এল নিনো আসলে কী, বাংলাদেশে এর কতটা প্রভাব পড়বে?

দাবানল নিয়ন্ত্রণে দমকলকর্মী কাজ করছেন। ছবি: এএফপি

দক্ষিণ গোলার্ধের আবহাওয়ার স্বাভাবিক গতির পরিবর্তনের ফলে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে (বিশেষ করে পেরু) গরম পানির উপস্থিতিই মূলত এল নিনো। এল নিনো দেখা দিলে সে বছর অস্ট্রেলিয়ার দিকে অয়ন বস্তুর প্রবাহ একেবারেই কমে যায়। কখনো বায়ুশূন্য হয়ে পড়ে। কোনো বছর এটি চরমে ওঠে, তখন বিপরীতও ঘটতে পারে। এটি অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্রের গরম পানির প্রবাহ অস্ট্রেলিয়ার দিকে যেতে বাধা দেয় এবং এই উপকূলের উচ্চ স্রোতকে ঠেলে পেরুর দিকে পাঠিয়ে দেয়। এতে দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রের তাপমাত্রা ও পানির স্তর বৃদ্ধি পায়। ফলে ভূসংলগ্ন বায়ু হালকা হয়ে ওপরে উঠে যায়। এ কারণে ভারী বৃষ্টিপাত দেখা যায়।

বিজ্ঞানীরা এখনো এল নিনোর বিষয়াটি বোঝার চেষ্টা করছেন। কেন এটি ঘটে বা কখন ঘটে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। আগের সব কটি এল নিনো পরম্পর থেকে আলাদা ছিল। প্রতিবারই আবহাওয়ার বিরূপ পরিবর্তন দেখা গেছে। নানা প্রেক্ষাপট ও বিশৃঙ্খল আচরণের কারণে এল নিনোর কারণ পুরোপুরি বোঝা যাচ্ছে না। যদিও আমরা জানি বাতাসের গতির পরিবর্তনের কারণে এল নিনো ঘটে। 

এল নিনো সাধারণত প্রতি চার থেকে সাত বছরে একবার দেখা যায়। এর স্থায়িত্ব ১২-১৮ মাস। তবে গত কয়েক বছরে কয়েকবার এল নিনো দেখা গেছে ও এটি বেড়েই চলেছে। এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত লা নিনা।

লা নিনায় অতিশক্তিশালী আয়ন বায়ুর কারণে প্রশান্ত মহাসাগরের পানির উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। তখন পেরুভিয়ান-তীরবর্তী সমুদ্রের পানি বেশি ঠান্ডা হয়। আর অস্ট্রেলিয়ায় ভারী বৃষ্টিপাত হয়।

এল নিনো সময়ের অবস্থা

• দুর্বল বা বিপরীত আয়ন বায়ু প্রবাহিত হয়।

• পশ্চিম-দক্ষিণ আমেরিকায় সমুদ্রের পানি গরম থাকে।

• পেরুভিয়ান অঞ্চলের সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পায়।

• দক্ষিণ আমেরিকায় ভারী বৃষ্টিপাত দেখা যায়।

• অস্ট্রেলিয়ায় খরা দেখা দেয়।

লা নিনা সময়ের অবস্থা

• পশ্চিম-দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলের সমুদ্রের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ঠান্ডা হয়।

• অষ্ট্রেলিয়ায় ভারী বৃষ্টি এবং বন্যা দেখা যায়।

অষ্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলের সমুদ্রের পানি

বেশি উষ্ণ থাকে। 

• বসন্ত আর গ্রীষ্মে বেশি ঘূর্ণিঝড় দেখা যায়।

এল নিনো মানে প্রশান্ত মহাসাগরে উষ্ণ সমুদ্রস্রোত। এই স্রোতের ফলে উষ্ণ হয়ে ওঠে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূল, বিশেষ করে পেরুর দিকের পানি। এ সময় দক্ষিণ গোলার্ধের পুবালি বায়ুর প্রবাহ বদলে যায়।

