করোনা মহামারিতে ঘরবন্দী ছিলাম আমরা সবাই। সারা দিন কেটেছে বিছানায় এলিয়ে থেকে কিংবা পড়ার ঘরের চেয়ারে বসে। এমন অলস জীবনযাপনে কারো কারো যেমন বেড়েছ শরীরের ওজন, তেমনি বেড়েছে শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা।
এই যন্ত্রণা শুধু করোনার জন্যই না, হতে পারে যেকোনো সময়। আর এমন যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার সহজ একটা উপায় আছে— খুলে ফেলতে পারো তোমার শরীরের সব হাড়!
বাস্তবে সেটা সম্ভব না। কিন্তু আসলেই যদি আমাদের শরীরে হাড় না থাকত, তাহলে কী হতো? মানুষের মুখে কোনো হাড় না থাকলে খাবার খেত কীভাবে?
মানুষের ভেতরের কঙ্কাল, অর্থাৎ হাড়ের তৈরি কাঠামোটি বানানো হয়েছে নানা রকম হাড়, লিগামেন্ট, টেন্ডন ও কার্টিলেজ মিলিয়ে। এসব হাড় শুধু আমাদের কাঠামো ঠিক রাখে তা নয়, বরং এগুলো বিপুল পরিমাণে মিনারেল, লোহিত রক্তকণিকা ও সাধারণ চর্বি–জাতীয় উপাদান তৈরি করে। যদি কোনোভাবে তোমার শরীর থেকে হাড় বের করে নেওয়া যায়, তাহলে তুমি কিন্তু হাঁটতেই পারবে না। সারা দিন বিছানায় শুয়ে থেকে কাটাতে হবে। তবে সমস্যা কিন্তু সেখানেই শেষ নয়, বরং তুমি যদি শ্বাস নিতে চাও, তোমার বুকের হাড়গুলোও প্রয়োজন হবে। বুকের হাড় তোমার ফুসফুসকে সময়মতো শ্বাস নিতে আর প্রশ্বাস ছাড়তে সাহায্য করবে। যদি তোমার হাড় না থাকে, তখন ফুসফুস সব সময়ই খোলা থাকতে হবে। ফলে বাইরের দূষিত বাতাস প্রবেশের কারণে তোমার ফুসফুসে ক্ষত হতে পারে, আক্রমণ করতে পারে প্রাণঘাতী ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া।
তবে অনেকেই ভাবতে পারো, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কিংবা নিয়মিত ওষুধ খেলেই তুমি সুস্থ থাকবে। কিন্তু তোমার চোয়ালের হাড় ছাড়া সেটাও তো সম্ভব না। কিছু পান করা কিংবা চিবিয়ে খাওয়া—দুই কাজের জন্যই দরকার হাড়ের। অবশ্য কোমরের হাড়ের যন্ত্রণা কিংবা হাড় ভেঙে প্লাস্টিক সার্জারির কথা ভুলে নিশ্চিতে থাকতে পারবে তুমি।
আমাদের শরীরে হাড় না থাকলে আমরা হয়তো সমুদ্রে বাস করতাম। অনেকটা হাড়বিহীন জেলিফিশ কিংবা অক্টোপাসের মতো। তবে তখন হয়তো পোকামাকড়ের মতো আমাদের শরীরের বাইরে হাড়ের গঠন (এক্সো-স্কেলেটন) তৈরি হতো। কিন্তু এতে আমাদের গড় আয়ু কমে আসার আশঙ্কা অনেক বেশি। কেননা, হাড় আমাদের শরীরের অভ্যন্তরীণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করে। শুধু মাথার অংশ নিয়েই তুমি চিন্তা করো। মাথায় খুলির হাড় না থাকলে আমাদের মস্তিষ্ক পুরোটাই উন্মুক্ত থাকবে। বাইরের যেকোনো আঘাতে মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে পারে।
ছোট থেকে যখন তুমি বেড়ে উঠছ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু আমাদের হাড়ের গঠন বড় হচ্ছে। আবার কিছু কিছু অংশে পরিবর্তনও হচ্ছে। কিন্তু আধুনিক জীবনব্যবস্থার কারণে আমাদের শরীরের বিভিন্ন হাড়ের গঠনও বদলে যাচ্ছে। এই যেমন ধরো, এখন আমাদের মাথার খুলির পেছনের অংশে এক্সটার্নাল অক্সিপিটাল প্রোটিউবারেন্স নামে একটি বিশেষ অংশ আছে। কিন্তু কয়েক দশক আগেও কিন্তু এটি এখানে ছিল না। এমনকি ১৮৮৫ সালের আগে কোনো বিজ্ঞানী খুলির কোনো অংশেই এটির উপস্থিতি বুঝতে পারেননি। তাহলে কীভাবে এটি তৈরি হলো? গত কয়েক দশকে আমাদের ডিভাইস ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই আমরা দিনের বেশির ভাগ সময় কাটাচ্ছি ল্যাপটপ, ট্যাবলেট ও মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে। যা আমাদের ঘাড়ে বেশি চাপ সৃষ্টি করছে। খুলির এই প্রোটুরেন্স অংশ চ্যাপ্টা হওয়ার ফলে ঘাড়ের হাড়ের অতিরিক্ত চাপ সমানভাবে পুরো খুলিতে ছড়িয়ে দেয়। এ কারণে খুলির হাড়ের ক্ষয় তুলনামূলকভাবে কমে যায়। মূলত হাড় নিজের গঠনকে আরও শক্তপোক্ত করতেই এভাবে নতুনভাবে তৈরি হয়।
তবে আমাদের সবার যে সাধারণভাবেই সুস্থ স্বাভাবিক হাড় থাকে, তা কিন্তু নয়। হাড় ক্ষয়ের একটি বিশেষ জিনগত রোগ হচ্ছে হাইপোফসফাটেসিয়া। সারা বিশ্বে প্রতি ১০ লাখ মানুষের একজন জন্মগতভাবে এই রোগ নিয়ে জন্মায়। এই রোগ থাকলে অ্যালকালাইন ফসফাটেস নামের বিশেষ এনজাইমের অভাবে রোগীর হাড় ক্ষয় হতে হতে হাড় কমে যেতে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে এই রোগের লক্ষণ থাকে দুর্বল হাড়। অর্থাৎ, সামান্য আঘাতেই রোগীর হাড় ভেঙে যায়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদিও আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই রোগের সমাধান এসেছে। বিশেষ ধরনের এনজাইম ব্যবহারের কারণে নতুন করে আক্রান্ত ব্যক্তির হাড় তৈরি হয়।
তাই সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে সুস্থ, স্বাভাবিক ও শক্ত হাড়ের কোনো বিকল্প নেই। নিয়মিত ব্যায়াম করা, পরিমিত পানি পান করা, পুষ্টিকর খাবার ও ফলমূল খেতে হবে; যা তোমার হাড়ের গঠনকে আরও মজবুত করে তুলবে।
তথ্যসূত্র: ইনিশ ওয়ার্ল্ড