য সব ব্যাখ্যাকে বাতিল করে দিতে পারতে হবে। তারপর জিনিসটাকে নতুন কিছু বলে ধরে নেওয়া যাবে, তার আগে নয়।

বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত ইউএফও নিয়ে এমন কোনো ঘটনা পাননি, যা নতুন কিছুর ইঙ্গিত দেয়। তবে অনেক ঘটনা এখনো শতভাগ নিশ্চিতভাবে ব্যাখ্যা করা যায়নি তথ্য ও উপাত্তের অভাবে। সেই ঘটনাগুলোকেই বলা হয় ইউএপি বা আনআইডেন্টিফায়েড এরিয়াল ফেনোমেনা। অর্থাৎ ঘটনাগুলো রহস্যময় কিছু নয়, বরং এগুলোকে ব্যাখ্যা করার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য নেই আমাদের কাছে। তবে ‘ইউএপি’ বা ‘ইউএফও’ শব্দগুলো আমাদের মস্তিষ্কে যে বহির্জাগতিক প্রাণের চিত্র তুলে ধরে, তার সঙ্গে এসব ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। অন্তত আমাদের জানা বিজ্ঞান তা-ই বলে। কীভাবে?

তিন

তোমরা নিশ্চয়ই আপেক্ষিকতা তত্ত্বের কথা শুনেছ। এই তত্ত্ব বলে, মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ গতিবেগ হলো শূন্য মাধ্যমে আলোর গতিবেগ। সেকেন্ডে ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল বা ৩ লাখ কিলোমিটার। এর বেশি গতিতে কোনো কিছু ছুটতে পারবে না। আর কোনো কিছু যখন আলোর গতিতে ছুটবে, তখন তার ভর হতে হবে শূন্য। আলো এই গতিতে ছুটতে পারে। কারণ, আলোর কণা ফোটনের ভর শূন্য। তার মানে, যে জিনিসের ভর আছে, সেটা কোনোভাবেই আলোর বেগে ছুটতে পারবে না।

আমাদের বানানো সবচেয়ে দ্রুতগতির মহাকাশযানের নাম পার্কার সোলার প্রোব। ঘণ্টায় এটি প্রায় ৭ লাখ কিলোমিটার বেগে ছুটছে। তারপরও ২০১৮ সালে যাত্রা করে এটি প্রায় চার বছর পর, ২০২২ সালের শুরুর দিকে সূর্যের বাইরের দিকের করোনা অঞ্চলে পৌঁছেছে। ছোট্ট এই নভোযানটির যদি পৃথিবী থেকে সূর্যের কাছাকাছি পৌঁছাতেই এত সময় লেগে যায়, তাহলে এর চেয়ে বড় কোনো নভোযানের কত সময় লাগবে, ভাবো!

সৌরজগতের সব কটি গ্রহ তন্নতন্ন করে খুঁজেছেন বিজ্ঞানীরা। কোথাও কোনো প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। সৌরজগতের বাইরে আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রের নাম আলফা সেন্টাউরি। এটি প্রায় ৪.২৫ আলোকবর্ষ দূরে। এর মানে কী?

সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে ৮ মিনিটের মতো। আলফা সেন্টাউরি থেকে আলো আসতে সময় লাগে ৪.২৫ বছর, মানে সোয়া চার বছর। আলোরই যদি আসতে এত সময় লাগে, তাহলে কোনো মহাকাশযানের কি চোখের পলকে এত দূর থেকে পৃথিবীতে এসে আবার চলে যাওয়া সম্ভব? সম্ভব না। যত উন্নত প্রযুক্তিই হোক, পদার্থবিজ্ঞানের এই নিয়ম ভাঙার সাধ্য কারও নেই।

বিষয়টা আরেকটু ভালোভাবে বোঝার জন্য একটা মহাকাশযানের কথা ভাবো। এতে যদি একজন এলিয়েন নভোচারী থাকেন, তাঁর ভর থাকবে। নভোযানের ভর থাকবে। তাঁদের খাওয়াদাওয়া লাগবে। নভোযান চালানোর জন্য যন্ত্রপাতি লাগবে, জ্বালানি লাগবে। এগুলোর যে ভর হবে, সেটা মোটামুটি হবে ১০ হাজার টনের মতো। সেই ভর দিয়ে আলোর বেগের অর্ধেক বেগে, অর্থাৎ সেকেন্ডে দেড় লাখ কিলোমিটার বেগে ছুটে এলেও যানটির সময় লাগবে অন্তত ১০ বছরের মতো।

