ঢাকা থেকে গর্ত খুঁড়লে পৃথিবীর বিপরীত পাশে কোথায় গিয়ে উঠব
আচ্ছা, বলো তো, আমরা পৃথিবীর কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? পৃথিবীর বাইরে না ভেতরে? আমরা কিন্তু আছি পৃথিবীর বাইরে। একটা ফুটবল কল্পনা করো। ফুটবলের যে ওপরের পৃষ্ঠ, সেখানেই আছি আমরা। ভাবতে পারো, তাহলে পৃথিবীর ওপর থেকে আমরা পড়ে যাই না কেন? এ প্রসঙ্গে পরে বিস্তারিত লিখব।
যাহোক, আমরা ফুটবলের ওপরের স্তরে আছি। এই ফুটবল কিন্তু কয়েকটা ধাপে তৈরি হয়। ফুটবলের ওপর চামড়া কাটলে দেখবে, ওটার নিচে আরও একটা পাতলা চামড়া আছে। তার নিচে আছে আরও একটা চামড়া। ফুটবলের দাম অনুসারে এমন অনেকগুলো স্তর থাকে। পৃথিবীরও এমন অনেক স্তর আছে। আজকের লেখায় সেই স্তরগুলো সম্পর্কেই জানব।
আসলে পৃথিবীকে সত্যিকার অর্থে বুঝতে হলে ওপরের দিকে নয়, বরং পায়ের দিকে তাকাতে হবে। মানে আকাশের দিকে তাকিয়ে পৃথিবীকে সেভাবে বোঝা যাবে না। ঢুকতে হবে মাটি খুঁড়ে নিচে। তা–ও প্রায় ৬ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। কিন্তু সে কাজ মোটেও সহজ নয়। মানুষ এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত ড্রিল করতে পেরেছে। তাতেও সময় লেগে গেছে ২০ বছর। একবার ভাবো, ৬ হাজার কিলোমিটারের বেশি গর্ত করতে হলে কত হাজার বছর লাগবে!
বাস্তবে হয়তো গর্ত করে পৃথিবীর কেন্দ্রে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে কল্পনায় তো যেতেই পারি। পৃথিবীর মোট চারটি স্তর আছে—ভূত্বক, ম্যান্টল, ভেতরের কেন্দ্র ও বাইরের কেন্দ্র। কল্পনায় আমরা ড্রিল করে সব কটি স্তর ভেদ করে পৌঁছে যাব পৃথিবীর কেন্দ্রে।
শুরুতেই ভূত্বক। এটা অনেকটা ডিমের খোলসের মতো। ভূত্বক তুলনামূলক হালকা উপাদান যেমন সিলিকা, অ্যালুমিনিয়াম ও অক্সিজেন দিয়ে তৈরি। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মতো মহাসাগরের নিচে পৃথিবীর ভূত্বক পাঁচ কিলোমিটারের মতো পুরো হতে পারে। তবে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩০-৭০ কিলোমিটার পুরো হবে। ভূত্বকের নিচে জিগস পাজলের মতো অনেক বড় বড় টেকটনিক প্লেট আছে। এগুলো ধীরে ধীরে চলে। প্রতিবছর মাত্র ৩-৫ সেন্টিমিটার সরতে পারে টেকটনিক প্লেটগুলো। এই প্লেটের কারণেই ভূমিকম্প বা আগ্নেয়গিরি দেখা দেয়।
এরপর আরও ড্রিল করলে পৌঁছে যাবো ম্যান্টলে। এই স্তর প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার পুরো। পৃথিবীর সবচেয়ে পুরু স্তর এটি। ভূপৃষ্ঠের মাত্র ৩০ কিলোমিটার নিচেই শুরু হতে পারে ম্যান্টলের স্তর। বেশির ভাগই লোহা, ম্যাগনেশিয়াম ও সিলিকন দিয়ে তৈরি। এই স্তর ঘন, গরম ও মোটামুটি কঠিন ধরনের, অনেকটা ক্যান্ডির মতো। আরও গভীরে মানে ১০০ থেকে ২০০ কিলোমিটার নিচে ম্যান্টলের তাপমাত্রায় শিলাও গলে যায়। এই স্তরে তৈরি হয় হীরা। বেশির ভাগই ২০০ কিলোমিটারের নিচে গঠিত হয়। কিন্তু বিরল ‘সুপার-ডিপ’ হীরা গঠিত হয় ভূপৃষ্ঠের প্রায় ৭০০ কিলোমিটার নিচে।
আরও গর্ত খুঁড়লে চলে যাব কেন্দ্রে। এই কেন্দ্র আবার দুই ভাগে বিভক্ত। ভেতরের কেন্দ্র ও বাইরের কেন্দ্র। বাইরের কেন্দ্র লোহা ও নিকেল দিয়ে তৈরি। এই অংশ থাকে তরল অবস্থায়। ২ হাজার ২০০ থেকে ৩ হাজার ২০০ কিলোমিটার গভীরতায় শুরু হয় এই স্তর। এখানে লোহা ও নিকেল ছাড়াও সামান্য পরিমাণে অক্সিজেন, সালফার ও সিলিকন রয়েছে। তাপমাত্রা থাকে ৪-৬ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। তরল না হয়ে উপায় আছে!
তবে পৃথিবীর ভেতরের কেন্দ্র কিন্তু থাকে কঠিন অবস্থায়। এই অঞ্চলও মূলত লোহা ও নিকেল দিয়ে গঠিত। এর ব্যাসার্ধ প্রায় ১ হাজার ২২০ কিলোমিটার। চাঁদের ব্যাসার্ধের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ। তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছ, তার থেকে ৬ হাজার ৪০০ থেকে ৫ হাজার ১৮০ কিলোমিটার নিচে রয়েছে এই স্তর। এই ভেতরের স্তর অন্যান্য স্তরের চেয়ে কিছুটা দ্রুত ঘোরে। এখানকার তাপমাত্রা ৫-৭ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। ভাবতে পারো, তাপমাত্রা বেশি হওয়া সত্ত্বেও এই অঞ্চল কেন কঠিন। আসলে এই অঞ্চলের চাপ অনেক বেশি। অত্যন্ত বেশি চাপ থাকায় এই অঞ্চল কঠিন অবস্থায় রয়েছে।
এখন কিন্তু আমাদের গর্ত করা থামাতে হবে। কিন্তু তুমি যদি এখানে থামতে না চাও, মানে আরও যদি গর্ত করতে চাও, তাতেও আমার আপত্তি নেই। কারণ, এরপর আরও গর্ত করলে তুমি যথাক্রমে বাইরের কেন্দ্র, ম্যান্টল ও ভূত্বক ঘুরে আবার ভূপৃষ্ঠে উঠে আসবে। হয়তো গর্ত করার সময় শুরু করেছিলে বাংলাদেশ থেকে, কিন্তু উঠলে গিয়ে সমুদ্রে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলির সমুদ্র উপকূল মিশেছে দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরে। তুমি কতটা সোজাসুজি গর্ত করতে পারো, তার ওপর নির্ভর করে, তুমি কোথায় গিয়ে উঠবে। তুমি যদি সোজা গর্ত করো, তবে পেরুর কাছে দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের সমুদ্রপৃষ্ঠে ভেসে উঠবে তুমি।
সূত্র: সায়েন্স এক্সপ্লোরার ডটঅর্গ ও স্পেস ডটকম