বাংলা ভাষার শক্তি
পৃথিবীতে ভাষা আছে সাত হাজারের ওপরে। এর মধ্যে অন্তত তিন হাজার ভাষা এমন, যেগুলো শুধু কথা বলার কাজে ব্যবহার হয়। সেসব ভাষায় কিছু লেখা হয় না। আর যেসব ভাষায় লেখা হয়, তাদের সবগুলোর নিজের বর্ণমালা নেই। এদিক থেকে বাংলা ভাষার শক্তি অনেক। বাংলা ভাষায় কথাও বলা যায়, লেখাও যায়।
আবার বাংলা বর্ণমালা পৃথিবীর সবচেয়ে সাজানো বর্ণমালা। এখানে স্বর আর ব্যঞ্জন আলাদা করে ভাগ করা। ইংরেজি বর্ণমালায় দেখো, স্বর আর ব্যঞ্জন একসঙ্গে মেলানো। বাংলা বর্ণমালার ব্যঞ্জনগুলো আবার গুচ্ছে গুচ্ছে সাজানো। প্রথম সারিতে আছে কণ্ঠ্য ধ্বনি, তারপর একে একে তালব্য ধ্বনি, মূর্ধন্য ধ্বনি, দন্ত্য ধ্বনি ও ওষ্ঠ্য ধ্বনি। ব্যঞ্জনের মধ্যে ঘোষ-অঘোষ ধ্বনিও আলাদা করা। আলাদা করে সাজানো অল্পপ্রাণ-মহাপ্রাণ ধ্বনিও। নাসিক্য ধ্বনিগুলোও নির্দিষ্ট অবস্থানে সাজানো।
কেউ কেউ মনে করে, এত বর্ণের দরকার কী। ইংরেজি ভাষায় তো ২৬টা বর্ণ দিয়ে দিব্যি কাজ চলছে। তাদের জন্য বলি, বেশি বর্ণ থাকার সুবিধাও আছে। আমরা প্রায় সব ধরনের উচ্চারণ বাংলায় লিখতে পারি। কিন্তু ইংরেজিতে অ, খ, ঘ, ঙ, ছ, ঝ, ঠ, ঢ, ত, থ, দ, ধ, শ, ড়, ঢ়, ং—এ রকম অনেক ধ্বনি লেখার জন্য কোনো বর্ণ নেই।
আবার উচ্চারণের ব্যাপারটা খেয়াল করে দেখো। ছোটবেলা থেকে আমরা সব ধরনের ধ্বনি উচ্চারণে অভ্যস্ত হয়ে যাই। তাই টাকাকে ‘টাকা’ বলতে পারি, তবলাকে ‘তবলা’ বলতে পারি। কিন্তু পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ আমাদের মতো এত সুন্দর করে সব ধ্বনি উচ্চারণ করতে পারে না। যেমন জাপানিরা টাকাকে বলে ‘তাকা’, ইংরেজরা তবলাকে বলবে ‘টবলা’। মানে একদল মানুষ মূর্ধন্য ধ্বনিতে দুর্বল, আরেক দল দন্ত্য ধ্বনিতে দুর্বল। পৃথিবীর বেশির ভাগ ভাষার মানুষের নানা ধরনের উচ্চারণ দুর্বলতা আছে। যেমন ইংরেজরা শব্দের শেষের ‘র’ উচ্চারণ করতে পারে না। আবার ‘র’ ও ‘ল’ ধ্বনি আলাদা করতে পারে না অনেক ভাষার মানুষ।
বর্ণ আর ধ্বনির বাইরে বাংলা ভাষার আরেক ধরনের শক্তি আছে। বাংলা ভাষায় সব ধরনের লেখালেখির কাজ করা যায়। বাংলা ভাষায় দলিল লেখা যায়, সংবাদ প্রকাশ করা যায়, বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা যায়। আরও কত রকম কাজ যে করা যায়, তার ইয়ত্তা নেই। সব ভাষার এই লেখালেখির সুবিধা নেই, সেটা তো শুরুতেই বলেছি। তা ছাড়া বাংলা ভাষায় উচ্চতর জ্ঞানচর্চারও সুযোগ রয়েছে।
