২০১৪ সালের অক্টোবরের কথা। যুক্তরাজ্যের নর্থ ব্র্যাডলে শহরে সুন্দর একটা বাড়ি কিনেছিলেন মিশেল মিডউইন্ডার। পুরো বাড়ি ঘুরে বেশ পছন্দ হয়েছিল তাঁর। বাইরে থেকে বাড়িটার একটা ছবিও তুলেছিলেন। কিন্তু ছবিটা দেখেই ভ্রু কুঁচকে গিয়েছিল মিশেলের। ঘরের ভেতর, জানালার ওপাশ থেকে কে যেন তাকিয়ে আছে!
দৌড়ে ঘরের ভেতরে গেলেন মিশেল। নাহ্, কেউ নেই!
ঘটনা এখানেই শেষ না। ১৮৬০ সালে এ বাড়িতে থাকত স্যামুয়েল কেন্ট নামে এক লোক। ১৬ বছর বয়সে যে তার ভাইকে খুন করেছিল। ১৮৭২ সালে এ বাড়িতেই মারা যায় কেন্ট। মিশেল ছবিটা ফেসবুকে আপলোড করার পর স্থানীয় এক ইতিহাসবিদ দাবি করলেন, ভুতুড়ে মুখটার সঙ্গে কেন্টের চেহারার অদ্ভুত মিল! পুরোনো ছবিটবি ঘেঁটে কেন্টের একটা ছবি পাওয়া গেল। দুটো ছবি পাশাপাশি রাখা হলো। আশ্চর্য, সত্যিই তাই!
মিশেলের তোলা ছবি নিয়ে পরে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। কেউই ঘটনার বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারেনি। সাহস করে অনেকেই সে বাড়িতে থেকেছে। সবাই স্বীকার করেছে, বাড়িটাতে অস্বস্তিকর ‘একটা কিছু’ আছে!
নর্থ ব্র্যাডলে শহরের এ বাড়িটার মতো সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অনেক ভুতুড়ে বাড়ি। তেমনই পাঁচটি কুখ্যাত বাড়ির কথাই বলছি শোনো।
মন্টে ক্রিস্টো
অস্ট্রেলিয়ার এই বাড়ির প্রথম মালিক ছিলেন ক্রিস্টোফার ও এলিজাবেথ ক্রলে। তাঁদের এক পরিচারিকা ব্যালকনি থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন। বিছানায় আগুন ধরে মারা গিয়েছিল এই বাচ্চা ছেলে। একটা ছোট্ট মেয়ে সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিল (অনেকে বলে ধাক্কা দিয়ে ফেলা হয়েছিল)। এসব কারণে বলা হয়, এটিই অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে ভুতুড়ে বাড়ি।
গত ৫০ বছর মন্টে ক্রিস্টোতে আছেন মিস্টার ও মিসেস রায়ান। তাঁদের দাবি, অস্বাভাবিক অনেক কিছুই ঘটে এ বাড়িতে। ব্যালকনিতে পায়ের শব্দ শোনা যায়। প্রায়ই কে যেন নাম ধরে ডাকে। সব সময় মনে হয়, কে যেন দেখছে। একবার মিসেস রায়ানের কাঁধে হাতও রেখেছিল অশরীরী কেউ!
অস্বাভাবিকতা পাওয়া গেছে ক্যামেরায় তোলা ছবিতেও। মন্টে ক্রিস্টোতে আছে একটা পুরোনো ঘোড়ার গাড়ি। রায়ানদের এক অতিথির তোলা এ গাড়ির ছবিতে পাওয়া গেছে একটা আবছা মানুষের অবয়ব। দেখে মনে হয়, কে যেন বসে আছে। বাড়ির সদস্যদের তোলা সেলফিতেও দেখা গেছে এমন এক হাত, যেটা ছবির কারোরই না!
বিজ্ঞান লেখক ফিলিপ বল অবশ্য মন্টে ক্রিস্টো ঘুরে ‘ভুতুড়ে অনুভূতি’র একটা ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে, বাড়িটিতে একধরনের ইনফ্রাসাউন্ড (মানুষের শ্রবণক্ষমতার নিচের শব্দ) কাজ করে। এ শব্দ অস্বস্তিকর অনুভূতি তৈরি করতে পারে। তবে মিস্টার রায়ান বলেন, ‘অশরীরী আত্মায় অবিশ্বাসী অনেকেই এ বাড়িতে ঘুরতে এসে ধারণা বদলে গেছে।’
এত কিছুর পরও রায়ান পরিবার কেন এ বাড়িতেই থাকে, সেটা একটা রহস্য!
