স্বপ্নে দেখা পরীক্ষায় লিখতে পারি না কেন

সিফাতের (ছদ্মনাম) কলেজে প্রথম বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা সামনেই। দিন-রাত মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। রাত জেগে পড়াশোনা করে। কিন্তু পরীক্ষার দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই যেন দুশ্চিন্তা পেয়ে বসছে সিফাতের মনে।

এরই মধ্যে একদিন হঠাৎই নিজেকে পরীক্ষার হলে দেখতে পায় সিফাত। পরীক্ষার টেবিলে তার সামনে গণিতের প্রশ্ন। কিন্তু সে জানে, আজ পরিসংখ্যান পরীক্ষা। সেই মতোই প্রস্তুতি তার। আর গণিতের কোনো প্রশ্নই তার কমন পড়েনি। এদিকে সময় চলে যাচ্ছে, কিন্তু সে কোনো প্রশ্নেরই উত্তর লিখতে পারছে না। ভয়ে-কষ্টে দরদর করে ঘামছে। পরীক্ষায় ফেল করার ভয়ে কাঁদছে। এমন সময় হঠাৎ তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। বিছানা থেকে ধড়মড় করে উঠে দেখে, তার শরীর ঘামে ভেজা, মাথায় তীব্র ব্যথা। সে বুঝতে পারে, এটি আসলে স্বপ্ন ছিল।

পরীক্ষা নিয়ে এমন ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন শুধু সিফাত নয়, পরীক্ষার আগে আগে যে কেউ দেখতে পারে। এমনকি তোমাদেরও কারও কারও এমন অভিজ্ঞতা থাকতে পারে। কিন্তু ঠিক পরীক্ষার আগে আগে বা পরীক্ষার আগের রাতে এমন দুঃস্বপ্ন দেখার কারণ কী হতে পারে?

এ বিষয়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির স্লিপ মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এবং ঘুম ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কলিন এস্পি বলেন, ‘আমরা ঘুমিয়ে থাকলেও আমাদের মস্তিষ্ক জেগে থাকে। তখন মস্তিষ্ক আমরা যা শিখেছি, তা সংরক্ষণ, স্মৃতি তৈরি এবং আমাদের আবেগকে প্রক্রিয়াকরণে ব্যস্ত থাকে। মস্তিষ্ক আউটপুটও তৈরি করে, যা আমরা স্বপ্ন হিসেবে জানি।’

পরীক্ষা নিয়ে স্বপ্ন দেখা আমাদের পরীক্ষার বিষয়ে ‘আশ্বস্ত’ করতে সাহায্য করে। এর মাধ্যমে আমরা না জেনেও অনেক কিছু শিখতে পারি বলে জানিয়েছেন কলিন এস্পি। তিনি বলেন, ‘পরীক্ষার আগে রাতের স্বপ্নের মাধ্যমে মস্তিষ্ক আসলে পরীক্ষা বিষয়ে সতর্ক করে দেয়। স্বপ্নে দেখা প্রশ্নগুলোর বিষয়ে প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দেয়। আরও মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করার কথা বলে। তবে এর মানে এটা নয় যে দিনে পড়াশোনা করা যাবে না। কারণ, আমরা যা শেখার চেষ্টা করছি, মস্তিষ্ক কেবল সেই বিষয়গুলোকেই একীভূত করতে পারে।’

আমাদের জীবনে তো সারা দিন অনেক কিছুই ঘটে থাকে। তাহলে স্বপ্নে কেন শুধু পরীক্ষা আসে, এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক কলিন এস্পি বলেন, ‘হুমকি বা সতর্ক করে দেওয়ার মতো করে যেকোনো কিছুর স্বপ্ন দেখা একটি সাধারণ বিষয়। হুমকি দেওয়া বা সতর্ক করার মানে এই নয় যে এটি খারাপ। তবে এর অর্থ হতে পারে, এটি চ্যালেঞ্জিং। সেটা পরীক্ষা হোক আর যা-ই হোক না কেন, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।’