বাংলা ভাষার আরেকটি শক্তির জায়গা এর বৈচিত্র্যপূর্ণ সাহিত্য। হাজার বছরের বেশি সময় ধরে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা হচ্ছে। এই দীর্ঘ সময়ে বাংলা ভাষায় বিচিত্র ধরনের সাহিত্য লেখা হয়েছে। এসব লেখা বিশ্বের যেকোনো ভাষার সাহিত্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার জয় করে তার প্রমাণও রেখেছেন।
এখন মুশকিল হলো, যে ভাষা এত শক্তিশালী, সে ভাষার প্রতি আমরা বড় উদাসীন। অথচ এই ভাষার জন্য রক্ত দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিতে বাংলার মানুষ আন্দোলন করেছে। একুশে ফেব্রুয়ারির সেই বেদনাদায়ক ঘটনার পর ৭২ বছর পার হলো। মাঝখানে ‘বাংলা’ নামে একটি দেশও প্রতিষ্ঠা হলো। অথচ দেশের সব কাজে এখনো বাংলা ভাষা পুরোপুরি চালু করা সম্ভব হয়নি। এটা আমাদের সবার ব্যর্থতা। প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে শিক্ষাজীবনের পুরোটা সময় বাংলা ভাষায় পাঠ গ্রহণের সুযোগ থাকা দরকার। অফিস-আদালতেও বাংলা ব্যবহার করা দরকার।
যেসব জায়গায় বাংলা ব্যবহার হয়, সেখানেও নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। যেমন বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড দিন দিন কমতে শুরু করেছে। কমতে শুরু করেছে সাইনবোর্ডে বাংলা নামের দোকানও। এমনকি বাংলায় লেখা বিয়ের দাওয়াতপত্রও কমতে শুরু করেছে। কারও কারও ধারণা, এ ধরনের লেখালেখি ইংরেজিতে করলে এগুলোর ‘মূল্য’ বাড়ে। মূল্য বাড়ে মানে মানুষের কাছে গুরুত্ব বাড়ে।
বাংলা বলার ক্ষেত্রেও আমাদের সমস্যা আছে। আমরা সুন্দর করে বাংলা বলতে পারি না কিংবা চাই না। অঞ্চলভেদে নানা রকম ভাষা থাকতে পারে। তবে আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা ব্যবহার করা ঠিক নয়। তার মানে স্কুল-কলেজে, অফিস-আদালতে, রেডিও-টেলিভিশনে কথা বলার সময়ে প্রমিত ভাষা ব্যবহার করতে হয়।
বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে আমাদের হীনম্মন্যতাও আছে। যে কারণে কাউকে ইংরেজি বলতে শুনলে আমরা সংকুচিত হয়ে যাই। মনে হয়, ওর মতো করে আমি কেন বলতে পারি না। এমনকি কেউ যদি ইংরেজি-বাংলা মিলিয়ে কথা বলে, তবে আমরাও তার সামনে ইংরেজি-বাংলা মিলিয়ে কথা বলতে চেষ্টা করি। অথচ তারই হীনম্মন্যতায় ভোগার কথা—যে বাংলা বলতে পারে না কিংবা বাংলা বলতে গিয়ে অকারণে ইংরেজি মিশিয়ে ফেলে।
অনেক কাজে আমাদের ইংরেজিতে কথা বলতে হয়, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তা ছাড়া বর্তমান পৃথিবীতে পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইংরেজি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভাষা। সুতরাং ইংরেজি বলার চেষ্টা বা অভ্যাস আমাদের করা উচিত। কিন্তু বাংলা ভুলে ইংরেজিতে কথা বলায় কোনো গৌরব নেই। আর ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে কথা বলা পুরোপুরি বাদ দেওয়া উচিত।