হোয়াইট হাউস
চোখ কচলে তাকাতে হবে না। ভুল পড়োনি। মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাসভবনের কথাই বলা হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে হোয়াইট হাউসের বাসিন্দারা দাবি করেছেন, এ বাড়িতে নাকি ভূতের উপদ্রব আছে। হোয়াইট হাউসের ভূতদের মধ্যে সবচেয়ে ‘জনপ্রিয়’ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ভূত। অনেকেই অশরীরী লিংকনকে দেখার দাবি করেছে।
লিংকন মৃত্যু পরবর্তী জীবনে বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু তাঁর স্ত্রী ম্যারির প্রেততত্ত্বে বিশ্বাস ছিল। সন্তান উইলির মৃত্যুর পর ম্যারি হোয়াইট হাউসে প্ল্যানচ্যাট করতেন। মৃত ছেলের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করতেন তিনি। স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে একবার লিংকনও প্ল্যানচ্যাটে অংশ নিয়েছেন।
হোয়াইট হাউসে প্রথম লিংকনের ভূত দেখেন ফার্স্ট লেডি গ্রেস কুলিজ (৩০তম প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলিজের স্ত্রী)। তাঁর দাবি, একদিন জানালার ওপাশ থেকে তিনি লিংকনকে তাকিয়ে থাকতে দেখছেন। ১৯৪২ সালে নেদারল্যান্ডসের রানি উইলহেলমিনা হোয়াইট হাউসের অতিথি হয়ে সেখানে এক রাত ছিলেন। ভয়ের চোটে সেবার বেচারি অজ্ঞানই হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর দাবি, মাঝরাতে কে যেন তাঁর দরজায় টোকা দিয়েছিল। দরজা খুলে তিনি দেখেছেন, লিংকন দাঁড়িয়ে আছেন! যুক্তরাষ্ট্রের ৩৩তম প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানও বিশ্বাস করতেন, হোয়াইট হাউসে সাবেক প্রেসিডেন্টদের আত্মা ঘুরে বেড়ায়।
বোর্গভ্যাটনেটের কটেজ
বোর্গভ্যাটনেট উত্তর সুইডেনের একটা ছোট্ট গ্রাম। সেখানকার একটা কটেজে ঘটে অদ্ভুত সব ঘটনা। প্রথম ১৯২৭ সালে কটেজের বাসিন্দা নিলস হেডলান্ড দাবি করেন, এখানে অশরীরী শক্তি আছে। একটা অদৃশ্য শক্তি নাকি তাঁর কাপড় ছিঁড়ে ফেলত। ১৯৩০ সালে সে বাড়িতে থাকতে শুরু করেন রুডলফ ট্যাংডেন নামে এক ধর্মযাজক। একদিন হঠাত্ই তাঁর ঘরে দেখেছিলেন ধূসর পোশাক পরা এক নারীকে। রুডলফ যখনই তাকে অনুসরণ করতে গেছেন, তখনই চোখের সামনে মিলিয়ে গিয়েছিল মানুষটা। বাড়ির এক অতিথি একবার মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেখেন, তিন নারী স্থির দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে। তড়িঘড়ি করে উঠে তিনি বাতি জ্বেলেছেন। তারপরও বেশ কিছুক্ষণ ছিল তিন নারীর অবয়ব।
১৯৪৫ সালে এরিক লিন্ডগ্রেন নামে এক লেখক এ বাড়িতে থেকে তাঁর ভুতুড়ে অভিজ্ঞতাগুলো লিখতে শুরু করেছিলেন। সে সময় একাধিকবার একটা অদৃশ্য শক্তি তাঁকে চেয়ার থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল।
মজার ব্যাপার হলো কটেজটিতে এখন একটা রেস্তোরাঁ চালু আছে। আছে রাতে থাকার ব্যবস্থাও। কেউ যদি পুরো এক রাত এখানে থাকতে পারে, তাকে সাহসিকতার প্রমাণ হিসেবে সনদ দেওয়া হয়!
