এক দিন পরই বুদ্ধপূর্ণিমা। আকাশে বিশাল থালার মতো চাঁদ। তার রুপালি আলোয় চকচক করছে তুষারে আবৃত চারপাশ। এই মধ্যরাতে বাবর আলী তৈরি হচ্ছেন আরেকটি ৮ হাজার মিটার উচ্চতার লোৎসে পর্বত জয়ের উদ্দেশ্যে। দুঃসাহিক অভিযানে বেরিয়ে পড়ার সময় একবার কি চাঁদের আলোয় নিজেকে হারিয়ে ফেললেন বাবর?
একদিন আগে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছেন বাবর আলী। ফেরার পথে তুষার ঝড়ে পড়েছিলেন। ঝড় সামলে নিচে নামতে নামতে শরীরের ওপর বেশ ধকল গেছে। এই ক্যাম্প ৪–এ (এভারেস্টচূড়া থেকে যা মাত্র ৯০০ মিটার নিচে) পৌঁছে বিশ্রাম নিয়েছেন কিছুটা। শরীরে যখন বল ফিরে পেলেন, তখন তৈরি হচ্ছেন নতুন অভিযানের জন্য।
বাবরের সঙ্গে আছেন তাঁর শেরপা বন্ধু বীর বাহাদুর তামাং। বছর দুয়েক আগে আমা দাবলাম পর্বত অভিযানেও তামাংকে সঙ্গে পেয়েছিলেন। পার্বত্য পথে এমন বন্ধুর মতো শেরপা পাওয়া ভাগ্য বটে।
তাঁবু থেকে দুজন বেরিয়ে পড়েন। জমাট বাঁধার মতো শীত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এত উচ্চতায় অক্সিজেনের পরিমাণ খুবই কম। তাই পর্বতারোহীরা অতিরিক্ত অক্সিজেনের সহায়তা নেন। গত এক দিনে বাবর তা নেননি। বাড়তি অক্সিজেন–সুবিধা ছাড়াই টিকে থাকার চেষ্টা করেছেন। বোঝার চেষ্টা করলেন পোড়–খাওয়া অভিযাত্রীরা কীভাবে বাড়তি অক্সিজেন ছাড়া এভারেস্ট অভিযান করেন। বাবর অবশ্য সেই পরীক্ষায় পাস করেছেন।
১৮ মে মাঝরাতে আবারও শুরু হয় বাবরের যাত্রা। ১৯ মে ভোরের প্রথম আলোয় ২৯ হাজার ৩১ ফুট উচ্চতার মাউন্ট এভারেস্টের শীর্ষে ওড়ান বাংলাদেশের পতাকা।
২০ মে মধ্যরাতে লোৎসেচূড়া অভিমুখে পথ ধরেন বাবর ও বীর বাহাদুর তামাং। চাঁদের আলোর মধ্যেও দুজনের মাথায় জ্বলছে হেডলাইট। পথ চলতে চলতে দুজন পেছন ফিরে দেখে নেন পাশের এভারেস্টকে।
লোৎসে পর্বতের খাড়া গায়ে উঠতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। আগের দিনের ক্লান্তি আর নিদ্রাহীন রাত দুজনকে খুব ভোগাল। তবু একটু একটু করে এগিয়ে গেলেন জগতের চতুর্থ উচ্চতম পর্বতের দিকে। আকাশ ফরসা হতে শুরু করল। বাবরেরা তখন পৌঁছে গেলেন সংকীর্ণ গিরিখাতে। সেটাও পার হলেন দক্ষতার সঙ্গে। একপর্যায়ে উঠে গেলেন এমন এক উচ্চতায়, যেখান থেকে আর উঁচুতে ওঠা যায় না!