কখনো কখনো দুই ভাষা মিশিয়ে কথা বলার প্রয়োজন হতে পারে, সেটা বিশেষ ক্ষেত্রে। যেমন ধরা যাক, জার্মানির মানুষজন ব্যবসার কাজে নিয়মিত ফ্রান্সের কোনো এলাকায় যায়। জার্মানির এই লোকগুলো ঠিকমতো ফরাসি ভাষা জানে না। আবার ফ্রান্সে যে এলাকায় তারা যায়, সেখানকার লোকজন ঠিকমতো জার্মান ভাষা জানে না। অথচ ব্যবসা করার জন্য তাদের কথা তো বলতে হবে! এ অবস্থায় অনেক দিন ধরে যাওয়া-আসার কারণে তাদের মধ্যে একধরনের ভাষা-যোগাযোগ তৈরি হয়। তারা একটু ফরাসি আর একটু জার্মান মিশিয়ে পরস্পর কথা বলতে থাকে। এর ফলে যে বিশেষ ধরনের খিচুড়ি ভাষা তৈরি হয়, তার নাম ‘পিজিন’।
দীর্ঘদিন ধরে পিজিন ভাষা ব্যবহারের ফলে আরেকটা ব্যাপার ঘটে। হয়তো কোনো এলাকায় বছরের পর বছর ধরে পিজিন ভাষা চলছে। তখন তাদের বংশধরেরা সেই পিজিনকেই মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এমন ক্ষেত্রে এই মাতৃভাষার নাম হয় ‘ক্রেয়ল’। ক্রেয়ল ভাষার ব্যাকরণ হয় সাধারণ, শব্দভান্ডার থাকে কম। তা ছাড়া পিজিন বা ক্রেয়লে বিশেষ সাহিত্যচর্চাও হয় না। পিজিন ও ক্রেয়ল নানা কারণে দুর্বল ভাষার নমুনা। এসব ভাষার বিশেষ বর্ণমালাও নেই।
পিজিন আর ক্রেয়ল বিশেষ প্রয়োজনে তৈরি হয়। অর্থনৈতিক বা সামাজিক বিশেষ যোগাযোগের প্রয়োজনে ব্যবহার হয় এমন ভাষা। এভাবে বাংলা ভাষার সঙ্গে আরেক ভাষার মিশ্রণে পিজিন বা ক্রেয়ল তৈরি হতেই পারে। তবে অকারণে ভাষার মিশ্রণ ঘটালে ভাষা দুর্বল হতে থাকে।
আরেকটা ভয়ের কথা বলি। কোনো ভাষা অন্য ভাষার প্রভাবে পুরোপুরি ধ্বংসও হয়ে যেতে পারে। যেমন পর্তুগালের ভাষা পর্তুগিজ। পর্তুগালের মানুষ একসময়ে ব্রাজিলে এসে শাসন করা শুরু করেছিল। তখন ব্রাজিলের প্রধান ভাষা হয়ে যায় পর্তুগিজ। আর ব্রাজিলের আগের ভাষাগুলো নিজেদের শক্তি হারিয়ে ফেলে। একইভাবে স্পেনের ভাষা হিস্পানি। স্পেনের মানুষ আর্জেন্টিনায় এসে শাসন করা শুরু করলে আর্জেন্টিনার প্রধান ভাষা হয়ে যায় হিস্পানি। আর আর্জেন্টিনার স্থানীয় ভাষাগুলো তাদের জায়গা হারিয়ে ফেলে।
তবে আমাদের বাংলা ভাষার শক্তি অনেক। ২০০ বছরের ইংরেজ শাসনের পরেও ইংরেজি ভাষা বাংলা ভাষার জায়গা দখল করতে পারেনি। বাংলা ভাষা মুখের ভাষা, লেখার ভাষা হিসেবে সগৌরব টিকে আছে অন্তত হাজার বছর ধরে। এখন ভবিষ্যতে বাংলা ভাষার শক্তি আরও বাড়াতে চাইলে এ ভাষার ব্যবহার আরও বাড়াতে হবে।