মানুষ বনাম এআই
২০১৫ সালের কথা। আমি কেবল উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ক্লাস করতে শুরু করেছি। তখনই প্রথম তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়টির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সেখানে পাঠ্যবইয়ের প্রথম অধ্যায়টিতে নতুন একটি ধারণার সঙ্গে পরিচিত হই—বিশ্বগ্রাম। সে সময় পুরোপুরি বুঝিনি, আজ বুঝি। ইন্টারনেটের জগৎটি আমাদের দেশ, কালের সীমানা ছাড়িয়ে নতুন একটি জগৎ তৈরি করেছে। পুরো বিশ্ব মিলে সেখানে তৈরি হয়েছে একটি গ্রাম—বিশ্বগ্রাম।
এই বিশ্বগ্রামের নাগরিক আমরা সবাই। আমরা ফেসবুক চালাই, গুগল ব্যবহার করি, ইউটিউব দেখে পড়াশোনা করি, বিনোদনের নানান মাধ্যমে দিনের একটি বড় অংশ কাটাই। বিশ্বগ্রাম থেকে ভিন্ন, আলাদা একটি দেশে বাস করছি, এ রকম ধারণা তাই বিভ্রান্তিকর।
এই বিশ্বগ্রামে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার শুরু হয়েছে অনেক আগেই। কত আগে, সেটা শুনলে একটু চমকেই যেতে হয়। প্রথম চ্যাটবট ‘এলিজা’ তৈরি করা হয় ১৯৬৬ সালে। তবে এটি খুব বেশি দূর কথাবার্তা এগোতে পারত না। তোমরা কেউ যদি বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘ইয়াং শেলডন’ দেখে থাকো, তাহলে নিশ্চয়ই ছোট্ট শেলডনকে এলিজার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে দেখেছ। ধারাবাহিকভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসংশ্লিষ্ট উদ্যোগগুলোর তালিকা দেওয়া এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। তাই ওতে আমরা যাব না।
পুরো পৃথিবী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে সচকিত হয়ে উঠেছে গত বছরের নভেম্বরে। প্রথমে ২০২২ সালের মার্চে মিডজার্নি টেক্সট বা বাক্য থেকে নির্দেশনা অনুযায়ী চমৎকার ছবি বানিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। পরের চমকটি দেখিয়েছে চ্যাটজিপিটি, গত নভেম্বরে। শুধু কথোপকথন বা প্রশ্নের জবাবই নয়, চ্যাটজিপিটি বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে প্রয়োজনীয় বিষয় তুলে আনতে পারে গুছিয়ে। বিশ্লেষণ করতে পারে, সম্ভাব্য সিদ্ধান্ত দিতে পারে। সেই সঙ্গে আইনি বা সংবেদনশীল বিষয়ের ক্ষেত্রে সতর্কবার্তা হিসেবে সত্যিকার আইনজীবীর সঙ্গে আলোচনার পরামর্শও দেয় নিয়ম মেনে। বিষয়টা সেখানে থেমে যায়নি। বরং এত দিন ধরে চলমান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণায় একটা বিস্ফোরণ ঘটেছে। প্রযুক্তিবিজ্ঞানীরা নানা রকম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মডেল তৈরি করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন। এখন সেগুলো একে একে বাজারে ছাড়তে শুরু করেছে প্রযুক্তিপণ্যের প্রতিষ্ঠানগুলো। গুগল যেমন সুন্দর করে গুছিয়ে নিবন্ধ বা আর্টিকেল লেখার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আনছে। বেশ কিছু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন স্ক্রিপ্ট লিখে দিলে, সেটাকে সুন্দরভাবে ভিডিও বানিয়ে দিতে পারে। যেমন সিন্থেশিয়া। ব্ল্যাক বক্স নামের একটা সার্ভারে প্রয়োজনীয় প্রায় সব কোড পাওয়া যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে সেটা জুড়ে দিয়ে যেকোনো ওয়েবসাইট বা অ্যাপ বানিয়ে ফেলা সম্ভব। ই-মেইল লিখতে হবে? কোথাও ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা? কোন জায়গায় বিনিয়োগ করলে ভালো হবে, জানতে চাও? মোটামুটি সবকিছুর জন্যই চলে এসেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
