রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে যা ঘটেছিল

প্রথম প্রতিরোধের স্মৃতি নিয়ে তৈরি হয়েছে রাজারবাগ পুলিশ স্মৃতি জাদুঘর।ছবি: ডিএমপি

২৫ মার্চ ১৯৭১। রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ঢাকায় গণহত্যা শুরু করে। আর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ওই রাতেই শুরু হয় প্রথম প্রতিরোধ লড়াই। পুলিশ সদস্যরা সামান্য থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়েই প্রাণপণ লড়েছিলেন ভারী অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।

কী ঘটেছিল রাজারবাগে? এমন প্রশ্ন নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত কনস্টেবল মো. শাহজাহান মিয়ার মুখোমুখি হই। তাঁর বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার বাট্টা গ্রামে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের ওয়্যারলেস অপারেটর ছিলেন তিনি।

তাঁর ভাষায়, ২৫ মার্চ, রাত তখন ৮টা ৩০ মিনিট। খবর আসে, ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি আর্মিরা আসছে। সবাই বিভিন্ন জায়গায় পজিশনে চলে যায়। আমি আর মনির ওয়্যারলেস বেজ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণে থাকি, প্রশাসন ভবনের নিচতলায়।

রাত তখন ১০টা ৩০ মিনিট। তেজগাঁও এলাকায় প্যাট্রোলে থাকা ওয়্যারলেস অপারেটর আমিরুল মেসেজ দেন।

বলেন, ‘চার্লি সেভেন ফর বেজ, হাউ ডু ইউ হেয়ার মি? ওভার।’

আমি প্রত্যুত্তরে বলি, ‘বেজ ফর চার্লি সেভেন, ইউ আর লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার, সেন্ড ইয়োর মেসেজ, ওভার।’

তখন তিনি বলেন, ‘চার্লি সেভেন ফর বেজ, অ্যাবাউট থার্টি সেভেন ট্রাকস লোডেড উইথ পাকিস্তানি আর্মি আর প্রসিডিং টুওয়ার্ডস ঢাকা সিটি ফ্রম দ্য ক্যান্টনমেন্ট।’

নিশ্চিত হই। আর্মিরা আসছে।

রাত আনুমানিক ১১টা ৩০ মিনিট। প্রথমে পাকিস্তানি আর্মির বহর শান্তিনগর পার হয়ে চামেলীবাগের ব্যারিকেডের সামনে এসে থামে। ব্যারিকেড সরাতে ১০-১২ জন গাড়ি থেকে নামতেই ডন স্কুলের ছাদ থেকে পুলিশ সদস্যরা থ্রি নট থ্রি রাইফেলে গুলি চালায়। প্রথম টার্গেটেই পাকিস্তানি সেনাদের দুজন মারা যায়। আহত হয় বেশ কয়েকজন। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর ওটাই ছিল প্রথম আঘাত, যা শুরু করেছিলেন পুলিশ সদস্যরাই।

গোলাগুলি চলছে। হঠাৎ পাশের বিল্ডিংয়ে কামানের একটা গোলা এসে পড়ে। ফলে বিদ্যুৎ চলে যায়। টেলিফোন লাইনও কাটা।

এসব অস্ত্র দিয়েই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল পুলিশ বাহিনী।
ছবি: সাজিদ হোসেন

কী করা যায়, ভাবছি। আক্রান্ত হওয়ার খবরটি সারা দেশে জানাতে পারলে হয়তো অনেকেই আত্মরক্ষা করতে পারবে—এ চিন্তা থেকেই একটি ওয়্যারলেস বার্তা ট্রান্সলেট করে সারা পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোর প্রস্তুতি নিই।

রাত ১২টা বাজতে তখনো তিন-চার মিনিট বাকি। রাজারবাগে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের প্রথম ওয়্যারলেস বার্তায় আমি বলি, ‘Base for all station of East Pakistan police, very very important message for you, keep note, keep listening, watch. We are already under attacked by Pak army, try to save yourself, over and out.’

ওই রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত কনস্টেবল মো. আবু শামাও। কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার পিরপুর গ্রামে বাড়ি তাঁর। ওই রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে অস্ত্রাগারের ডিউটিতে ছিলেন তিনি।

আরও পড়ুন

সেখানে কতজন পুলিশ সদস্য ছিলেন? এমন প্রশ্ন দিয়েই তাঁর সঙ্গে শুরু হয় আলাপচারিতা। আবু শামা বললেন যেভাবে, স্পেশাল আর্মড ফোর্সে ছিলেন সাড়ে পাঁচ শর মতো পুলিশ সদস্য। তাঁরা থাকতেন তত্কালীন চারতলা বিল্ডিংয়ে। আর আড়াই শ থেকে তিন শর মতো সদস্য ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান প্রভিন্সিয়াল রিজার্ভ ফোর্সে (ইপিপিআরএফ)। চারটি টিনশেড ব্যারাকে থাকতেন এই ফোর্সের সদস্যরা। ইস্ট পাকিস্তানের বৃহত্তম পুলিশ লাইনস ছিল রাজারবাগ। যেখানে বাঙালি সদস্য ছিলেন সবচেয়ে বেশি। আর এ কারণে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই রাজারবাগকে টার্গেট করেছিল।