হিমালয়ের দিনকাল
বাবর আলী বাংলাদেশ থেকে নেপালের যান ১ এপ্রিল। কাঠমান্ডুতে প্রস্তুতিমূলক কাজ করেন। তিন দিন পরই সেখান থেকে চলে যান লুকলার তেনজিং-হিলারি বিমানবন্দরে। পৃথিবীর অন্যতম বিপজ্জনক বিমানবন্দর এটি। লুকলায় নেমে হাঁটাপথ। যে পথে শত কিংবদন্তি পর্বতারোহীরা পথ চলেছেন। হিমালয়ের এই পার্বত্য পথে হেঁটে ১০ এপ্রিল বাবর পৌঁছে যান এভারেস্টের বেজক্যাম্পে।
এভারেস্ট অভিযানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো অ্যাক্লামাটাইজেশন বা উচ্চতার সঙ্গে শরীরকে খাপ খাওয়ানো। এ জন্য বেজক্যাম্পে অবস্থান করে অভিযাত্রীরা আরও উঁচু কোনো পর্বতে ঘুরে আসেন। বাবর আলীও একাধিকবার উচ্চতায় ওঠানামা করেন। ২৬ এপ্রিল বেজক্যাম্প থেকে ক্যাম্প–২ পর্যন্ত ঘুরে এসে শেষ করেন উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পর্ব।
এরপর শুরু হয় চূড়ান্ত অভিযানের দীর্ঘ অপেক্ষা। আবহওয়াসহ নানা বিষয় বিবেচনা করে এভারেস্টে অভিযান পরিচালিত হয়। ১৪ মে মাঝরাতে বেজক্যাম্প থেকে বাবরের যাত্রা শুরু হয় চূড়া অভিমুখে। ১৫ মে সকালে পৌঁছে যান ক্যাম্প ২-এ। পরিকল্পনা অনুযায়ী, সেখানে দুই রাত কাটিয়ে বাবর উঠে যান ক্যাম্প ৩–এ। সেখান থেকে ১৮ মে পৌঁছান ক্যাম্প ৪-এ। ২৬ হাজার ফুট উচ্চতার এই ক্যাম্পের ওপরের অংশকে বলা হয় ‘ডেথ জোন’।
১৮ মে মাঝরাতে আবারও শুরু হয় বাবরের যাত্রা। ১৯ মে ভোরের প্রথম আলোয় ২৯ হাজার ৩১ ফুট উচ্চতার মাউন্ট এভারেস্টের শীর্ষে ওড়ান বাংলাদেশের পতাকা।
বই পড়ে হিমালয়ের প্রেমে
বাবর আলী তখন স্কুলে পড়েন। হাতে এসেছিল সমরেশ মজুমদারের গর্ভধারিণী। উপন্যাসটি পড়তে পড়তে প্রথম হিমালয়ের সঙ্গে পরিচয় তাঁর। বইয়ের পাতার বর্ণনায় মনে মনে পাহাড়ি গ্রামের ছবি আঁকেন বাবর আলী। মনের চোখে দেখে ফেলেন কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ চূড়াও।
স্কুল–কলেজ পেরিয়ে তখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্র বাবর। স্বপ্নও বড় হয়েছে তত দিনে। হুটহাট ছুটে যান বান্দরবানের পাহাড়ে। একবার সাকা হাফং অভিযানে পরিচয় তাঁরই মতো আরও কয়েকজন উদ্যমী তরুণের সঙ্গে। সবার বাড়ি চট্টগ্রামে। এই শহরে তখন কোনো পর্বতারোহণবিষয়ক ক্লাব ছিল না। বাবরেরা ভাবলেন একটা ক্লাব তো খুব জরুরি। তাঁদের সঙ্গে মিলে শুরু করলেন ‘ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স’ নামে পর্বতারোহণ ক্লাব।
বাংলাদেশিদের এভারেস্ট অভিযান
মাউন্ট এভারেস্টে প্রথম অভিযান পরিচালিত হয় শতাধিক বছর আগে। ব্রিটিশ সরকার পরিচালিত সেই জরিপ অভিযানটি ছিল ১৯২১ সালে। এর মাধ্যমেই মাউন্ট এভারেস্টে মানুষের সাফল্য-ব্যর্থতার গল্পগাথা শুরু। ১৯৫৩ সালের ২৯ মে নেপালের শেরপা তেনজিং নোরগেকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছিলেন নিউজিল্যান্ডের পর্বতারোহী এডমন্ড হিলারি। তাঁদের পথ ধরে শত শত রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষ গেছেন এভারেস্ট অভিযানে। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্টের শীর্ষে ওঠেন মুসা ইব্রাহীম। এরপর ২০১১ ও ২০১২ সালে দুবার এভারস্ট জয় করেন এম এ মুহিত। প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে ২০১২ সালের এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করেন নিশাত মজুমদার। একই বছর ওয়াসফিয়া নাজরীনও জয় করেন এভারেস্ট। ২০১৩ সালে এভারেস্টজয়ী পঞ্চম বাংলাদেশি সজল খালেদ এভারেস্টচূড়া থেকে নেমে আসার সময় মারা যান। এর ১১ বছর পর এভারেস্টের চূড়ায় বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা ওড়ালেন বাবর আলী।
এই ক্লাব থেকেই হিমালয় অভিযান যেতে থাকেন বাবরেরা। একে একে ভারতের ইয়ানাম পর্বত, চেমা, ফাব্রাং, ফ্রেন্ডশিপ পিক, কাং ইয়াৎসে-২ অভিযান করেন। ২০১৭ সালে বাবর ভর্তি হন ভারতের উত্তর কাশীর ‘নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং’য়ে। এখান থেকেই মৌলিক পবর্তারোহণ কোর্স সম্পন্ন করেন। এরপর নেপালে কেয়ানজিন রি, সারগো রি আর সুরিয়া দিয়ে শুরু করে অভিযান করেন টেন্ট পিক, মেরা পিক, লবুচে ইস্ট, চুলু ইস্ট, চুলু ফার-ইস্ট, আমা দাবলাম।
পর্বতারোহণ তার নেশা হলেও সাইক্লিং, ম্যারাথন, স্কুবা ডাইভিংয়ের মতো অ্যাডভেঞ্চার কার্যক্রমে নিয়মিত জড়িত ছিলেন বাবর আলী। রোমাঞ্চের টানে পায়ে হেঁটে ঘুরেছেন দেশের ৬৪ জেলা। সেই গল্প লিখেছিলেন কিশোর আলোতেও। সাইকেলে পাড়ি দিয়েছেন ভারতের কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীর পথ। এরপরই প্রস্তুতি নিতে থাকেন এভারেস্ট অভিযানের।