বিনোদনের সবচেয়ে বড় উৎস যুক্তরাষ্ট্রের হলিউড। সেখানকাল শিল্পীরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার নিয়ে আন্দোলন করছেন। কারণ, এই ব্যবহারের কারণে অনেকের চাকরি চলে যেতে বসেছে। ২০১৯ সালে মুক্তি পেয়েছে স্টার ওয়ার্স: দ্য রাইজ অব স্কাইওয়াকার। এ চলচ্চিত্রে ক্যারি ফিশারের মৃত্যুর পর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাপ্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে তাঁর ছবি। কিন্তু এটাও নতুন নয়। চলচ্চিত্রে কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজারি বা সিজিআইর ব্যবহার বহুল প্রচলিত। ২০১৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ফিউরিয়াস সেভেন চলচ্চিত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে মৃত্যুর পর পল ওয়াকারকে দেখানো হয়েছে। সম্প্রতি ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যান্ড দ্য ডায়াল অব ডেস্টিনিতে এ প্রযুক্তির মাধ্যমে দেখা গেছে তরুণ হ্যারিসন ফোর্ডকে। মানুষ এসব ছবি দেখেছেন, উপভোগও করেছেন।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশেও এর হাওয়া লেগেছে ভালোভাবেই। অনেকেই মিডজার্নি দিয়ে গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ করছেন, চ্যাটজিপিটি দিয়ে লিখছেন নিবন্ধ। চ্যানেল ২৪ সম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ‘অপরাজিতা’কে দিয়ে খবরও পড়িয়েছে, সম্প্রচার করেছে সরাসরি। কাজে কাজেই বিদেশের পাশাপাশি বাংলাদেশেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে ভয়ংকর উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই অনিশ্চয়তাবোধ কতটা যৌক্তিক? বিষয়টা পর্যালোচনা করে দেখার জন্য আমরা প্রথমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কী, সেটা একটু সহজভাবে জানার চেষ্টা করি।
দুই
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানে কিন্তু রোবট নয়; বরং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলতে বোঝানো হয় কিছু অ্যালগরিদমকে। অ্যালগরিদম কী? কীভাবে একটি কাজ ধাপে ধাপে করতে হবে, সেটার একটা পদ্ধতি। এসব অ্যালগরিদমকে প্রচুর পরিমাণে তথ্য দেওয়া হয়। বলে দেওয়া হয়, এসব তথ্য থেকে কীভাবে বিভিন্ন বিষয়, যেমন মানুষের আচরণ বিশ্লেষণ করে সে অনুযায়ী ফলাফল বের করে নিতে হবে। সেটাই করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এসব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ভয়ংকর দেখতে রোবটের ভেতর যেমন পুরে দেওয়া যায়, তেমনি আমাদের কম্পিউটার বা মুঠোফোনেও স্বাভাবিকভাবে এটি নানা কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। গুগলের বর্তমান ডকে যেমন নিবন্ধ লেখার কাজে ব্যবহারযোগ্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পুরে দেওয়া হয়েছে। চ্যাটজিপিটি বা মিডজার্নির কথা তো আগেই বলেছি। এগুলোর মতো করেই চলচ্চিত্রে, সংবাদ পাঠে কিংবা অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
এ নিয়ে উদ্বেগ মূলত দুটি। একটি হলো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি একসময় মানুষের মতোই বুদ্ধিমান ও স্বাধীন হয়ে উঠবে? তখন কি এটি নিজের ইচ্ছানুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে? এ রকম বুদ্ধিমত্তা কি মানুষের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলে দেবে না? এই উদ্বেগের জ্বালানি হিসেবে লেখা হয়েছে একাধিক বিজ্ঞান কল্পগল্প, তৈরি হয়েছে অসংখ্য চলচ্চিত্র। বারবার দেখানো হয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দখল করে ফেলছে পুরো পৃথিবী।
সেটা যদি না–ও হয়, দ্বিতীয় দুশ্চিন্তাটি হলো, মানুষের হাতে এর নিয়ন্ত্রণ থাকলেও এর কারণে কি অনেক মানুষ চাকরি হারাবেন না? চিত্রশিল্পী বা সংবাদ পাঠক কিংবা সৃজনশীল লেখকের কি আর মূল্য থাকবে?
