কিআর পৃথিবী অনেক বড়
‘তুই এখনো কিশোর আলো করিস?’ এই প্রশ্ন আমাকে মাঝেমধ্যেই শুনতে হয়। সাধারণত স্কুল-কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে কুশলবিনিময়ের পর ‘কী করছি’ জাতীয় প্রশ্নের উত্তরে উপস্থিত হয় এই প্রশ্ন। ওদের বিস্ময় অস্বাভাবিক নয়। কিশোর আলোয় যখন কাজ শুরু করেছি, তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর প্রকাশিত হয় প্রথম কিশোর আলো। তার আগে দুই নববর্ষে পরীক্ষামূলকভাবে ‘কিশোর’ নামে দুটো বিশেষ সংখ্যা বেরিয়েছিল। দুটোতেই যুক্ত ছিলাম আমি। মূলত বর্তমান কিশোর আলোর ভিত্তি ছিল সেই দুটো বিশেষ সংখ্যা। সে হিসাবে বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকে এখনো আমি কিশোর আলোর সঙ্গেই আছি। তাই আমার বন্ধুরা যখন ‘তুই এখনো কিশোর আলো করিস?’ বলে, আমি অবাক হই না। আমি তো আসলে বেড়েই উঠেছি কিশোর আলোর সঙ্গে।
শুধু আমি নই, ১১ বছর ধরে ছুটে চলা এই ম্যাগাজিনের সঙ্গে বেড়ে উঠেছে বাংলাদেশের অসংখ্য শিশু-কিশোর-তরুণ। এখনো কোনো কনসার্টে কিংবা কোনো বইয়ের দোকানে হুট করে ছুটে এসে কেউ বলে, ‘চিনতে পারছেন না ভাইয়া? আমি কিশোর আলোয় আসতাম।’ দীর্ঘ সময়ে কত শিশু-কিশোর কিআর সংস্পর্শে এসেছে, সবাইকে চিনব কী করে! কারও কারও সঙ্গে কথা বলার এক পর্যায়ে জানা যায়, ‘ওহ, আমিও তো কিশোর আলো পড়তাম ছোটবেলায়।’ এমন অসংখ্য পাঠক-স্বেচ্ছাসেবক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে কিশোর আলোর সঙ্গে। ১ অক্টোবর কিশোর আলোর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠকদের নিয়ে একটা সভা করেছিলাম আমরা। ঢাকার বিভিন্ন স্কুল থেকে শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছিল সেই সভায়। ‘কেমন কিশোর আলো চাই’ এ প্রসঙ্গে নানা রকম মত দিয়েছিল তাদের অনেকেই। গল্প-আড্ডায় ভরপুর সেই ছোট্ট ঘরোয়া সভায় এসেছিল দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আহমাদ মুদ্দাসসের। অনেক বছর পর ২০২৩ সালে কিশোর আলোয় সহসম্পাদক হিসেবে যোগ দেয় সেই আহমাদ। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ঢাকায় এসেছিলেন ২০১৫ সালে। ঠিক হলো, কিশোর আলো থেকে তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে। সারা দেশ থেকে পাঠকেরা প্রশ্ন পাঠিয়েছিল সেই সাক্ষাৎকারের জন্য। বাকি সবার প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত কিছু পাঠক সুযোগ পেয়েছিল অমর্ত্য সেনের সামনে গিয়ে প্রশ্ন করার। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হলো পরের মাসের কিশোর আলোয়। সেখানে আহমাদ মুদ্দাসসেরের তিনটি প্রশ্ন নির্বাচিত হয়েছিল। কিন্তু ‘যাদের প্রশ্ন ছাপা হলো’ তালিকায় ওর নামের বানান হলো ভুল। আমরা লিখেছিলাম ‘আহমেদ মুদাচ্ছের’। আমরা তো আর জানি না, এটা ভুল। কিন্তু আহমাদ জানত। কর্মী হিসেবে যোগ দেওয়ার পর সে নিজেই অনলাইনে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে নিজের নামের বানানটা ঠিক করেছে!