পুবালি বায়ু সাধারণত পেরু থেকে অস্ট্রেলিয়ার দিকে বয়ে যায়। এল নিনো পরিস্থিতিতে এই বায়ুপ্রবাহ কমে যায়, থেমে যায়, অথবা উল্টে যায় এর দিক। বায়ু তখন পুব থেকে পশ্চিমে পশ্চিম প্রবাহিত হয়। ফলে যে সমুদ্রস্রোতের উষ্ণ পানিকে অস্ট্রেলিয়ার তাঁরা দিকে বয়ে নেওয়ার কথা, তার দিকও উল্টে যায়। সমুদ্রস্রোতের টানে উষ্ণ পানি বয়ে যায় পেরু, অর্থাৎ দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের দিকে। এই পানি আসে অস্ট্রেলিয়া উপকূল থেকে। ফলে অস্ট্রেলিয়া উপকূলে পানি নেমে যায়। আর বেড়ে যায় পেরু উপকূলের সমুদ্রের তাপমাত্রা ও উচ্চতা। এসব পরিবর্তনের কারণে পেরুতে বায়ুর ঊর্ধ্বমুখী পরিচলন ঘটে। ফ্লুইড বা প্রবাহীর অবস্থানান্তর ঘটতে পারে তিনভাবে। পরিবহন, পরিচলন ও বিকিরণ। পানির মতো বাতাসও একধরনের প্রবাহী। আর বাতাসের ঊর্ধ্বমুখী পরিচলন হলে তা সঙ্গে করে সামুদ্রিক পানি নিয়ে যায়। পৌঁছে দেয় বায়ুমণ্ডলে। এই পানি বায়ুমণ্ডলে উচ্চচাপে ঘন হয়, ফলে তাপমাত্রাও কমে। একসময় ঝরে বৃষ্টি হয়ে, অর্থাৎ যে বৃষ্টি স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অস্ট্রেলিয়ায় হওয়ার কথা, তা হয় পেরুতে।

বাংলাদেশ, ভারত বা দক্ষিণ এশিয়ায় 

পুবালি বায়ু যখন পুবে না বয়ে পশ্চিমে বয়ে যায়, তখন অস্ট্রেলিয়া থেকে শুরু করে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার- এই পুরো অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যায়। কারণ, বাতাসের প্রবাহ সমুদ্রস্রোতকে বয়ে নিতে থাকে পশ্চিম দিকে। ফলে পশ্চিম দিকে বৃষ্টি বাড়ে। আর বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত—এসব অঞ্চলে দেখা দেয় বৃষ্টির অভাব। বেড়ে যায় তাপমাত্রা। শুকিয়ে যায় মাটি। এমনকি খরাও দেখা দিতে পারে।

দেশের উত্তরাঞ্চলে শীত পড়েছে।
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

প্রথম আলোর তথ্য মতে, বর্তমানে ঢাকায় দিনে দেড়–দুই ঘণ্টার বেশি রোদ থাকছে না। দেশের উত্তরাঞ্চলের অনেক এলাকায় সারা দিনে একবারও ঠিকমতো সূর্যের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, ঘন কুয়াশার চাদর ঘিরে রেখেছে আশপাশ। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, দমকা হাওয়া বা বৃষ্টি না নামলে ঘন কুয়াশা সরবে না। আর কুয়াশা না সরলে রোদ এসে শীতের দাপট কমাতে পারবে না। আগামী বৃহস্পতিবার থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে আকাশে মেঘ জমতে পারে। অনেক জায়গায় শুরু হতে পারে বৃষ্টি। বৃষ্টি চলতে পারে দু–তিন দিন। এরপর শীতের তীব্রতা কিছুটা কমতে পারে। 

আবহাওয়াবিদেরা সারা দেশে কুয়াশার দাপট বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে গত ডিসেম্বর মাসজুড়ে থাকা বাড়তি তাপমাত্রাকে দায়ী করছেন। ডিসেম্বর মাসে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেশি ছিল। জানুয়ারিতে এসে তাপমাত্রা হঠাৎ ৪–৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে গেছে। হঠাৎ তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় প্রচুর কুয়াশা তৈরি হয়েছে। কুয়াশার কারণে সূর্যের আলো ভূমিতে কম আসতে পারায় শীতের অনুভূতি বেশি হচ্ছে।