বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে বর্তমানে বাংলাদেশের ছয় ঋতুকে তিন ঋতু বলাই ভালো—গ্রীষ্ম, বর্ষা আর শীত। জলবায়ু পরিবর্তনের দরুন ঋতুগুলোর উপসর্গও তীব্র-হাড়কাঁপানো শীত, মুষলধারে বৃষ্টি এবং কাঠফাটা রোদ্দুর। এই জানুয়ারি মাসে যখন খুলনা গেলাম, তখন হাড়কাঁপানো শীতকে আরও একবার হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। আমি আর আমার দুই বান্ধবী, শামাইলা ও উপমা গিয়েছিলাম খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলায় ঘুরতে। সেই ধারাবাহিকতায় গিয়েছিলাম বাগেরহাট জেলার ‘ষাটগম্বুজ’ মসজিদ দেখতেও।
ভোরে ঘুম থেকে আড়মোড়া ভেঙে উঠতেই শামাইলা বলল, ‘বাগেরহাট নিয়ে গুগলে কী কী তথ্য আছে, দেখ তো।’ গুগলে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে গিয়ে এই জেলা নিয়ে ঐতিহাসিক ঘটনার ছড়াছড়ি দেখে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ! জেলার নামকরণের ঘটনা দিয়েই শুরু করি। অনেকে বলেন, পাশেই সুন্দরবন থাকায় আগে থেকে এলাকায় বাঘের উপদ্রব বলে ‘বাঘেরহাট’ থেকে বাগেরহাট এসেছে। আবার অনেকের মতে, এই জেলার নামের প্রতিষ্ঠাতা সুফি সাধক খান জাহান আলী (র.) দিয়েছিলেন ‘খলিফাত-ই-আবাদ’। ‘আবাদ’ মানে বাগান, সেখান থেকেই বাগেরহাট। তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য জনশ্রুতি হলো, শহর ঘেঁষে প্রবাহিত ভৈরব নদের উত্তর দিকের হাঁড়িখালী থেকে বর্তমান নাগের বাজার পর্যন্ত এক লম্বা বাঁক অবস্থিত। বাঁকের পুরোনো বাজার এলাকায় ‘বাঁকেরহাট’ নামে এক হাট বসত, সেই থেকেই বাগেরহাট নামকরণ।
গুগল দেখতে দেখতে শামাইলা আর উপমাকে বললাম, ‘এই শহরের আনাচকানাচে বিভিন্ন মসজিদ আছে। প্রকৃতিতে যেমন জীববৈচিত্র্য, এই শহরে তেমন বিভিন্ন রকমের স্থাপত্যকলার মসজিদের বৈচিত্র্য।’
শুনে উপমা বলল, ‘তাহলে তো আমাদের আরও সময় নিয়ে আসা উচিত ছিল। এক দিনে কতগুলোই-বা ঘুরতে পারব!’ ‘তা বটে!’ শামাইলা একমত।
খুলনার ফুলবাড়ী বাসস্ট্যান্ড থেকে বাগেরহাটগামী এক বাসে চড়ে বসলাম আমরা তিন বন্ধু। দুই ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছেও গেলাম। বাস থেকে নামতে না নামতে হাইওয়ের পাশে দেখি এক মসজিদ। ফলকে নাম লেখা, ‘সিঙ্গাইর মসজিদ’ বা এক গম্বুজ মসজিদ। চারপাশে লাল ইটের পিলারের ওপর বিশাল এক গম্বুজ, মসজিদের এক কোনায় এক বৃদ্ধ গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আছেন। আমরা এই মসজিদ দেখেই নিজেদের মধ্যে আলাপ করতে থাকলাম ষাটগম্বুজ মসজিদ কোথায়, কাকে জিজ্ঞাসা করে জানা যাবে। এক গম্বুজের পাশে বসে থাকা বৃদ্ধ নিশ্চয়ই আমাদের আলোচনা শুনছিলেন, হাইওয়ের অপর পাশে আঙুল তাক করে বললেন, ‘এই যে ওইখানে ষাটগম্বুজ মসজিদ।’ আমরা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, আসলেই রাস্তার ওপাশে একটি মসজিদের অবয়ব দেখা যাচ্ছে।
টিকিট কেটে ষাটগম্বুজ মসজিদে ঢুকে আমি আর উপমা কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলাম না। কী সুন্দর এক মসজিদ, কী তার বিশালতা! শামাইলা এর আগে এই মসজিদ দেখতে এসেছিল, আমাদের দেখে হেসে বলল, ‘আমি জানতাম তোরা এমন “এক্সপ্রেশন”ই দিবি!’
সুফি সাধক খান জাহান আলী বাংলায় গমন করার পর সুন্দরবন এলাকার কিছু জংলা জায়গা পরিষ্কার করে সেখানে বাগেরহাট জেলার গোড়াপত্তন করেন। জীবদ্দশায় তিনি বাগেরহাটে প্রচুর মসজিদ, ইমারত, সেতু, জলাশয়, রাস্তা, সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন, তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বাগেরহাট মসজিদ, যেটি ১৯৮৫ সালে ইউনেসকোর ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের’ তালিকায় স্থান করে নেয়। ইট দিয়ে তৈরি এই মসজিদের অভ্যন্তরের দৈর্ঘ্য ১৬০ ফুট ও প্রস্থ ১০৮ ফুট। আভিধানিকভাবে ‘ষাটগম্বুজ’ অর্থ ৬০টি গম্বুজসংবলিত হলেও মসজিদটিতে গম্বুজের সংখ্যা ছিল ৮১।
মসজিদের বিশাল গম্বুজ ও ৬০টি স্তম্ভ সম্ভবত একে ‘ষাট খামবাজ’ (খামবাজ অর্থ স্তম্ভ) হিসেবে জনপ্রিয় করে তোলে, যা পরবর্তী সময় শাব্দিক বিবর্তনের মাধ্যমে মসজিদটিকে ‘ষাটগম্বুজ’ হিসেবে পরিচিত করে তুলেছে।
আমি আর উপমা এত সুন্দর জায়গা পেয়ে একটার পর একটা ছবি তুলতে থাকলাম। শামাইলা মসজিদটি হেঁটে হেঁটে প্রদক্ষিণ করছিল। একপর্যায়ে আমাদের ওপর বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কি ভাই, তোরা কি এখানে শুধুই ছবি তোলার জন্য আসছিস? একটু ঘুরে ঘুরে দেখ, মসজিদটা একেক দিক থেকে একেক রকম।’
আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম, আসলেই তা-ই!
একটু দূরে গিয়ে লাফ দিয়ে দিয়ে গম্বুজগুলো দেখার চেষ্টা করলাম, ইটরাঙা গম্বুজগুলোকে দেখাচ্ছে উল্টে রাখা মাটির কলসের মতো।
এক অনন্ত সবুজ ঘাসের মাঠের মধ্যে মসজিদটি নির্মিত। সবুজের মাঝে লাল ইটের বিরাট স্থাপনাটিকে একদম বাংলাদেশের পতাকার মতো লাগছে!