আরও পড়ুন

মার্কিন ম্যাট্রেস অ্যান্ড বেডিং কোম্পানি আমেরিস্লিপ আমেরিকার দুই হাজার নাগরিকের ওপর একটি জরিপ পরিচালনা করেছে। ওই জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, জরিপে অংশ নেওয়া ৩৪ শতাংশই এমন অপ্রস্তুত বিষয়ে স্বপ্ন দেখেছেন।

কলিন এস্পি বলেন, ‘অনেকে আছে, যারা পরীক্ষার বিষয়ে অতটা সতর্ক নয়। দিনের বেলা যা পড়েছি, তা রাতে মনে থাকাটা বিস্ময়ের কোনো বিষয় নয়।’ তাঁর মতে, পরীক্ষার স্বপ্ন দেখা খুবই সাধারণ। প্রত্যেকেরই এ রকম স্বপ্ন থাকে, যদিও তারা সব মনে রাখতে পারে না।

স্লিপ মেডিসিনের এই অধ্যাপক আরও বলেন, অনেকেই আছে, পরীক্ষা নিয়ে এমন স্বপ্ন দেখার পরও সচেতন হয় না। অনেকে এমন স্বপ্ন দেখে ভেঙে পড়তে পারে। কেউ কেউ মাঝেমধ্যে এমন স্বপ্ন দেখতে পারে; আবার কেউবা প্রতি রাতেই এমন স্বপ্ন দেখতে পারে।

এদিকে যুক্তরাজ্যের লেখক ও স্বপ্ন-বিশেষজ্ঞ ডেলফি এলিস বলেছেন, পরীক্ষা-সংক্রান্ত স্বপ্ন সরাসরি মানসিক চাপের সঙ্গে সম্পর্কিত। অতীতে পরীক্ষা নিয়ে কোনো মানসিক চাপ অনুভব করলে তারই প্রতিফলন হতে পারে রাতে এ-সংক্রান্ত স্বপ্ন দেখা। স্বপ্ন মূলত ওই ব্যক্তিকে কিছু সময়ের জন্য সেই চাপের মুহূর্তে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।

আরও পড়ুন

কলিন এস্পির সুরে ডেলফি এলিসও বলেছেন, ‘স্বপ্নের মূলত আরেকটু গভীরে গিয়ে ওই বিষয় সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করার সম্ভাবনা থাকে। বিষয়গুলো সম্পর্কে আমরা সচেতন কি না, উন্নতির আরও চেষ্টা করছি কি না, স্বপ্ন মূলত আমাদের সেসব বিষয়েই কিছু একটা বলার চেষ্টা করে।’

আবেগময় স্বপ্ন

১৯ বছর বয়সী জুহাল প্রায়ই স্বপ্ন দেখে যে সে কোথাও দেরি করে যাচ্ছে। জুহাল বলেছে, ‘সময় চেক করার জন্য আমার অ্যালার্ম বেজে ওঠার আগে দুই বা তিনবার ঘুম থেকে জেগে উঠি। তখন মনে হয় আমার আরও এক ঘণ্টা ঘুমানো দরকার, কিন্তু তা আমি পারছি না।’

কলিন এস্পি বলেছেন, এর ব্যাখ্যাও ‘বেশ সহজ’। তিনি বলেন, ‘আপনি যখন ঘুমিয়ে আছেন, তখনো আপনি সময় বলতে পারেন। তখন কাছে স্মার্টফোন, এমনকি ঘড়িও থাকে না।’

দুঃস্বপ্ন হলো আবেগঘন স্বপ্ন। এটা এমন একটি বিষয়, যা ঘুমানোর সময় আমাদের অনুভূতিগুলো প্রক্রিয়া করা হয় বলে জানিয়েছেন কলিন এস্পি। তিনি বলেন, কেউ কেউ বছরের পর বছর দেরি করতে পারে, যার মধ্যে পরীক্ষাও আছে। এসব ঘটনা এলোমেলোভাবে ঘটতে পারে। আর মস্তিষ্ক বিষয়গুলোকে শ্রেণিবদ্ধ করে।

