দুই দিন পরেই পয়লা বৈশাখ। এ মাসের শুরুতে কিছু বিষয় প্রতিবারই আলোচনা হয়। যেমন পান্তাভাত আর ইলিশ মাছ। পান্তা-ইলিশ ছাড়া যেন পয়লা বৈশাখ পূর্ণ হয় না।
পান্তা আমাদের দেশের মানুষ বহুকাল ধরেই খায়। প্রচলিত বেশ কিছু গল্প আছে পান্তা খাওয়া নিয়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘পান্তাবুড়ির কথা’। ১৯৬৪ সালে তিনি ছোটদের জন্য লেখেন ‘টুনটুনির বই’। বইটা কিছু গল্পের সংকলন। এখানেই আছে পান্তাবুড়ির গল্প। এই গল্প এমনই জনপ্রিয়, শিশুরা এখনো এই গল্প ইউটিউবে কার্টুন আকারে দেখে। মায়েরা শিশুদের এই গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ান।
গল্পটা এক বুড়িকে নিয়ে, যিনি পান্তাভাত খেতে খুব ভালোবাসতেন। তবে চোর এসে বুড়ির পান্তা খেয়ে ফেলছিল। ফলে বুড়ির ঘোর বিপদ। পছন্দের পান্তা চোর খেয়ে ফেলায় বুড়িকে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে বুড়ি লাঠিতে ভর দিয়ে যাচ্ছিল রাজার কাছে নালিশ করতে। রাজার বাড়িতে যাওয়ার পথে প্রথমে বুড়ির দেখা হয় শিং মাছের সঙ্গে। এরপর বেল, এক টুকরা গোবর, সবশেষে একটা ক্ষুরের সঙ্গে বুড়ির দেখা হয়। যেটির সঙ্গেই দেখা হয়, সেটিই জিজ্ঞেস করে, ‘বুড়ি কোথায় যাচ্ছ’? বুড়ি বলে, ‘চোর আমার পান্তা খেয়ে যায়, রাজার বাড়ি যাচ্ছি নালিশ করতে।’ শিং মাছ, বেল, গোবর ও ক্ষুর পান্তাবুড়িকে বলে, ‘আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে যেয়ো, কাজে লাগবে।’
বুড়ি রাজার বাড়িতে গিয়ে দেখে, রাজা বাড়িতে নেই। ফেরার সময় বুড়ির মনে পড়ল শিং মাছ, বেল, গোবর আর ক্ষুর সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কথা। বুড়ি এগুলো সঙ্গে করে বাড়ি ফিরে এল।
বাড়িতে এসে শিং মাছ বুড়িকে বলে, ‘আমাকে পান্তার ভেতরে রেখে দাও।’
বেল বলে, ‘আমাকে চুলার ভেতরে রেখে দাও।’
গোবর বলে, ‘আমাকে রাখো বসার পিঁড়িতে।’
ক্ষুর বলে, ‘আমাকে রাখো ঘাসে।’
কথামতো বুড়ি শিং মাছকে পান্তার ভেতরে, বেল চুলায়, গোবর পিঁড়িতে আর ক্ষুরটাকে ঘাসের মধ্যে রেখে দেয়। এদিকে চোর আসে পান্তা খেতে। যেই পান্তার ভেতরে চোর হাত দিল, অমনি শিং মাছ দিল কাঁটা বিঁধিয়ে। কাঁটার যন্ত্রণায় চোর যায় চুলার আগুনে হাত সেঁকে নিতে। অমনি চুলার আগুনের তাপে বেল যায় ফেটে। বেশ আঘাত পায় চোর। দৌড়ে পালাতে গিয়ে পিঁড়িতে রাখা গোবর যায় চোরের পায়ে লেগে। বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড। সেই গোবর মুছতে চোর যখনই উঠানের ঘাসের কাছে যায়, পা যায় কেটে। একদম রক্তারক্তি। এভাবে সাজা পায় চোর।
বলছিলাম, গল্পটা ছোটদের অনেক প্রিয়। বৈশাখ এলে পান্তাভাতের সঙ্গে গল্পটা আলোচিত হয়।
বৈশাখের প্রথম দিন সকালে আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার প্রচলন আছে। শখ করে মানুষ পান্তা–ইলিশ খায়। তবে কৃষক বা গ্রামের দিকে মানুষ এখনো সকালে পান্তা খায়। পান্তা খেতে খুব মজা। গরমে পান্তা খেলে শরীর ঠাণ্ডা থাকে। প্রশ্ন হলো, ভাতের বদলে পান্তা কেন খায় মানুষ?