একটু আগে যে পার্কার সোলার প্রোবের কথা বললাম, সেটার ভর মাত্র ৭০০ কেজির মতো। অথচ এর বেগ আলোর গতির ১ হাজার ভাগের ১ ভাগেরও কম। তার মানে, প্রায় ১০ হাজার টন ভরের একটি এলিয়েন নভোচারীবাহী মহাকাশযান পার্কার সোলার প্রোবের বেগেও চলতে পারবে না। তার মানে, এর আসতে-যেতে সময় লাগবে আরও বেশি। প্রায় সোয়া ৪ আলোকবর্ষ দূর থেকে আলোর বেগের ১০০ ভাগের ১ ভাগ গতিতে ছুটে এলেও এ রকম একটি যানের অন্তত ৪৫-৫০ বছরের মতো সময় লাগবে। তখন আবার এর ভর আরও বেড়ে যাবে। কারণ, আসতে ৫০ বছর, যেতে ৫০ বছর ধরে ১০০ বছরের খাবার, জ্বালানি ইত্যাদি লাগবে তখন নভোযানটির।

আবার এ রকম কোনো নভোযান এসে যে কোথাও ঘাপটি মেরে থাকবে, সে উপায়ও আসলে নেই। কারণ, এ ধরনের নভোযানের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতে হবে নিউক্লিয়ার জ্বালানি। আর নিউক্লিয়ার জ্বালানি তেজস্ক্রিয়। তার মানে, এই তেজস্ক্রিয়তা আমরা শনাক্ত করতে পারব। তেজস্ক্রিয়তা বাদ দিলেও তোমার-আমার, আমাদের সবার দেহ থেকেই তাপ বের হয়। এই তাপ শনাক্ত করা যায়, ইংরেজিতে একে বলে হিট সিগনেচার। এই হিট সিগনেচার লুকানোর কোনো উপায় নেই।

সহজ কথা হলো, এলিয়েন বা পৃথিবীর বাইরে থেকে কোনো নভোযান যদি পৃথিবীতে আসতে চায়, তাকে আসতে হবে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম মেনে। সেই নিয়ম অনুযায়ী বলা যায়, আমাদের দেখা ইউএফও এ রকম কিছু না। ‘ইউএফও’ বা অজানা কথাটিই যা একটু রহস্যময় শোনায়। আসলে বিষয়টি তথ্যের অভাব, আমরা এখনো জানি না জিনিসগুলো ঠিক কী। তবে জিনিসগুলোর সঙ্গে যে এলিয়েন বা বহির্জাগতিক প্রাণের কোনো সম্পর্ক নেই, এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত।

এখন যদি বলো, এসব নভোযান পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র মানে না, অন্য কোনো মহাবিশ্ব থেকে ভিন্ন কোনো বিশেষ বিজ্ঞানের সূত্র মেনে আসা-যাওয়া করে, তাহলে ওই যে ওপরে বললাম, সেটা তোমাকে প্রমাণ করতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এমন কিছুর প্রমাণ বা অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

কিন্তু এই লেখা পড়ার পরও তোমাদের মধ্যে ইউএফও নিয়ে রহস্যময়তা থাকবে, তোমরা এ ব্যাপারে শুনে মুগ্ধ হবে—সেটাই স্বাভাবিক। এর প্রয়োজনও আছে। কল্পনাশক্তি, অজানার প্রতি টান, তাকে জানতে চাওয়া, কিছু গুজব আর খানিকটা রহস্য না থাকলে জীবনটা পানসে হয়ে যাবে না?

তথ্যসূত্র

  • দ্য গার্ডিয়ান, নিউইয়র্ক টাইমস, উইকিপিডিয়া, সেটি (SETI);

  • প্রিলিমিনারি অ্যাসেসমেন্ট: আনআইডেন্টিফায়েড এরিয়াল ফেনোমেনা, অফিস অব দ্য ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স;

  • ফিজিকস অব দ্য ইমপসিবল, মূল: মিচিও কাকু, অনুবাদ: আবুল বাসার, প্রকাশক: প্রথমা;

  • বিজ্ঞানচিন্তা, জানুয়ারি ২০২২;

  • গো ফাস্ট নিয়ে বিস্তারিত: metabunk.org/threads/go-fast-footage-from-tom-delonges-to-the-stars-academy-bird-balloon.9569