পরীক্ষা নিয়ে এমন দুঃস্বপ্ন দেখা কি বন্ধ করা সম্ভব? এ ক্ষেত্রে কলিন এস্পির পরামর্শ হলো, যদি সত্যি সত্যিই সামনে পরীক্ষা থাকে, তাহলে নিয়মিত বিরতিতে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনার জন্য নির্দিষ্ট সময়সূচি রাখতে হবে। যেন নিজেকে আশ্বস্ত করা যায় যে পরীক্ষা নিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে এবং সেই পরিকল্পনা সফল করতে আপনি কাজ করে যাচ্ছেন।

কলিন এস্পি বলেন, ‘গভীর রাতে পড়াশোনা এড়িয়ে চলতে হবে। আপনি যদি গণিতের সূত্র মাথায় নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েন, তাহলে মাঝরাতে মনের মধ্যে ওই সূত্র মেলানোর কারণে ঘুম ভেঙে যেতে পারে। নিজেকে বিশ্রাম দিতে হবে। দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেলে নিজের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।’

ঘুম ও মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ কলিন এস্পি বলেন, ‘উদ্বেগ, সাধারণভাবে বলতে গেলে তা আমাদের রাতের দুশ্চিন্তা হোক বা দিনের বেলায় উদ্বেগ—এসব একই রূপ ধারণ করে। আর এ কারণেই আপনি পরীক্ষায় যেতে দেরি হওয়া বা উত্তর না জানার মতো পরিস্থিতি সম্পর্কে স্বপ্ন দেখতে পারেন। তবে এসব বিষয়ের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ভাবতে হবে। ’

এদিকে ১৯ বছর বয়সী রোজ পরীক্ষাবিষয়ক স্বপ্ন দেখতে পায় না বা পেলেও তা মনে রাখতে পারে না। এরপরও পরীক্ষা তার ঘুমকে ব্যাহত করে। পরীক্ষার চিন্তায় প্রায়ই রাত দুইটায় তার ঘুম ভেঙে যায়। এই সমস্যার সমাধানও রোজ নিজে নিজে করে ফেলেছে। ওই সময় সে পছন্দের টিভি শো দেখে। রোজ জানিয়েছে, ‘ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর টিভি শো দেখলে আমি শান্ত হই; সহজে ঘুমাতে পারি।’

এ বিষয়ে অধ্যাপক কলিন এস্পি বলেন, নিজেকে ঘুম পাড়ানো অসম্ভব; আপনি কেবল ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। পরীক্ষার আগে ভোর চারটায় যদি দেখেন যে আপনি জেগে আছেন, তাহলে ঠিক যেভাবে আছেন, তার উল্টো দিকে ঘুরে যান। উদ্বেগ কমিয়ে ফেলুন, দেখবেন আরও তিন ঘণ্টা ঘুমাতে পারবেন। এতে মনের উপশম হবে।

এরপরও যদি ঘুম না আসে, তাহলে অন্তত ১০ মিনিট সময় নিতে হবে। এই সময় ঘড়ি বা ফোন কোনোভাবেই দেখা যাবে না। এতেও যদি ঘুম না আসে, সে ক্ষেত্রে কলিন এস্পির পরামর্শ হলো, ‘ঘুম না এলে বিছানা থেকে উঠুন। ঘুমের ভাব এলে আবার বিছানায় ফিরে যান এবং নিজেকে আবার ঘুমাতে দিন। নিজেকে আশ্বস্ত করুন, এতক্ষণ যে জেগে ছিলেন, সেটাও ঠিক ছিল।’ তিনি আরও বলেন, ঘুমানোর জন্য অযথা কঠিন কোনো চেষ্টা করার দরকার নেই। আর এমনটা মাঝরাতে ঘটলে চিন্তার কারণ নেই, ঘুম আসবেই। রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখানো যাবে না। নিজের ঘুমের ওপর আস্থা রাখতে হবে।

তথ্যসূত্র: বিবিসি ও নিউজউইক

আরও পড়ুন