ভানগড় কেল্লা
ভারতের ভানগড় কেল্লাকে বলা হয় এশিয়ার সবচেয়ে ভুতুড়ে জায়গা। স্থানীয় লোকজন বলেন, রাতের অন্ধকারে সেখানে গেলে কেউ ফিরে আসে না! এ কেল্লা তৈরি করেছিলেন রাজা মাধো সিং। কেল্লা তৈরির আগে এখানে সাধনা করতেন গুরু বালুনাথ। সাধুর কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই কেল্লা তৈরি করেছিলেন মাধো সিং। প্রচলিত আছে, বালুনাথ বলে গিয়েছিলেন, ‘তোমার কেল্লা যদি কখনো আমার সমাধির ওপর ছায়া ফেলে, তখনই তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে।’ কিন্তু মাধো সিং এত উঁচু করে কেল্লা বানিয়েছিলেন, একসময় এটি বালুনাথের সমাধির ওপর ছায়া ফেলতে শুরু করে। সে সময়ই ভানগড় কেল্লার ছাদ ধসে পড়েছিল। এখনো নাকি ওই এলাকায় কোনো বাড়ি তৈরি করলেই ছাদ ধসে পড়ে।
ভারতের সরকার পর্যটকদের এই কেল্লায় যেতে নিরুত্সাহিত করে। অন্ধকারে কেল্লার ভেতরে ঢোকা একদম নিষেধ। পর্যটকেরাও বলেন, এই কেল্লার ভেতরে ঢুকলেই কেমন যেন একটা মানসিক চাপ বোধ হয়। একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি ঘিরে ধরে!
৫০ বার্কলে স্কয়ার
এটিই ব্রিটেনের সবচেয়ে ভুতুড়ে বাড়ি। শুরুটা হয়েছিল ১৮৩০ সালে। সেবার ওপরতলার জানালা থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছিল এক তরুণী। পরে এ বাড়িতে থাকতে শুরু করেন মিস্টার মেয়ার নামে এক লোক। পরে বিশেষ এক কারণে তিনি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। জীবনের বাকি সময় ৫০ বার্কলে স্কয়ারে রহস্যময় জীবন কাটিয়েছেন তিনি।
১৮৮০ সালে বাড়িটিতে থাকতে শুরু করে বেন্টলে পরিবার। মিস্টার আর মিসেস বেন্টলের একমাত্র মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছিল সেনা কর্মকর্তা কেনফিল্ডের সঙ্গে। বিয়ের দিন পুরো বাড়িতে যখন অতিথিরা উত্সবে মশগুল, হঠাত্ই চিত্কার শোনা গেল ওপরের ঘর থেকে। সবাই ছুটে গিয়ে দেখে, বাড়ির কাজের মেয়েটি মেঝেতে পড়ে। ভয়ে তার মুখ সাদা। কোনো কথা বলতে পারছিল না। শুধু এটুকু বলেছিল, ঘরের ভেতর একটা ভয়ংকর কিছু দেখেছে সে। হাসপাতালে নেওয়ার পরও তাকে বাঁচানো যায়নি।
ঘটনার পর নতুন জামাই কেনফিল্ডের জেদ চেপে গেল। তিনি ঠিক করেছিলেন, এক রাত একা ওই ঘরে থাকবেন। নিষেধের তোয়াক্কা না করে শুরু হয় তাঁর ‘ভূত দেখা’র অভিযান। কেনফিল্ড ঘরে একটা ঘণ্টা লাগিয়ে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘অস্বাভাবিক কিছু দেখলেই আমি ঘণ্টা বাজাব।’ এমনকি তাঁর সঙ্গে পিস্তলও ছিল।
পরদিন ভোরে গুলি আর প্রচণ্ড ঘণ্টার শব্দে সবার ঘুম ভাঙে। ওপরে গিয়ে দেখা গেল, কেনফিল্ড মেঝেতে পড়ে আছেন। কাজের মেয়েটির মতো একই অবস্থা তাঁরও। ঘরের এক কোনায় দেয়ালে গুলির চিহ্ন ছাড়া আর কোনো পরিবর্তন চোখে পড়েনি। কেনফিল্ড বেঁচে গেছেন, তবে তিনি আর কখনো কথা বলতে পারেননি। তাই সে রাতে তিনি কী দেখেছিলেন, সেটাও জানা যায়নি।