পান্তা এসেছে ভাত সংরক্ষণের প্রয়োজনে। যে বাসায় ফ্রিজ নেই, সেখানে ভাত কেমন করে সংরক্ষণ করা হবে? ভাত যেহেতু বাংলাদেশ ও আশপাশের অঞ্চলের প্রধান খাবার, আবার এই অঞ্চলে গরমও খুব বেশি। তাই ভাত রাতে খেয়ে সকালের জন্য রেখে দিলে সকাল হওয়ার আগেই পচে যায়। ভাত যেন না পচে, এ কারণেই অনেক যুগ ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে ভাতে রাতের বেলা পানি দিয়ে রাখার প্রচলন তৈরি হয়েছে।
আবার সকালে যেহেতু রান্না করা ঝামেলা, আবার দ্রুতই কিছু খেয়ে মাঠে যাওয়া প্রয়োজন। এভাবে এসেছে পান্তা। ফ্রিজ থাকুক বা না থাকুক, বাংলাদেশি অনেকেই সকালে পান্তা খেতে পছন্দ করেন। আর বৈশাখ এলে তো পান্তা খাওয়া ঐতিহ্যের মধ্যে পড়ে।
পরিষ্কার পানির নিচে ভাত থাকায় ভাত ঠাণ্ডা থাকে, অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসে না। ফলে ব্যাকটেরিয়া ভাতকে পচিয়ে ফেলতে পারে না।
ভাতে পানি থাকায় ভাতের ফারমেন্টেশন বা গাজনপ্রক্রিয়া দ্রুততর হয়। ফলে ভাতের মধ্যে থাকা কার্বোহাইড্রেট ভেঙে যায়। এভাবে ভাতে পানির সংযোগ হওয়ায় ভাত ভালো থাকে।
মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া প্রতিযোগিতার ফাইনালে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নারী কিশোয়ার চৌধুরী পান্তাভাত তৈরি করেছিলেন। সেবার খুব আলোচনা হয়েছিল। এমন প্রতিযোগিতায় পান্তা নিয়ে আসা ছিল অবিশ্বাস্য। দর্শক চমকে গিয়েছিল এ ঘটনায়।
পান্তা নিয়ে গবেষণাও হয়েছে। ভারতের আসাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি জৈব প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. মধুমিতা বড়ুয়া একটি গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছিল এশিয়ান জার্নাল অব কেমিস্ট্রিতে। এর উদ্দেশ্য ছিল, পান্তাভাতে কী আছে এবং পান্তার উপাদানগুলো শরীরের জন্য উপকারী না অপকারী, সেগুলো খুঁজে বের করা। কী কী উপকার বা অপকার হতে পারে তাঁরা তা বের করেছেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, পান্তাভাতে সাধারণ ভাতের চেয়ে বেশি পরিমাণে পুষ্টিকর খনিজ উপাদান রয়েছে। আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, জিংক, ফসফরাস ও ভিটামিন বি পান্তাভাতে বেশি থাকে।
তাই বৈশাখে তো আমরা পান্তা খাবই, গরমের সময়ও সকালে দু–একবার পান্তা খেয়ে দেখতে পারো খেতে কেমন লাগে।
সূত্র: উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘টুনটুনির বই’ (১৯৬৪) এবং বিবিসি বাংলা