ওই রাতের কথা তিনি তুলে ধরেন এভাবে, ‘২৫ মার্চ সন্ধ্যার ঠিক পরের ঘটনা। ম্যাগাজিন ঘাটে তখনো পাকিস্তানের চাঁদতারা পতাকা উড়ছিল। আমরা “জয় বাংলা” ও “বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো” স্লোগান তুলে ওই পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিই।

১ / ৪
পুলিশে থাকাকালীন কনস্টেবল আবু শামাছবি: তার পারিবারিক অ্যালবাম থেকে নেওয়া

‘রাতে ক্যান্টনমেন্ট থেকে আর্মি আসার খবর আসতেই সেন্ট্রি পাগলা ঘণ্টি পেটায়। নিচতলায় ছিল দুটি অস্ত্রাগার। তখন অস্ত্রাগারে চলে যাই। একটা অস্ত্রাগার চাবি দিয়ে খুলে দিই। চাবি না থাকায় শাবল দিয়ে আরেকটা অস্ত্রাগারের তালাও ভেঙে ফেলি। ভেতরের অস্ত্রগুলো তখন যে যার মতো নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পজিশন নেয়। আর অবাঙালি সদস্যরা সন্ধ্যার আগেই পালিয়ে যান। শুধু সুবেদার বদরুদ্দিন খান অবাঙালি হয়েও আমাদের পক্ষে ছিলেন।’

গোলাগুলি শুরু হলে কনস্টেবল শাহজাহান মিয়া ও আবু শামারা পজিশন নেন মূল ভবনের ছাদে। রাত সাড়ে ১২টার পর রাজারবাগে পাকিস্তানি সেনারা ট্যাংক, রকেট লঞ্চার ও হেভি মেশিনগান দিয়ে আক্রমণ করে। ফলে টিনশেডের ব্যারাকগুলোয় আগুন লেগে যায়। জীবন বাঁচাতে ভেতর থেকে পুলিশ সদস্যরা দৌড়ে বের হলে ওরা ব্রাশফায়ার করে। ফলে বহু পুলিশ সদস্য শহীদ হন।

আবু শামা বলেন, ‘ফজরের আজানের পর পাকিস্তানি আর্মিরা ১ ও ২ নম্বর গেট দুটি ভেঙে ভেতরে ঢোকে। আসে ১০টি খালি ট্রাকও। এক থেকে দেড় শ পুলিশের লাশ পড়ে ছিল। ওরা তা ট্রাকে তুলে সরিয়ে ফেলে।

‘পরে ছাদে উঠে টেনেহিঁচড়ে নামায় আমাদের। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, রাস্তায় ফেলে ক্রলিংও করায়। একটা ময়লার ড্রেনে পড়ে ছিল আমাদের ক্যানটিন বয়। বয়স ১৩ বা ১৪ হবে। আর্মিরা তাকে তুলে পিচঢালা রাস্তায় এনে আছড়ায়। মুখ ফেটে রক্ত বেরোচ্ছিল তার। ছেলেটা কাঁপতে কাঁপতে বলছে “পানি! পানি!”। এক পাকিস্তানি আর্মি প্যান্টের জিপার খুলে তার মুখে প্রস্রাব করে দেয়। এমন নির্মমতা দেখে বুকের ভেতরটা খামচে ধরে। মানবতা প্রতিমুহূর্তে পদদলিত হয়েছে রাজারবাগে!’

আরও পড়ুন

দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবার শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘আমাদের ওপরও নির্মম টর্চার চলে। ভাবিনি বেঁচে থাকব। ২৮ মার্চ বিকেলে ঢাকার তত্কালীন পুলিশ সুপার ই এ চৌধুরী এলে আমাদের তাঁর জিম্মায় দেওয়া হয়। পরে মিল ব্যারাকে রিপোর্ট করার কথা ছিল। কিন্তু তা না করে তিন-চার দিনে হেঁটে চলে যাই গ্রামের বাড়িতে। পরে অংশ নিই মুক্তিযুদ্ধে।’

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনারা এ দেশে যে সীমাহীন গণহত্যা চালিয়েছে, তার জন্য বিন্দুমাত্র দুঃখ প্রকাশ বা ক্ষমা চায়নি দেশটির কোনো সরকার। পাশাপাশি স্বাধীন বাংলাদেশে এত বছরেও রাজারবাগের প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেওয়া কোনো পুলিশ সদস্যকেই দেওয়া হয়নি স্বাধীনতা পুরস্কারের মতো রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মান, যা প্রত্যাশিত ছিল। তবু একাত্তরে পুলিশের প্রথম প্রতিরোধ লড়াই ও আত্মত্যাগের ইতিহাস প্রজন্মকে উজ্জীবিত করবে—এমনটা আশা আমাদের।

আরও পড়ুন