এই দুটো উদ্বেগ নিয়ে আমরা একটু বাস্তব চিন্তা থেকে আলোচনা করব। শুরুটা করা যাক দ্বিতীয়টি দিয়ে।
২০০০ সালের শুরুর দিকের কথা তোমাদের কারও হয়তো মনে থাকার কথা নয়। কিন্তু সে সময়ের কথা যাঁদের মনে আছে, তাঁদের জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবে। মানুষ তখন মুভি দেখতে সিডি কিনত। অনেক দোকানেই টাইপিস্ট থাকতেন, তাঁরা বিভিন্ন লেখা টাইপ করে দিতেন। পাসপোর্ট সাইজ ছবির জন্য মানুষ স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তুলে আসতেন। এ রকম আরও অনেক কাজের সুযোগ ছিল সে সময়। এসব চাকরি বা কাজ এখন আর নেই। প্রযুক্তির কল্যাণে এগুলো আজ বিলুপ্ত। শুধু কিশোর-তরুণেরাই নন, বয়স্ক ব্যক্তিরাও আজকাল কিছু টাইপ করতে এখন আর দোকানে যান না। ছবি তোলার জন্য এখন ভালো স্মার্টফোনের ক্যামেরাই যথেষ্ট। অনেক কিছুর জন্য এখন আর সহকারীর প্রয়োজন পড়ে না। ডাক বিভাগের সেবা অনেকাংশে অচল হয়ে গেছে। কারণ, মানুষ এখন ই-মেইল বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যোগাযোগ করেন।
কথা হলো, এই যে আমরা এখন কম্পিউটার ব্যবহার করছি, মুঠোফোন ও অন্যান্য প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে সহজ করে দিয়েছে, এটা কি খারাপ? তুমি হয়তো বলবে, না, মোটেও খারাপ নয়। আবার তোমার মা–বাবা বা আগের প্রজন্মের মানুষেরা হয়তো প্রযুক্তির এই পরিবর্তন এখনো ঠিক মেনে নিতে পারেননি। তাঁদের স্মৃতিচারণায় উঠে আসবে রেডিওর সোনালি সময়ের কথা, চিঠি পাঠানো বা পাওয়ার আনন্দের কথা। কিন্তু আমাদের মেনে নিতে হবে প্রযুক্তির এই পরিবর্তনকে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে অনেক চাকরি হয়তো বিলুপ্ত হবে, কিন্তু নতুন অনেক চাকরির সুযোগও তৈরি হবে। এখন কথা হলো, কোন কোন চাকরি বিলুপ্ত হতে পারে? দুই ধরনের চাকরি বা কাজের সুযোগ। এক, নির্দিষ্ট কিছু ধাপে করা যায়, এ রকম কাজের সুযোগ। যেমন অনেক ডেটা থেকে ফোন নম্বর খুঁজে বের করে, সেটার তালিকা তৈরি করা। কিংবা হিসাবরক্ষক। অথবা সংবাদ পাঠকের কাজ। (কেউ হয়তো ভাবতে পারেন, মানুষ না পড়লেও কি কেউ সংবাদ শুনবেন? শুনবেন। ক্যারি ফিশার বা পল ওয়াকারের ছবির মতো বাস্তব, জীবন্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যার আচরণে যান্ত্রিকতা প্রকট নয়, এ রকম হলে মানুষ শুনবেন। এটা এসব চলচ্চিত্র উপভোগের বিষয়টি থেকেই স্পষ্ট।) এ রকম কাজ যাঁরা করেন, তাঁদের চাকরিগুলো হয়তো ভবিষ্যতে থাকবে না। এটা এখন অনেকে মানতে না পারলেও ধীরে ধীরে মেনে নেবেন। কারণ, এর বিপরীতে অনেক চাকরি তৈরি হবে। যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে হিসাব রাখা এবং প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ের লাভজনক কাজ খুঁজে বের করা। কিংবা ইতিমধ্যেই যেমন বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে, চ্যাটজিপিটি দিয়ে আর্টিকেল লিখতে পারেন, এমন মানুষ নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। ধরাবাঁধা এ রকম নতুন নানা ধরনের চাকরির খাত তৈরি হবে। মানুষ এসব খাতে দক্ষ হবেন। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা যেমন থাকবে, তেমনি হয়তো একাডেমিকভাবে শেখার সুযোগও তৈরি হবে কিছুদিনের মধ্যেই।
এখানে প্রসঙ্গত আমরা উল্লেখ করতে পারি, বড় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোও ইতিমধ্যেই ডেটা সায়েন্স ব্যবহারের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা, মানুষ কী চান এবং সে অনুযায়ী সেবা দেওয়া—ইতিমধ্যেই এভাবে পরিচালিত হতে শুরু করেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। গবেষণাগারে বিজ্ঞানীরা বিশ্লেষণধর্মী কাজের জন্য ব্যবহার করছেন মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম, অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এআই ব্যবহৃত হচ্ছে সাধারণ জামাকাপড় বিক্রি থেকে শুরু করে পণ্যের ডিজাইন করা কিংবা সঠিক ক্রেতা খুঁজে বের করার কাজে। এই বাস্তবতার হাওয়া তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় জোরেশোরে এসে লাগলেই আমরা সেটায় অভ্যস্ত হয়ে উঠব। বাংলাদেশের মানুষ যথেষ্ট মেধাবী। যথাযথ প্রশিক্ষণ পেলে আমাদের কিশোর-তরুণেরা এসব কাজ পারবেন। কাজেই এটা আসলে খুব বড় সমস্যা নয়।