কিশোর আলোয় আসা শিশু-কিশোরেরা যে কিশোর আলোতেই সীমাবদ্ধ, তা নয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে গেছে তারা। কেউ হয়েছে জনপ্রিয় কার্টুনিস্ট, কেউ লেখক। কেউ কেউ সংগঠক, গবেষক, শিক্ষক, আইডিয়াবাজ, শিল্পী, ফিল্মমেকার, ফটোগ্রাফার ইত্যাদি নানা পেশায় নিয়োজিত। দেশ ছেড়ে বিদেশে গিয়েও কিশোর আলো ছাড়তে পারেনি কিআর লেখক-স্বেচ্ছাসেবক সরদার আকিব লতিফ, গোলাম মমীত কিংবা ফাহমিদা আলম। হাজার মাইল দূরে থেকেও কিআর প্রতিটি আয়োজনে রয়েছে তাদের অংশগ্রহণ। দেশ–বিদেশের নানা জায়গায় ছড়িয়ে থাকা কিআপ্রেমীদের দেখে মনে হয় যথার্থই হয়েছে কিশোর আলোর স্লোগান—আমার পৃথিবী অনেক বড়।
আমরা বিশ্বাস করি, শিশু-কিশোরদের কল্পনার পৃথিবীটা অনেক বড়। শিশু-কিশোরেরা সেই কল্পনার জগৎটাকে আবিষ্কার করুক, এটাই আমাদের চাওয়া। সে লক্ষ্যেই মাসিক ম্যাগাজিন থেকে কিশোর-তরুণদের একটা প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে কিশোর আলো। লেখালেখি ছাড়া আছে কিআ বুক ক্লাব, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি ক্লাব। ছেলেমেয়েরা এখানে এসে গান গায়, স্ট্যান্ডআপ কমেডি করে, উপস্থাপনা করে। সরদার আকিব লতিফ যেমন জানতই না যে গ্রাফিকস ডিজাইনে ওর এত আগ্রহ। কিআর অক্টোবর সংখ্যায় আকিব লিখেছে, ‘ওয়েবসাইট সম্পর্কে শূন্য জ্ঞান নিয়ে কাজ শুরু করা আমার হাতে বছর তিনেক কিশোর আলো ডটকমের বেশ কিছু দায়িত্ব ছিল। প্রতিদিন শিখেছি কীভাবে নিজের বৃত্তের বাইরে গিয়েও কাজ করা যায়, কীভাবে চাইলেই সুন্দর কিছু তৈরি করা সম্ভব হয়। কিআ হাত ধরে ধরে আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে গোটা একটা ম্যাগাজিন প্রকাশ করতে হয়।’ শিশু-কিশোরদের এই আত্মবিশ্বাসই আমরা দিতে চেয়েছিলাম। কিশোর আলো পড়ে কিংবা কিশোর আলোর সংস্পর্শে এসে ওরা যেন বড় স্বপ্ন দেখতে পারে। করতে পারে বড় কিছু। ওরা বড় কিছু করলে আমাদেরও ভালো লাগে, গর্ব হয়।
কিশোর আলোর এই লম্বা ইনিংসের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান পাঠকদের। পাঠকেরা প্রতিনিয়ত ভালোবাসা, হুমকি, অভিমান, রাগ, বকা মিশিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কিশোর আলোকে। ‘এটা কী গল্প ছাপিয়েছ?’ ‘প্রচ্ছদ পছন্দ হয় নাই’, ‘এত ভুল কেন? ইদানীং কি সব ভুলে যাচ্ছ?’ এ রকম অসংখ্য চিঠি আর দাবি কিশোর আলোর শক্তি। শিশুরা এত তীক্ষ্ণ চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কিশোর আলো পড়ে যে বিস্মিত হই আমরা। কিশোর আলোর প্রচ্ছদের নিচে একটা সময় টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন ছিল। কিছুদিন পর এল কলমের বিজ্ঞাপন। ক্লাস ফোর কিংবা ফাইভের এক পাঠক চিঠি লিখে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, তুমি তো আগে আমাদের দাঁত ব্রাশ করার কথা বলতে। ইদানীং দেখছি আর বলছো না। কলমের কথা বলছো। তুমি কি ভেবেছ আমাদের দাঁত ব্রাশ করা শেষ?’ পাঠকদের মজার মজার চিঠি আর ই–মেইল আমাদের প্রেরণা জোগায় প্রতিনিয়ত।
অবদান আছে অভিভাবক ও শিক্ষকদেরও। অনেক অভিভাবক-শিক্ষক শিশুদের হাতে কিশোর আলো তুলে দেন। তাঁদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা। ধন্যবাদ লেখক, ছড়াকার, শিল্পীদের। তাঁদের অবদানেই প্রতি মাসে বর্ণিল হয়ে ওঠে কিশোর আলোর প্রতিটি পাতা। কিআর পাঠকেরা প্রতি মাসেই হুমকিসমৃদ্ধ চিঠি পাঠায়, যার সারমর্ম হলো, ‘কিআ, খবরদার, বিজ্ঞাপন কম খাবে বলে দিলাম।’ কিন্তু আমরা জানি, বাংলাদেশে একটা ম্যাগাজিন নিয়মিত বের করা কঠিন হতো বিজ্ঞাপনদাতারা পাশে না থাকলে। ধন্যবাদ বিজ্ঞাপনদাতাদের।
সবার প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছে কিশোর আলো। নিশ্চয়ই এগোবে আরও অনেক দূর। অনেক বছর পর একদিন কিশোর আলো অফিসে এসে দেখব, আমার চেয়ারে বসে আছে সদ্য কৈশোর পেরোনো কেউ, যার লেখা হয়তো একসময় কিশোর আলোয় আমিই ছেপেছিলাম। চশমার ফাঁক দিয়ে কড়া চোখে সে হয়তো বলবে, ‘ও আপনি, আপনাকেই তো খুঁজছিলাম, ২০২৪ সালের জুন সংখ্যায় আমার নাম ভুল ছেপেছিলেন কেন?’