দ্বিতীয় ধরনের কাজের সুযোগ নিয়েই বড় সমস্যা। সৃজনশীলতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দক্ষ হয়ে উঠলে মানুষের সৃজনশীলতার কী হবে? চ্যাটজিপিটি যদি অসাধারণ গল্প লেখে, তাহলে মানবলেখকেরা কি টিকতে পারবেন? মিডজার্নি দিয়ে ইতিমধ্যেই অনেকে তৈরি করছেন গ্রাফিকস। কাজের সুযোগ হারাচ্ছেন শিল্পীরা। চলচ্চিত্রের মতো বড় শিল্পেও অনেক মানুষের কাজ ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। এর সমাধান কী?
প্রথম কথা হলো, টুল হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বহুল প্রচলিত হয়ে গেলে সবার কাছেই এটি থাকবে। তখন কেউ বেশি সুযোগ পাবেন, আর কেউ কম—বিষয়টা এ রকম থাকবে না। বরং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হবে একটা টুল। এই বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে একজন দক্ষ শিল্পী আরও ভালো ছবি আঁকতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে তিনি হয়তো এআই দিয়ে ছবি বানিয়ে, নিজে সেটা খানিকটা সম্পাদনা করবেন। একজন দক্ষ শিল্পীর ভাবনা, সে অনুসারে সম্পাদনা শিল্পী নন—এমন কারও ভাবনার সঙ্গে কি পাল্লা দিতে পারবে?
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নীতিমালা। ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ (ইউরোপীয় ইউনিয়ন) আরও অনেক দেশ এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছে। মিডজার্নি দিয়ে আমি যদি লেওনার্দো দা ভিঞ্চির মতো করে একটা ছবি আঁকি, সেটার স্বত্ব কার? মিডজার্নির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মিডজার্নি ইনকরপোরেটেডের নাকি আমার, যেহেতু নির্দেশনা আমি দিয়েছি। নাকি দা ভিঞ্চির? কারণ, তাঁর আকার ধরন অনুকরণ করে এটা বানানো হয়েছে। এগুলো নিয়ে শিগগিরই নীতিমালা তৈরি হবে। এ নীতিমালা কেমন হবে, আমরা এখনো জানি না। তবে মানুষের অধিকার রক্ষাই যে এতে প্রাধান্য পাবে, তা বলা বাহুল্য।
তবু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নামের টুলটি অনেকের চাকরির ক্ষতি করবে। এ ক্ষেত্রে বাস্তব উপায় দুটি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নামের প্রযুক্তিটিকে বাক্সে বন্দী করে রাখা। জেনেও এর অস্তিত্বের কথা না জানার ভান করা। বাস্তবে এমনটা সম্ভব নয়। তবে দ্বিতীয়টি সম্ভব—আমাদের এতে দক্ষ হতে হবে। আজ যেমন ফটোশপ বা ইলাস্ট্রেটরের মতো যন্ত্র ব্যবহার করে শিল্পীরা ছবি আঁকেন, একসময় তাঁরা সেটা আঁকবেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করে। তাঁদের মেধা-মনন-চিন্তাশীলতা নিঃসন্দেহে এতে ফুটে উঠবে। কাজেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তাঁদের কাজের সুযোগ পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবে, অতীত ইতিহাস সে কথা বলে না।
মানুষের নিজস্ব সৃজনশীলতার আবেদন যুগে যুগে বরাবরই ছিল। বর্তমান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের আবেগ বুঝতে পারে না। অযৌক্তিক ধারণা বুঝতে পারে না। হয়তো ভাবছ, অযৌক্তিক ধারণা আবার কী? ধরো, আগামীকাল তোমার পরীক্ষা। কিন্তু তোমার খুব ভালো কোনো বন্ধু অনেক দিন পর তোমার এলাকায় এসেছে। সে তোমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে একসঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর। সম্ভাবনা আছে, যৌক্তিক কাজ—অর্থাৎ পড়াশোনা বাদ দিয়ে তুমি অযৌক্তিক কাজটিই করবে—ঘুরে বেড়াবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখনো এসব বোঝে না। কোনো দিন যদি এটি বুঝতেও পারে, মানুষের মতো কি পারবে? সে জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের মতো হয়ে যাবে, এ ধারণা এখনো যৌক্তিক ধারণা হয়ে ওঠেনি।
তা ছাড়া আজকের যন্ত্রনির্ভর সভ্যতায় কাপড়চোপড় কিংবা এ ধরনের সব পণ্যই যন্ত্র দিয়ে বানানো যায়, কিন্তু হাতে বোনা কাপড়, হাতে বানানো বিভিন্ন পণ্যের আবেদন কি ফুরিয়ে গেছে? যায়নি। বরং অনেক দামে এগুলো বিকোয়। মানুষের কাছে এই আবেদন থাকবে চিরকাল, অন্তত ইতিহাস আমাদের তা–ই বলে।
এখন আমরা প্রথম সমস্যাটিতে ফিরে যাই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি মানুষের মতো স্বাধীন হয়ে উঠবে? দখল করে নেবে পৃথিবী? বিষয়টা বোঝার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ধরন-ধারণ নিয়ে একটুখানি আলোচনা করা প্রয়োজন।
তিন
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মূলত তিন প্রকার। এক. আর্টিফিশিয়াল ন্যারো ইন্টেলিজেন্স বা ন্যারো এআই। বাংলায় বলা যেতে পারে দুর্বল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। দুই. আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স বা এজিআই। এটাকে বাংলায় শক্তিশালী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলা যেতে পারে। আর তিন. আর্টিফিশিয়াল সুপার ইন্টেলিজেন্স বা সুপার এআই। বাংলায় বলা যায়, অতিশক্তিশালী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। প্রথমটি, অর্থাৎ দুর্বল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার আমরা প্রতিদিনই করছি। যেকোনো মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম, যেটি নিজে থেকে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারে প্রশিক্ষিত তথ্যানুযায়ী, এগুলোকে এ ভাগে ফেলা যেতে পারে। ফেসবুক যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিশিষ্ট অ্যালগরিদম ব্যবহার করে আমাদের বিভিন্ন পোস্ট দেখায়, অ্যামাজন বা ইউটিউব যে বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে পণ্য বিক্রির বিজ্ঞপ্তি দেখায়—সেগুলো সবই এর মধ্যে পড়ে। তৃতীয়টি, অর্থাৎ অতিশক্তিশালী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমরা শিগগিরই তৈরি করতে পারব, এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত বা প্রমাণ নেই। বরং দ্বিতীয় পর্যায়ে পৌঁছাতে পারব কি না, এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
এজিআই বা শক্তিশালী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরিতে অনেকখানি এগিয়ে গেছে মানুষ। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ২০৫০ সালের মধ্যেই এ ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি হতে পারে। তবে টার্মিনেটর চলচ্চিত্রের মতো সেটি আত্মসচেতন হয়ে উঠবে কি না, তা বলা মুশকিল।
কথা হলো, এ রকম আত্মসচেতন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি পৃথিবীটা দখল করে নেওয়ার চেষ্টা করবে? এখানে যে বিষয়টা খুব ভালোভাবে বোঝা প্রয়োজন, তা হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজে নিজে কতটা শিখবে, কতটুকু বুদ্ধির খেলা দেখাবে, তা–ও প্রযুক্তিবিজ্ঞানীরা কোড করে বলে দেন। অর্থাৎ এ ধরনের বুদ্ধিমত্তা হবে মানুষচালিত। সেটা কত দূর কী করবে, তা মানুষই ঠিক করে দেবে। স্বাভাবিকভাবেই, এ ধরনের বুদ্ধিমত্তা যেন ক্ষতিকর হয়ে না ওঠে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নীতিমালা ও তার সঠিক প্রয়োগ সেটা নিশ্চিত করতে পারে। তবু সব প্রযুক্তিরই ভালো–মন্দ দিক থাকে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে আমরা ভালো কাজে ব্যবহার না করে মন্দ কাজে ব্যবহার করলে? কিংবা কেউ ইচ্ছা করে এ ধরনের বুদ্ধিমত্তাকে যদি লাগামহীনভাবে উন্নত করে তোলে? মানুষের নিরাপত্তার যদি তোয়াক্কা না করে?
যুগে যুগে কিছু দুষ্ট মানুষ বারবার মানবসভ্যতার এ রকম ক্ষতি করতে চেয়েছেন। প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞানীরা এ ধরনের ক্ষতি মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়েছেন বারবার। শুধু প্রস্তুতি নয়, মোকাবিলাও করেছেন। আমরা শুধু আশা করতে পারি, কেউ যদি অমনটা করেনও, বিজ্ঞানীরা মানবসভ্যতার পাশে থাকবেন। এ ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নিয়ন্ত্রণের উপায় নিশ্চয়ই তাঁরা বের করবেন। যে বিজ্ঞানীদের অবদানে সভ্যতা এত দূর এগিয়ে এসেছে, যাঁদের হাত ধরে মানুষ মহাকাশে অভিযান চালাচ্ছে, মহামারির মতো রোগের সমাধান করেছেন যাঁরা নিজ প্রচেষ্টায়, তাঁরা নিশ্চয়ই এ সভ্যতাকে কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়া এ রকম বিপদের মুখে ঠেলে দেবেন না। অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এ ক্ষেত্রেও একটি টুল বা যন্ত্র হিসেবে কাজ করবে, পারমাণবিক শক্তির মতো। মানুষই নিশ্চিত করতে পারে, এর ব্যবহার কেমন হবে। এ ক্ষেত্রেও লড়াইটা তাই মানুষের সঙ্গে মানুষের। খারাপ মানুষের সঙ্গে ভালো মানুষের। আমরা ভালো মানুষ হব, মানুষের ভালোর জন্য কাজ করব।
আমাদের আলোচনা তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নীতিমালা ও এর সঠিক প্রয়োগে এসে থামবে। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, এ নীতিমালা যেন সবার অধিকার রক্ষা করে। আর সেটার সঠিক প্রয়োগ যেন হয়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মানুষের বানানো বুদ্ধিমত্তা—তা সে যত উন্নতই হোক, অবশ্যই মানবসৃষ্ট প্রযুক্তিনির্ভর (শুধু সফটওয়্যারই নয়, হার্ডওয়্যারও)। কাজেই এ ধরনের বুদ্ধিমত্তা মানুষের নিয়ন্ত্রণের পুরোপুরি বাইরে চলে যাবে, এ ধরনের ভাবনা আসলে এখনো যৌক্তিক নয়। মানুষ যা বোঝে না, তা ভয় পায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিতে আমাদের কিশোর-তরুণেরা যখন দক্ষ হয়ে উঠবে, আশা করা যায়, এই ভয়টা তখন আর থাকবে না।
তবু ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা, জীবিকার অনিশ্চয়তা আমাদের আচ্ছন্ন করতে পারে। সেটাই স্বাভাবিক। এ অনিশ্চয়তা যুগে যুগে নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে বারবার এসেছে। বর্তমানে এটি প্রকট হয়ে উঠেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাত ধরে। আরও বেশি প্রকটভাবে এটা বোঝা যাচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের দেশে। কিন্তু এ ধরনের অনিশ্চয়তার মোকাবিলা করেই মানুষ এগিয়েছে। আমরাও এগোতে পারব। শুধু অবহেলা না করে বা এড়িয়ে না গিয়ে আমাদের প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে উঠতে হবে। আর মনে রাখতে হবে, আমরা বিশ্বগ্রামের নাগরিক। আমাদের প্রতিযোগিতা করতে হবে বিশ্বের সবার সঙ্গে। সবাই মানে, মানুষ—দক্ষ মানুষ। এআই নয়।
এআই একটি টুল বা যন্ত্র। এই যন্ত্রকে আমাদের ব্যবহার করতে হবে ভালোর জন্য। তাই ম্যান ভার্সেস ম্যান বা ম্যান ভার্সেস এআই নয়, মানুষের জন্য এআই। মানুষের জন্য প্রযুক্তি।